সমাজের দুষ্ট ক্ষত দেখিয়ে দিল ক্যাসিনো

প্রকাশ | ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১৭

বজ্রপাতের শব্দ ভয় ধরালেও বিদ্যুচ্চমক ভয়ংকর। তা কেড়ে নেয় প্রাণ। তবে দু-একজনের প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে সে আবার মূহুর্তে উদ্ভাসিত করে দেয় চারদিক। এক ঝলকে দেখিয়ে দেয় চারপাশ। তেমনি অন্ধকার রাতে বিদ্যুচ্চমকের মতো ক্লাবগুলোতে, বাণিজ্যিক এলাকায় এবং বাড়িঘরে একের পর এক ক্যাসিনো আবিষ্কার দেখিয়ে দিল সমাজের এক ভয়াবহ দুষ্ট ক্ষত। যে ক্লাবগুলো ছিল খেলাধুলা করার এবং করানোর প্রতিষ্ঠান মানুষ দেখছে যে সেখানে খেলার বাইরেও কত কিছু হয়! ৬০টি ক্যাসিনোতে প্রতিদিন নাকি গড়ে ১২০ কোটি টাকার জুয়া খেলা হতো। ঈদে, উৎসবের দিনে যেমন নেশার দ্রব্য বেশি বিক্রি হয় তেমনি জুয়া খেলাও বাড়ে। তাহলে বছরে কত? সাধারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে তার পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এত টাকা জুয়ার বোর্ডে? মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো তথ্য। এর বাইরে আছে অনলাইন ক্যাসিনো। এরপর বেরিয়ে এলো আরও চমকপ্রদ তথ্য। ক্যাসিনো যারা পরিচালনা করে তারা ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের মাঝারি পর্যায়ের নেতা। বিভিন্ন নেতার আশীর্বাদে পুষ্ট হয়েছে তারা এবং তারা মোটেই

অকৃতজ্ঞ নয়। দলের নেতা, প্রশাসন, পুলিশ সবাইকে সন্তুষ্ট করে নির্বিবাদে জুয়ার ব্যবসা চালিয়েছে, শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছে।

অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা বলে যাকে বলা হচ্ছে সেই সেলিমের ১৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের খবর পেয়েছে র‌্যাব। যার একটিতেই মাসে ৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তিনটি গেটওয়ে দিয়ে সেলিম মাসে ২৭ কোটি টাকা এবং বছরে ৩২৪ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সব ক্যাসিনো মালিকদের বিদেশেও সম্পদ আছে প্রচুর। লোকমান নামে একজন স্বীকার করেছেন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। এরকম কত নাম উঠে আসছে একটু নাড়া দিতেই। একজনের চাইতে আরেকজন কত বেশি তার যেন এক প্রতিযোগিতা! তাদের বাড়িতে, অফিসে কোটি কোটি নগদ টাকা, এফডিআর-এর পরিমাণ দেখে চমকে উঠতে হয়। কারও অফিসে ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, একজনের বাড়িতে ৭২০ ভরি সোনা পাওয়া গিয়েছে, নগদ পাওয়া গেছে ৫ কোটি টাকা। তাদের সবার একটা ক্ষেত্রে মিল আছে। তারা সবাই উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদার। ঠিকাদারির কাজ পেতে হাজার কোটি টাকা নাকি তারা কর্তাব্যক্তিদের ঘুষ দিয়েছে। আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী দেশগুলোতে মাদক, যৌনতা আর ক্যাসিনোর মেলবন্ধনের কথা সবাই জানে। বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতা সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। এখন উদ্ঘাটিত হলো ক্যাসিনোর বিস্তৃতির চিত্র।

সব উন্নত দেশেই ক্যাসিনো আছে বলে শুরুতে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশ তো এখন উন্নত দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে তাই এগুলো উন্নয়নের অনুষঙ্গ বলে তৃপ্তি পেতে চাইছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু ঘটনার ভয়াবহতায় তারা এখন চুপ করে গেছেন। ইতালিয়ান শব্দ রুটুকাসা থেকে ক্যাসিনো শব্দটি এসেছে, যার অর্থ বাড়ি। বাড়িতে বসে জুয়া খেলা থেকে আজকের এই বিশাল এবং ভয়াবহ ক্যাসিনোর জন্ম। পুঁজিবাদের প্রাথমিক বিকাশ যে অঞ্চলে ঘটে তার মধ্যে ভেনিস অন্যতম। ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্যাসিনোর মাধ্যমে জুয়া খেলার আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে একে আনুষ্ঠানিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় চালু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩১ সালে। নেভাদায় প্রতিষ্ঠা করে ক্যাসিনো। সময়টা খেয়াল করুন, বিশ্বমন্দায় কাঁপছে আমেরিকা, ইউরোপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল আর সে সময় আইনিভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ক্যাসিনো। যুক্তরাষ্ট্রে এখন বৈধ ক্যাসিনোর সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। ক্যাসিনোর শীর্ষে যে অঞ্চলের নাম তা হলো লাস ভেগাস। সেখানের ক্যাসিনো মালিকদের আয় নাকি ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিশ্বব্যাপী ক্যাসিনো ব্যবসায় খাটছে ৫০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৪২ লাখ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের বাজেট ৫ লাখ কোটি টাকা তার মানে বাংলাদেশের বাজেটের ৮ গুণ বেশি টাকা ঘুরছে ক্যাসিনোর টেবিলে। এছাড়াও অনলাইন ক্যাসিনোতে ২০১৭ সালে নাকি ৫০ বিলিয়ন ডলার হাতবদল হয়েছে। কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন কিংবা সেবা খাত নয় জুয়ায় উড়ছে টাকা, অপচয় হচ্ছে যৌবনের শক্তি, নেমে যাচ্ছে সংস্কৃতির মান, যৌনতা-সহিংসতার বিস্তার ঘটছে অবাধে। পুঁজিবাদী শোষণ আর ক্যাসিনো সংস্কৃতি হাত ধরে চলছে। সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা, যুদ্ধের হুংকার, মাদক এবং জুয়া গোটা পৃথিবীটাকেই অস্থির করে তুলেছে।

বাংলাদেশের চিত্রটাও ভিন্ন নয়। উন্নয়ন, লুণ্ঠন ও বৈষম্য পাল্লা দিয়েই বাড়ছে। কোটি যুবকের কাজ নেই, যাদের কাজ আছে তাদের মানসম্পন্ন জীবনযাপনের মতো বেতন নেই। সুউচ্চ ভবন মাথা তুলছে আকাশে আর মনুষ্যত্ব, গণতান্ত্রিক অধিকার লুটাচ্ছে মাটিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য দেখিয়ে দিলেন শিক্ষা ও নৈতিকতার মান কতটুকু নেমেছে। কিন্তু সেøাগান উঠছে উন্নয়ন চাই। উন্নয়নের মোহে আচ্ছন্ন করে অধঃপতনের যে অবাধ যাত্রা শুরু হয়েছে তার শেষ কোথায়? যে দেশে ৮/১০ হাজার টাকার জন্য একজন গার্মেন্টস যুবক সারা মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, কৃষক একমণ ধান বিক্রি করে ৫০০ টাকা পায় না, পড়াশুনার খরচ জোগাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী টিউশনি করতে বাধ্য হয়, শিক্ষা শেষে ২০/২৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি জোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যায়, চাকরির আশায় দেশের বাইরে অনিশ্চয়তার পানে ছুটছে লক্ষ লক্ষ যুবক, সেই দেশে এক রাতের জুয়ায় ১০/১৫ হাজার টাকা উড়িয়ে দেয় যে যুবক তারা কারা? তাদের বা তাদের বাবাদের আয়ের উৎস কী? এই সব অবৈধ আয়ের মানুষদের কাছে পেঁয়াজের দামবৃদ্ধি, ধানের দাম না পাওয়া বা শ্রমিকের কম মজুরি কোনো বিবেচনাযোগ্য বিষয় নয়।

ওপরের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল এবং এখন তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা চলে আসছিল। এটা বর্তমান সরকারের আমলের বিষয় নয়। ঢাকায় ক্যাসিনো পরিচালনার এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে, এর দায় অনেকের (যদিও এখন কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি নন) এবং এর আয়ের ভাগ অনেকেই পেত। শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও নাকি এই টাকা যেত অনেকের কাছে। প্রশ্ন উঠছে, ক্যাসিনোর মালিক, সহায়তাকারী এবং যারা এতদিন ক্যাসিনো পরিচালনা করেছিল তাদের ক্ষমতা কোন খুঁটিতে বাঁধা ছিল? রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন হলেও তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি কেন? তাদের রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টেছে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ব্যবসা বদল হয়নি। তাদের কারও কোনো রাষ্ট্রীয় পদ ছিল না কিন্তু তারা ঘুরতেন ভিআইপি’র মতো। মানুষ বলত তাদের অনেক ক্ষমতা। রাষ্ট্রের ক্ষমতার সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া বাঁধা ছিল। আজ হঠাৎ করে সে বাঁধন কে খুলে দিল এবং কেন খুলে দিল? এই বন্ধন ছিন্ন হওয়া কি সাময়িক নাকি নতুন সম্রাটের অভিষেকের প্রস্তুতি? ক্যাসিনোবিরোধী এই অভিযান চলবে কি আরও বহুদিন এবং বহুদূর? শেকড়ের সন্ধান কি মিলবে নাকি এরা এমন বৃক্ষের ফুল যে বৃক্ষের শেকড় নেই, কাণ্ড নেই, পাতা নেই শুধু ফুল ফুটে আছে? ক্যাসিনো ব্যবসার ফুল যেটা ফুটেছে বলে সবাই দেখেছে, যার গন্ধ পেয়েছে তাকেই ছিঁড়ে ফেলা হবে নাকি শেকড়টাও উপড়ানো হবে? এসব প্রশ্ন ঘুরছে এখন মানুষের মুখে মুখে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাদক, জুয়া পরস্পরের সঙ্গে দারুণভাবে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের এ বাঁধন ছিন্ন করা কঠিন।

ক্যাসিনো কি প্রধান সমস্যা নাকি এটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিকশিত হওয়া দুর্নীতির একটি ক্ষুদ্র অথচ ভয়ংকর বহিঃপ্রকাশ? ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদ্য বিদায়ী কমিশনার তো ক্ষুব্ধভাবেই একটি নির্জলা সত্যের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আপনি এখন ক্যাসিনো নিয়ে এত কথা বলছেন, এখন যদি অন্য সেক্টরের কথা বলি? অন্য সেক্টরের অবস্থা তো আরও গুরুতর। পরিবহস সেক্টরে কেউ গাড়ি চালাতে পারে না টাকা না দিয়ে রাস্তায়। আসেন শেয়ার কেলেঙ্কারিতে, কোথায় গেল এই টাকা? কারা করছে এই শেয়ার কেলেঙ্কারি? এটা খুঁজে বের করলে অনেক কিছু বের হয়ে যাবে না? শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংকের টাকা লুটের কথা যদি বলি, তারপর পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজির কথা বলি, খাল-বিল-ফুটপাত দখলের কাহিনী বলি। বহু কাহিনী খুঁজে দেখেন, এর পেছনে কারা?’

এই পেছনের শক্তি কারা তা বলতে না পারলেও বোধহয় তা কারও কাছেই অজানা নয়। সম্রাট, সেলিম, খালেদ, শামিম এই নামগুলো সবার সামনে এসেছে কিন্তু কোন শক্তি ও কারা এদের তৈরি করল তা কি আসবে না। যে পদ্ধতিতে তারা তৈরি হয়েছে সেই পদ্ধতি বহাল থাকলে নতুন নতুন নাম আসবে আরও আধুনিক ও ভয়াবহ উদাহরণ সৃষ্টি হবে। সাধারণ মানুষের শ্রমে তৈরি সম্পদ লুটপাট করা আর ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে ফেলা এই অশুভ শক্তির কাছে মানুষ কতদিন স্বেচ্ছায় বন্দি হয়ে থাকবে সেটাই গুরুতর ভাবনার বিষয়।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট