২৭৩ ঘন্টার একটি সফল আন্দোলন

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০২:১১

প্রতিটা ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় নতুন স্বপ্ন নিয়ে, নতুন আশা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত জ্ঞান চর্চার জায়গা। তেমনি সবার মতো নতুন স্বপ্ন নিয়ে ২০১৬ সালে আমিও ভর্তি হই গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম এই বিশ্ববিদ্যালয় অন্য পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো না, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ছিলেন খোন্দকার নাসিরউদ্দিন নামে এক সর্বগ্রাসী দুর্নীতিবাজ যিনি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিজের দুহাতে মুঠোবন্দি করে রেখেছিলেন ও সবার বাক-স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করেছিলেন।

২০১৯ সাল। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের চতুর্থ বর্ষ পার করছি। এমন এক সময়ে এক সাহসী পদক্ষেপ নিলেন জিনিয়া নামের সাহসী এক মেয়ে। সেই ইস্যু থেকে চার নেতা ফেইসবুক লাইভে এসে ১৪ দফা দাবিতে সকল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ডাক দিলেন ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে। রাতে এক বিরাট উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম সকালে আন্দোলনে যাব ভেবে। কিন্তু রাতারাতি সব কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেল। সকালে উঠে দেখলাম প্রহসন শুরু হয়ে গেছে। ১৪ দফা দাবি প্রশাসন মেনে নিয়ে নোটিশ দেয়া হয়েছে। আশায় গুড়েবালি। যে নতুন ভোর দেখার প্রত্যাশায় প্রতিটা শিক্ষার্থী ঘুমাতে গিয়েছিল তা আর হচ্ছে না। কিন্তু তিল তিল করে গড়ে ওঠা ক্ষোভ তো আর লুকানো যায় না।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা আস্তে আস্তে জমতে শুরু করেছে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে। হঠাৎ ফেইসবুকে এক শিক্ষার্থীর লাইভ দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সবাই এক দফা দাবির জন্য মাঠে নেমেছে। প্রিয়তাকে ফোন দিয়ে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে রেডি হয়ে তাকে নিয়েই ক্যাম্পাসে গেলাম। ততক্ষণে সবাই প্রশাসনিক ভবনের নিচে বসে গিয়েছে তাদের দাবি আদায়ে।

এবার আসি চার নেতার কথায়। উনাদের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে আর কোন স্থান নেই। কারণ গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলে কেউ তাকে আপন ভাববে না এটাই স্বাভাবিক। উনাদের সাথে কথা বললাম। উনারা বললেন, তাদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে ভিসির অপসারণ ছিল না। উনারা জানালেন তারা আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। আমি বললাম আপনাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন আর ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। আপনারা যেহেতু একাত্মতা ঘোষণা করেছেন এটা নিয়ে ফেইসবুকে একটা পোস্ট দেন। তারা তাতে নারাজ।

এরপর থেকে শুরু হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবিতে আন্দোলন। ততক্ষণে এটা বুঝতে পেরেছি আন্দোলনের জায়গা ছেড়ে দিলে আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর এক হওয়া প্রায় অসম্ভব তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম রাতেও আন্দোলন চলবে। এভাবে যখন আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগলাম, ২১ সেপ্টেম্বর সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পাসে আসতে বাধা দেয়া হলো, সাবেক ভিসির পেটোয়া বাহিনী দিয়ে হামলা করানো হলো। কারোর হাত ভাঙলো, কারোর পা ভাঙলো, কারোর মাথা ফাটলো। হাসপাতালে যখন তাদের দেখতে গেলাম সেই আহত ভাই বোনরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, "আন্দোলনের কি অবস্থা আপু? কোন অবস্থাতেই আন্দোলন যেন বন্ধ না হয়।" এগুলো শুনে শুধু বলেছিলাম আগে সুস্থ হয়ে উঠো ভাই। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের স্ব-স্ব জায়গা থেকে যে যেভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে। কেউ টাকা দিয়ে, কেউ শ্রম দিয়ে, কেউ মার খেয়ে।

রাতের পর রাত সারা ক্যাম্পাসে টহল দিয়েছে, বোনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মেয়েদের হল গেইটে সারা রাত বসে পাহারা দিয়েছে, ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখার জন্য নোংরা পরিষ্কার করেছে। এভাবে না খেয়ে, না গোসল করে, না ঘুমিয়ে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা স্লোগান দিয়েছে। সবার ডেডিকেশন দেখলে বোঝা যায় কতদিনের কত ক্ষোভ জমে আছে।

শিক্ষকদের অবদান ও কম ছিল না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুটি কয়েকজন শিক্ষক সবসময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনোবল কখনো হারাইনি। এসব শিক্ষকদের কাছে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা সারাজীবন কৃতজ্ঞ।

গণমাধ্যমের কথা না বললেই নয়। তারাও এই আন্দোলনের একাংশ। তাদের সততা আর নিষ্ঠার জন্যই সারা দেশ জানতে পেরেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কতটা দুর্নীতিপরায়ণ।

তাছাড়া ফোনে নানা ধরনের হুমকি, জীবননাশের আশঙ্কা সব তো আছেই। আন্দোলন স্থগিত করার জন্য অনেকেই অনেকভাবে বুঝিয়েছেন, তাদেরকে দিয়ে বোঝানো হয়েছে।

এই আন্দোলন আমাকে শিখিয়েছে কত ধরনের ষড়যন্ত্র করা যায় একটা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য। কিন্তু এটাও শিখেছি দিনশেষে সত্যের জয় চিরকাল হয়ে এসেছে এবং হবে। ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকলে সফলতা আসতে বাধ্য। আমরাও পেয়েছি, এতগুলো মানুষের ১২ দিনের কঠোর পরিশ্রমের ফসল ভিসির পদত্যাগ। একতাই যে শক্তি তা এখান থেকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। সবার সহযোগিতা ছাড়া এই আন্দোলনে সফল হওয়া অসম্ভব ছিল। ভাল-মন্দ দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে। যাইহোক, অন্যায় যেখানে দেখব, প্রতিবাদ করবো যতই বাধা আসুক।

পরিশেষে এটা বলতে পারি আমার বাইশ বছরের সেরা অর্জন এটা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ