একজন ধর্মনিরপেক্ষ শেখ হাসিনার প্রতি জন্মদিনের শুভেচ্ছা

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:২০

‘ওরা টোকাই কেন?’ নামে একটা বই ছিল আমাদের বাসায়। যখন বই সংগ্রহের নেশা তো দূরে থাক, বই পড়াও শুরু করিনি আমি- তখন থেকে। বইটা ছিল বাবার। বাদামী রঙের মলাটের পাতলা একটা বই, মলাটে একটি শুকনো টিংটিঙে ছেলের ছবি, সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বই এর লেখকের নাম শেখ হাসিনা। বইটা হারিয়ে গিয়েছিল,তখনো বই জমানোর বাতিক পেয়ে বসেনি আমাকে। কিন্তু এই বইটার কথা আমার বেশ মনে আছে, কারণ আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম “শেখ হাসিনা আবার বইও লেখেন!”

এই বইটি আমি পরে পড়েছিলাম। ‘ওরা টোকাই কেন?’ শেখ হাসিনা রচিত দ্বিতীয় বই ছিল, আর বাংলায় লেখা প্রথম। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা (বাংলা-ইংরেজি-ভাষণ-সমগ্র মিলিয়ে) প্রায় ২৪। কম-বেশি হতে পারে।

তিনি মূলত প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু অবশ্যই রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, উন্নয়ন ভাবনা ইত্যাদি। দুর্দান্ত রাজনীতিবীদ হিসেবে লেখার ভাষা, স্টাইলে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার সেই মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। প্রবন্ধ হিসেবে সুখপাঠ্য তো বটেই। ভালো বক্তৃতার মত, তিনি বেশ ভালো লেখেনও বলা চলে।

শেখ হাসিনা লেখক নন, রাজনীতিবীদ। কিন্তু রাজনীতিবীদদের লেখা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেহেতু প্রধাণত তিনি লেখক নন, তাই লেখকদের যে দায়বদ্ধতা থাকে, ওনার সেটা নেই। ওনার লেখা আমাদের কাছে বোনাস প্রাপ্তি। তবে ওনার দায়বদ্ধতা আরো বেশি, আরো বৃহৎ এবং আরো জটিল। এখন পর্যন্ত তিনি সফলতার সাথে একের পর এক সমস্যা মোকাবিলা করেছেন, সেগুলো ভুল না শুদ্ধ সেটা ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু অব্যর্থ- তাতো প্রমাণিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক- কোন রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই তো একা এক ব্যক্তির পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়। তাঁকে নির্ভর করতে হয় আমলাদের উপর, দলীয় নেতাকর্মীর উপর এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ জনতার মনোভাবের উপর। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে এই সবকটি নির্ভরতার জায়গাতেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সেগুলো সফলতার সাথে পেড়িয়ে আসবেন বলেই বিশ্বাস।

‘ওরা টোকাই কেন’ এর একটা প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। প্রবন্ধটির নাম ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম কার স্বার্থে?’। প্রবন্ধটি রচনাকালে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ যুক্ত হয়েছে এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মূল বইটির ডাউনলোড লিংক। আপাতত আমি এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরলাম-

” আমরা যদি বিশাস করি আল্লাহ পাকের ইশারা ছাড়া এই পৃথিবী চলে না তাহলে এর ভালোমন্দ সব তাঁরই সৃষ্টি। শেষ বিচারের ভার তো তিনিই নিয়েছেন, মানুষের উপর ছেড়ে দেননি।… কাজেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম ঘোষণার কোন অর্থ হয়না। …

এদেশে যেমন বিভিন্ন ভাষাভাষী রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ধর্মের নাগরিক রয়েছে। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, উপজাতীয়রা সব মিলিয়ে প্রায় আঠারো ধরণের উপজাতীয় এদেশে বাস করে। তাদের রীতিনীতিতে ভিন্নতা রয়েছে।

সংবিধান রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত। দেশ ও জাতির দিকনির্দেশনা কি হবে, সরকারি কাঠামো ও আইন, অর্থনৈতিক নীতিমালা, সামাজিক আইন-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল হচ্ছে এই সংবিধান। দেশের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী নাগরিকরা এ সংবিধানকে মেনে চলতে বাধ্য।

‘বিসমিল্লাহ’ লাগানোর পর এখন প্রশ্ন অন্য ধর্মাবলম্বীরা যখন পড়বেন তখন কি ঐ অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়বেন? তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, বিশ্বাস থেকে, তারা কি এটা মানসিক ভাবে গ্রহণ করতে পারবে? তবে কি সংবিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? সংবিধান কি কেবল একটা ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য প্রণীত হয়েছে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ? …

ধর্মগত সংখ্যালঘিষ্টদের জন্য এসব তথাকথিত বাংলাদেশীদের কি কোন দায় দায়িত্ব নেই? তারা কি এদেশের নাগরিক নয়? স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের মা বোন লাঞ্ছিত হয়েছে, এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও উপজাতীয়রা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তাদের আত্মত্যাগকে যেন কোনদিন ছোট করে দেখা না হয় সেকারণে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসেবে গৃহীত হয়েছে। …

রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পায়তারা আর কিছুই নয়, বাঙালি জাতির পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে শোষণের শাসন কায়েম রাখাটাই এদের প্রধান ষড়যন্ত্র।” (১৯৮৮)

ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে তিনি সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজনের বিরোধিতা করেছেন, রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, এরকম চিন্তা ভাবনা লালন করার পরেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ সড়াতে পারেননি, রাষ্ট্রধর্ম নামক উদ্ভট ব্যবস্থাটি বিলুপ্ত করতে পারেননি। কেননা, সামরিক শাসক এবং ধর্মব্যবসায়ীদের দীর্ঘ শাসনামলে জনগণের মধ্যে ধর্ম এতটাই উগ্র ভাবে প্রবিষ্ট হয়েছে যে, কোন দল বা নেতা এই কাজটি করতে গেলে সেটা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। অবস্থাটা এখন এমনি যে, যে কথা গুলো তিনি ১৯৮৮ সালে বলেছেন, সেই একই কথা এখন কেউ বললে সে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’-এ গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন!

তার পরেও যে ঝুঁকি নিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন- শুধু মাত্র এই কাজটির জন্য হলেও তিনি বাংলার ইতিহাসে পাকাপাকি একটা আসন দখল করে নিতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর মত বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্ববান মানুষও ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে এক ধরণের আপোষে আসতে বাধ্য হয়েছেন- এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট ট্রাজেডি। এবং এই ট্রাজেডির কোন ক্ষতিপূরণ নেই।

ইতিমধ্যে তিনি বাঙালি নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু পেড়িয়ে গেছেন। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।

জন্মদিনে শুভেচ্ছা থাকলো লেখক, রাজনীতিবীদ ও একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শেখ হাসিনার প্রতি।

[সর্বপ্রথম বাঙালীয়ানা'তে প্রকাশিত ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তারিখে]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ