শরণার্থী সংকট ও আমাদের ‘একাত্তরে’র অভিজ্ঞতা

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:৪৮

বিরাট সংখ্যক শরণার্থী যখন যে কোনো এলাকায় প্রবেশ করবে তখন সেই এলাকায় কতক সমস্যা দেখা দিবেই, কিন্তু এখানে যে বিষয়টা মাথায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে, শরণার্থীরা ভিক্টিম; প্রাণঘাতী সমস্যার উপস্থিতি ব্যতীত সে নিজের এলাকা ছেড়ে যেতো না। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক জেনোসাইডের পর বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যখন বাঙালিরা শরণার্থী হিসেবে প্রবেশ করলো, সেই অভিঘাতে ভারতেও বিবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। 

যেমন, নিউ ইয়র্কে টাইমসে মে মাসেই (অপারেশন সার্চলাইটের মাত্র দু মাসের মাথায়) সিডনি শানবার্গ একটি প্রতিবেদন লিখেন Pakistani Refugees’ Competition Angers Indian Poor শিরোনামে। পাকিস্তানি রিফিউজিদের প্রতিযোগীদের দরিদ্র ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাঙালি শরণার্থীদের অব্যাহত প্রবেশ কেবল ভারতের অর্থনীতিতেই নয়, বরং তার সামাজিক বুনিয়াদেও তীব্র চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ শরণার্থীদের উপস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ও মজুরির হার হ্রাস পেয়েছে। দরিদ্র মানুষদের ভেতরে ক্ষোভ তৈরি হতে পারে বলে ভারতের সরকার যে আশংকা করছিল তা বাস্তবেই ঘটছে। চাকরিতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, স্থানীয়দের মজুরি কমে গিয়েছে। খামারের শ্রমিকের জন্যে দৈনিক মজুরি ছিল তিন টাকা, এখন তা নেমে দুই টাকা, এমনকি কখনো এক টাকাও হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বলছিলেন যে, এরা (শরণার্থীরা) মজুরির জন্যে যে কোনো কিছুই গ্রহণ করতে পারবে, কারণ ক্যাম্পে তাদের বিনামূল্যে খাওয়ানো হচ্ছে, তাদের টাকা-পয়সাও লাগছে না। সেই সাথে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি যেমন দেখা দিয়েছে, তেমনি খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের বৃদ্ধি ঘটেছে।
 
শরণার্থী নিয়ে সিডনি শানবার্গের অনেকগুলো প্রতিবেদন নিউ ইয়র্ক টাইমসে তখন প্রকাশিত হয়। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে তেমনি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'World Bank Says Refugee Cost May Stunt Indian Development'। এই রিপোর্টে অবশ্য আশংকা করা যায় যে, এই শরণার্থীদের অধিকাংশ ভারতে স্থায়ী হয়ে যাবে এবং এদের পুনর্বাসন ও চাকরি বাকরির জন্যে প্রচুর বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন হবে। বাস্তবতা আমাদের পক্ষে থাকায় সেটি ঘটেনি। কেনো ঘটেনি কীভাবে ঘটেনি তা আমরা সবাই জানি। এসব বলার দরকার নেই।
 
শরণার্থীদের বিষয়ে কোনো তুলনা করা চলে না, কারণ শরণার্থীদের অবস্থা সব দেশেই মোটামুটি সমান। একাত্তরে আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি সেটা অনুধাবন করা জরুরী। আমরা শরণার্থী হওয়ার ফলে আশ্রয়দানকারী দেশ যে ধরণের সংকটে পড়েছিল সেটি আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরাও এখন একই সমস্যায় পড়েছি। রোহিঙ্গারা শরণার্থী। তারাও একটি জেনোসাইড থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের এই আসাটাও আমাদের এখানেও একইভাবে বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলবে। অবশ্যই সময়টা এখন একবিংশ শতাব্দী।তাই সমস্যাসমূহের নতুনত্ব থাকবে। কিন্তু যে বিষয়টা জোর দিয়ে বলতে যাচ্ছি তা হচ্ছে, শরণার্থী সমস্যা আর যাই হোক 'রেসিজম' চর্চা করে বন্ধ করা যাবে না। স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন বাস্তবতার অভিঘাতে একধরণের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু আমাদের মিডিয়াওয়ালাদের কল্যাণে এই ক্ষোভ 'ঘৃণা'র রাজনীতির পথ প্রশস্ত করছে। এই রেসিজম চর্চায় যুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারাবছর থরথর আবেগে কাজ করনে ওয়ালারাও। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন, অথচ আপনি শরণার্থী সমস্যা এড্রেস করতে গিয়ে রেসিজম চর্চা করতেছেন, এটা যে কতটা স্ববিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
বর্ণবাদ বা রেসিজম বা ঘৃণা উৎপাদন কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না, উল্টো পরিবেশ ও পরিস্থিতি সহিংস করে তুলতে এর কোনো জুড়ি নেই। আমাদের মিডিয়াওয়ালা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যখন রোহিঙ্গা সমস্যা এড্রেস করবেন তাদের এটা মনে রাখা জরুরী, রোহিঙ্গারা শরণার্থীরা ভিক্টিম। দয়া করে ভিক্টিম ব্লেইমিং করবেন না।
 
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ