'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী' তত্ত্বের আসল উদ্ভাবক কে?

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:০৮

জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা হত্যার অন্যতম কুশীলব ও মাষ্টার মাইন্ড (লরেন্স লিফসুজের মতে) আইয়ুব খানের মতো একই ভঙ্গিতে রাষ্ট্রপতি সায়েমকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে হ্যাঁ-না ভোট করেন রাজনৈতিক দলগুলি বিলুপ্তির মাধ্যমে।

পরে নিজের অবস্থানকে শক্ত করতে, নিজেকে সিভিল রুপ দিতে এবং নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকে পুনরায় রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব দেশগুলি বিরোধিতা করেছিল সে সব দেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি নতুন পররাষ্ট্রনীতি তৈরী করেন। প্রচারমাধ্যম সম্পূর্ণ করায়াত্ব করে নিজের ও সেনাবাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধিতে ব্যবহার করলেন।

তারপর একে একে স্বাধীন দেশে ৫২-র ভাষা আন্দোলনের উপর গড়ে ওঠা ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ’ বিরোধী ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, ৭১-এ পাকিস্থানী শাসকদের হৃদয়ে ভীত সঞ্চারিত প্রকম্পিত শ্লোগান ‘জয়-বাংলা’ বিরোধী ‘জিন্দাবাদ’ শ্লোগান, ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ নীতির বিরোধী ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধে’ এর চেতনা বিরোধী ‘পাকিস্তানী’ চেতনার ভাবধারাকে সামনে রেখে ম্যাকিয়াভেলী পদ্ধতিতে জাতিকে দু’ভাগ করে শাসন ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে শুরু করলেন।

বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ এবং সংবিধানেরও একটি মূলনীতি। জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রচারিত ‘বাংলাদেশী জাতীয়াবাদ’-এর সংগে ধর্মকে যুক্ত করে বাংলাদেশের মানুষকে স্পষ্টত: দু'ভাগ করেছিলেন। আজ জনাব তারেক রহমান বলেছেন, বাংলাদেশী জাতির পিতার জনক জেঃ জিয়াউর রহমান, যা বড়ই হাস্যকর। কারন বাংলাদেশী জাতি বলে কোন জাতিসত্তা পৃথিবীর মানচিত্রে নেই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের উদ্ভাবক হলেন সাংবাদিক খন্দকার আব্দুল হামিদ। আর সাংবাদিক হামিদের উদ্ভাবিত এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীর তাত্বিক কাঠামোকে জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দুকের জোরে সামরিক ফরমানের বলে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে ফেললেন।

১৯৭৬ সালে ফেব্রুয়ারীতে বাংলা একাডেমির আলোচনার এক প্রবন্ধে সাংবাদিক হামিদ প্রথম ‘বাংলাদেশী জাতীয়তা’ তত্বটি উপস্থাপন করেন। তিনি প্রবন্ধে বলেন, “আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তা’ বলাই এপ্রোপ্রিয়েট বা সঙ্গত। এই জাতির রয়েছে গৌরবময় আত্মপরিচয়, নাম-নিশানা, ওয়ারিশী-উত্তরাধিকার , ঐতিহ্য-ইতিহাস, ঈমান-আমান, বয়ান-লিসান, শিল্প- সাহিত্য, স্থাপত্য, সংগঠন ও সবকিছু। বাংলাদেশী জাতির আছে নিজেস্ব জীবনবোধ, জীবন ধারা, মনস্তাত্বিক গড়ন-গঠন, ভাবধারা। আছে সমষ্টিগত বিশেষ মনোভঙ্গি, আবেগ, আকাঙ্খা ও হৃদয়ানুভূতির বন্ধন। এদের হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে একই সুখ-দুঃখের সুর, একই আবেগ অনুভূতির ঝঙ্কার। এদের জীবনে ও মনোজগতে রয়েছে এমন অসংখ্য বৈশিষ্ট্য। এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলাভাষী ও ইসলাম অনুসারীদের থেকেও। ইসলামের কথা বললাম, এই জন্য যে, এদেশের ৮৫ শতাংশ লোকই মুসলিম।
এই বৈশিষ্ট্যগুলিই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তার উপাদান’। এগুলি বাকল নয়, আসল সারাংশ। আর এই সারাংশই আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার আসল শক্তি ও বুনিয়াদ।”( ডঃ মুনতাসির মামুন এর পাকিস্তানি জেনারেলদের মন: বাঙ্গালি-বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্টা-৩৪-৩৫)

এই তথ্য উপস্থাপনের পরও তিনি কি বলবেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী’ তত্বের উদ্ভাবক জেঃ জিয়া? বরং তাকে বলা যেতে পারে প্রয়োগকারী। জাতীর জনক বা পিতা তো অনেক দুরের জিনিস, যার অর্থও অনেক গভীর।

লেখক: লেখক ও গবেষক, অস্ট্রিয়া প্রবাসী