লাইন প্রথা, বাঙাল খেদা এবং মওলানা ভাসানী

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৫২

উপমহাদেশের রাজনৈতিক অন্তরীক্ষে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সাথে মওলানা ভাসানীর বিপ্লবী নীতির ফারাক সত্ত্বেও দু’জনের মিলনাত্মক দিকও রয়েছে। এসব নিয়ে গবেষকরা একদিন গবেষণা করবেন নিশ্চয়ই। আমি এখানে শিরোনাম বিষয়ক আলোচনায় একটি সাদৃশ্যের উল্লেখ করতে চাই।

মহাত্মা গান্ধী ১৮৯৩ সালে আইনজীবী হিসেবে সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা রাখেন এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর সেদেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। অপরদিকে মওলানা ভাসানী ১৯০৪ সালে সর্বপ্রথম আসাম গমন করলেও ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসামের নিপিড়িত বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় বিশেষভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। দু’জনেই নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বিভূঁইয়ের বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে রাজনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন করেন।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯২৯ সালে আসামের ঘাগমারীতে (বর্তমান হামিদাবাদ) জঙ্গল কেটে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। অবশ্য এর আগেই তিনি ১৯২৪ সালে ভাসানচরে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন থেকে নামের শেষে ‘ভাসানী’ উপাধী লাভ করেন। এখানকার নিপিড়িত বাঙালি আর দারিদ্রপীড়িত মানুষগুলো তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। ক্রমে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন অত্রাঞ্চলের নিপিড়িত মানুষের নয়নের মণি। এরপর থেকেই আসামে তার পরিচয় একজন দুর্বিনীত কৃষকনেতা ও আধ্যাত্মিক পীর হিসেবে। ইত্যবসরে মওলানা ভাসানী ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন এবং ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান ও অসহযোগ অন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এর পর থেকে তিনি অতি মাত্রায় আসাম আসক্ত না হলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অধিকতর ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে অনেকেই মনে করেন।

আসামের অধিকার বঞ্চিত বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানীর আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রাম বিবেচনায় ভারতীয় গবেষক বিমল জে. দেব ও দিলীপ কে. লাহিড়ী অভিমত ব্যক্ত করেন, “Bhasani, one of the greatest leaders Assam has ever produced” তৎকালীন সময়ে আসামের প্রজাসাধারণ জমা-জমি আবাদ করতে পারলেও জমির মালিকানা তাদের ছিল না। জমিদার-ভূস্বামীরা তাদের খেয়াল খুশি মতো প্রজাদের উচ্ছেদ করতে পারতো। এহেন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী ভাসান চরে আসাম-বাংলা প্রজা সম্মেলন আয়োজন করে সীমিত আকারে হলেও তাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এছাড়া আসামে গরু জবাই প্রথা চালুকরণ, ওজন পদ্ধতি সংস্কারসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আসামের বঞ্চিত মানুষ, বিশেষ করে বহিরাগত বাঙালিদের উপর নিপিড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি শুরু করেন আন্দোলন সংগ্রামের নতুন এক অধ্যায়; যা ‘লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন’ নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, আসাম সরকার ১৯২০ সালে এই কুখ্যাত ‘লাইন প্রথা’ প্রবর্তন করে। এই আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি বহিরাগত বাঙালি কৃষকদের সংগঠিত করে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন। সমিতি লাইন প্রথার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৩৭ সালে প্রথমবারের মতো আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েই তিনি পার্লামেন্টে ‘লাইন প্রথা বিরোধী’ বিল উত্থাপন করেন। ১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন না করায় তিনি কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৪০ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনের সাথে সাথে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হন। একই বছর তিনি লাহোর অধিবেশনেও যোগদান করেন। অধিবেশনের প্রস্তাবসমূহ তার মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করে এবং অবিলম্বে তিনি লাহোর থেকে প্রত্যাবর্তন করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত লেজিসলেটার্স কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে মুসলমানদের রাষ্ট্রসমূহের জায়গায় ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম প্রমূখ এই বিকৃতির বিরোধিতা করেন।

১৯৪১ সালের ৩০-৩১ ফেব্রুয়ারি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে মওলানা ভাসানী আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানান। ১৯৪২ সালের ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা-আসাম প্রজা সম্মেলনে তিনি সরকারকে হুশিয়ারী দিয়ে বলেন ৩১ মার্চ এর মধ্যে লাইন প্রথা বিলুপ্ত করা না হলে এপ্রিল থেকে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। এতে ভীত হয়ে সরকার পরবর্তী এক বছর মওলানা ভাসানীর সভা সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। তারপরও তিনি আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। তার চাপে পরে ১৯৪৩ সালের ২৪ আগস্ট এক সরকারী নির্দেশে লাইন প্রথাকে অনেকটা শিথিল করা হয়। ১৯৪৪ সালের মার্চে ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনের বক্তব্যে তিনি প্রদেশের অতিরিক্ত জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপজাতি, হিন্দু ভূমিহীন কৃষক ও অভিবাসী বাঙালীদের মধ্যে বন্টনের দাবী জানান। ১৯৪৪ সালের ৭-৮ এপ্রিল আসাম প্রাদেশিক মুুসলিম লীগের বড়পেটা অধিবেশনে আসামের মুক্তি আন্দোলনে সা’দ উল্লাহকে যুক্ত হবার আহবান জানান। সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে ‘অহোম জাতীয় মহাসভা’র উস্কানীতে আসামে ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই, বরপেটা, গৌহাটিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি উচ্ছেদ ও সরকারী নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন এবং ‘বাঙ্গাল খেদা বিরোধী’ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে আসামের সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র তিনটি আসন ছাড়া বাকি সবকটি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। মে ’৪৬ এর প্রথম থেকে তিনি বসতি উচ্ছেদ ও সরকারী নিপীড়নের প্রতিবাদে বরপেটায় আমরণ অনশন শুরু করেন। একই বছর ২৬ জুন বহিরাগত বাঙালিদের মধ্যে সংহতি জাগানোর লক্ষ্যে তিনি মঙ্গলদই মহাসম্মেলন আয়োজন করেন। সম্মেলন থেকে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এবং ৭ নভেম্বর থেকে ‘আইন অমান্য আন্দোলনে’র ডাক দেন। ১৯৪৭ সালের ৩-৪ মার্চ বাংলা-আসাম সম্মেলনে তিনি বাংলা এবং আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবী করেন। তিনি বলেন, “আসামের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে- আসুন আমরা সবাই এই মহান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করি। আমরা ইস্পিত স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সংগ্রাম বন্ধ করবো না।” ৫ মার্চ তিনি মুসলিম লীগের বিধান সভার সকল সদস্য ও নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় তথা সমগ্র আসামে ‘অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক’ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি প্রথমে আসামকেই স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ পালনের ঘোষণা করেন। সম্মেলনে নেতারা জানান যে, ওইদিন গোয়ালপাড়া স্বাধীন হবে এবং সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আসামের বাকি অঞ্চল মুক্ত হবে। ১০ মার্চ ঘোষিত ‘আসাম দিবসে’ তিনি ১৪৪ ধারার মধ্যেই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙালি কৃষকদের মরণপণ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। সভাস্থল থেকেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ২১ জুন জনগণের আন্দোলনের মুখে গৌহাটি জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি ৬-৭ জুলাই সিলেটের গণভোটের প্রচারণায় নেমে পরেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে ‘কুঠার মার্কা বাক্সে’ ভোট চান। এই গণভোটে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সমর্থন চান।

সিলেটের গণভোটে সফলতার পর মওলানা ভাসানী ধুরড়ী, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, মিলচর, গোয়ালপাড়া, নওগাঁ, কাছার প্রভৃতি জেলায় গণভোট চান। আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তকরণের জোড়ালো দাবী জানান। আগস্টে ফের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনও তিনি ভারতের কারাগারে বন্দি ছিলেন। অবশেষে সেপ্টেম্বরে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এই শর্তে যে, তিনি পাকিস্তানে চলে যাবেন। তাছাড়া মুক্তি পাবার পরে তিনি গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারেন এই আশঙ্কায় ভারত সরকার তাকে একটি জিপে করে আসাম সীমান্তে এনে পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে যায়। তিনি যেদিন আসাম ত্যাগ করেন সেদিন ধুবড়ীতে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেখানে তিনি তার ভক্ত, অনুসারী, সহকর্মীদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার আকুলতা জানিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বিদায় গ্রহন করেন। এরপর সীমান্ত থেকে সোজা তিনি টাঙ্গাইল চলে আসেন। সেই থেকে আসামের বাঙালিরা ভাসানীহারা।

 
তথ্য সূত্র: ১. The Line System in Assam : A Study of The Role of Maulana Bhasani,- Bimal J Dev & Dilip K Lahiri, ২. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- সৈয়দ আবুল মকসুদ, ৩. মজলুম জননেতা- মওলানা ভাসানী স্মারক সংকলন, ৪. আবদুল হামিদ খান ভাসানী- ম. ইনামুল হক, ৫. Wikipedia.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ