বঙ্গে সুফীবাদ ও একজন তাহেরী

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৪১

বঙ্গদেশে যখন সুফীদের আগমন ঘটে তখন সুফী মুরব্বীরা 'তরিকা'পন্থী হয়ে ওঠেননি। তাদের মানবতা তথা সাম্যের কথায় প্রান্তিক নিম্নবর্ণের সনাতন আর বৌদ্ধরা ব্যপকহারে ধর্মান্তরিত হয়।

এই ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে যুক্ত হয় পেশীশক্তি। সেই পেশীশক্তিতে বকতিয়ারদের ভূমিকা ছিল একথা অস্বীকার করিনা তবে দক্ষিণ ভারতীয় সেনদের 'ব্রাক্ষণ্যবাদে'র স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা আর পূর্বের পাল বংশীয় বৌদ্ধদের এই সেনদের উপর নেয়া ক্ষোভের 'সামাজিক ও রাজনৈতিক' প্রেক্ষাপটের একটি তীব্র প্রভাব ছিল। প্রায় তিনশো বছরের এই সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে সুসজ্জিত 'প্লাটফর্ম' তৈরী হওয়ায় সুফীদের কাজগুলো সহজ হয় এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

যদি ভেবে বসেন ঐ তিনশো বছর আগের 'তূর্কী- পারস্য' সুফীরা তাদের সেই প্রাক্তন ধারায় বলবত ছিল তাহলে সেটা ভুল বরং এই বঙ্গে এসে তারা এই বঙ্গের মত করেই তারা তাদের মতাদর্শের প্রচার চালিয়েছেন। যে কারনে আপনি এখনও দেখবেন এই সকল খানকা, দরগা শরীফগুলোতে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও বেশ ভালোই উপস্থিতি দেখা যায়।

এই নিম্নবর্ণের অথবা নিম্নবর্গের উপস্থিতির ক্রমধারা নিয়ে সুফী ইতিহাসে কোন গবেষণা হয়েছে কি না আমি জানি না কিন্তু গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। কারন বর্তমান সময়ের কিছু বইপড়ে দেখলাম এই নব্য লেখকেরা সুফীদের ইতিহাস লিখে থাকেন কিছু 'কল্পকাহিনী'র সমন্বয়ে এবং প্রারম্ভিক শুরুটা করেন ধর্মীয় বই পত্রের রেফারেন্সে! কিন্তু এই ধর্মীয় বইপত্রের আলোকে সুফীরা তাদের মতাদর্শের প্রচার চালিয়েছিলেন এটা বিশ্বাস করা যায় না কারন নিম্নবর্গের মানুষের ক্যারেক্টারের সাথে এই ধর্মীয় তত্ত্বকথা 'শোনা'র মত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সুফী গোষ্ঠী অবশ্যই এই দেশীয় কালচারের (সেটা হতে পারে তান্ত্রিক, হতে পারে বৌদ্ধ ধ্যান, হতে পারে নৃত্য) সাথে মিশে গিয়ে তাদের মতাদর্শ প্রচার করেছেন যার ফলে তাদের সফলতার জায়গাটা ছিল ঈর্ষনীয়।

ধরুন সেই ৯০০-১১০০ সালের দিকে পেট্রো ডলার নিয়ন্ত্রিত 'ওয়াহাবী- সালাফীবাদ' যদি এদেশে কেউ কায়েম করতে যেত সে কি আদৌ সেটাকে এই কাঁদামাটির ভূ কামিতেয়েম করতে পারতো?  আমিজানি না পারতো কি না ধারনা করা যায় সেটা সম্ভব হত না কারন আরবের ঐ 'রুক্ষ আর রুঢ়' পশুচারনের চরিত্রের সাথে এই অঞ্চলের 'উর্বর কৃষি ভিত্তিক' সমাজের চরিত্রগত পার্থক্য লক্ষণীয়।

আজ 'তেতুল তত্ত্ব' পাচ্ছি, আজ সংখ্যালঘুদের 'মালাউন' বলছি, জাহানারা ইমাম কে 'জাহান্নামের ইমাম' বলছি, শিয়াদের 'কাফির' না বললে পেটের ভাত হজম হয় না, বাউল-যারা জগতের কারো সাত-পাঁচে নেই তাদের বলছি 'শয়তান', মসজিদে-মাদ্রাসায় রেইপ করছি বাচ্চা ছেলে/মেয়েদের! এসকল কাজে ইসলামের অবমাননা হয় না, এসকল কাজে আইসিটি এক্টে মামলা করা যায় না। কারন এই 'হিংসা, বিদ্বেষ আর হিংস্রতার' এই মতবাদের মুলে আছে পেট্রোডলার, আছে সৌদী আরবের ওয়াহাবীতন্ত্র!

'একটু ঢেলে দেই', 'পরিবেশটা সুন্দর না', 'এক সাথে শামা গান গাই' এসব বললে আইসিটি এক্টে 'ধর্মের অবমাননার' কথা বলে মামলা করা যায় কারন এগুলোর পেছনে পেট্রোডলার বেইজ ওয়াহাবীবাদের 'সুশীতল' ছায়া নেই, এসকল শামাগান- মূর্শিদী গানের পেছনে আছে সুফীবাদী চিন্তা চেতনা!

ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে এদেশে ইসলামের বিস্তার এই গান গাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, একসাথে সম্মিলিত জিকির করা, নৃত্যের সাথে- দফের সাথে ইয়া আলী বলা সুফী র পন্থাহাত ধরে।

একজন মুফতী তাহেরীকে 'ধর্ম অবমাননা'র কোন দোষে দুষ্ট করা হয়েছে জানিনা। পত্রিকা পড়ে যেটা মনে হয়েছে সেই একই অপরাধে আপনি বাংলাদেশের ম্যাক্সিমাম 'মাইক ফাটাইন্ন্যা' হুজুরদেরকেও অপরাধী করতে পারেন।

লেখক: ছদ্মনামে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ