কম্বোডিয়া গণহত্যা: সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কেতাবি প্রয়োগ

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:৪৪

এক

১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কম্বোডিয়া জুড়ে চলে এক অদ্ভুত রকমের গণহত্যা। খেমার-রুজ (লাল খেমার) বাহিনীর নেতৃত্বে চলা এই গণহত্যার অন্যরকম কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। এই গণহত্যায় একটি নির্দিষ্ট জাতি অন্য আরেকটি জাতিকে হত্যা করেছিল ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়, বরং "নিজ জাতির মানুষেরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আর শহরের আমুদেপনায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে" তাই “এই নষ্ট জাতিকে শুদ্ধ করতে হবে” এই ধারনা থেকেই এই গণহত্যার সূত্রপাত। শুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসে পুঙ্গেবর কমিউনিস্ট খেমার-রুজ পার্টি। কম্বোডিয়ার ৯৫% মানুষই ছিল খেমার জনগোষ্ঠীর। বুঝতেই পারছেন এই খেমার জনগোষ্ঠীর ভেতরের লাল গ্রুপটি অর্থাৎ বিপ্লবী গ্রুপটিই স্বীয় জাতিগোষ্ঠীর ওপর চালিয়েছিল শতাব্দীর নির্মম এক গণহত্যা।

এই লাল খেমার পার্টির সুপ্রিম লিডারের নাম ছিল পল পট (বড়ভাই)। তা এই দেশপ্রেমিক বড়ভাইটি নিজের দেশের কলুষিত পশ্চিমা বার্গার চিপস খাওয়া জনগোষ্ঠীকে "শুদ্ধ" করার মহান ব্রত নিয়ে মাঠে নামেন। তিন বছরে মেরে সাফ করে ফেলেন বিশ লক্ষ শহুরে মানুষকে।

পচাত্তরে এপ্রিল মাসে ক্ষমতা দখল করলেও কম্বোডিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলারা কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে জোর তৎপরতা চালিয়ে আসছিল ষাটের দশকের গোড়া থেকেই। ১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিলে খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন দখল করার পর পল পট সরকার কম্বোডিয়ার নামকরণ করে “ডেমোক্রেটিক কাম্পূচিয়া”। তারপর সংস্কার আর শুদ্ধি করণের নামে নিজের জাতির ওপরে চালায় ভয়ঙ্কর এক হত্যাযজ্ঞ।

নমপেন ছিল কম্বোডিয়ার রাজধানী। মজার বিষয় হচ্ছে এই শহরকে ঘিরেই ছিল বিপ্লবীদের যত ক্ষোভ। খেমার রুজ গেরিলাদের চোখে নমপেনবাসী ছিল পাতি বুর্জোয়া। যারা কি না সবসময় ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে, মদ খায়, নাইট ক্লাবে নাচে, বার্গার খায়, পশ্চিমা পোশাক পরতে চায়, দেশের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র টান নেই, গ্রামে যেতে চায় না, গ্রামের মানুষের নিয়ে ভাবে না, এরা মহান বিপ্লবে অংশ নেয়নি। খেমার রুজরা নমপেন নগরের নামকরণ করে “The Great Whore on the Mekong” । একটা শহরের প্রতি কি ভয়াবহ রকম ক্ষোভ থাকলে এমন নাম দেওয়া যায়!

খেমার বাহিনী যে তৎপরতা শুরু করে তারা সেটাকে বলতে থাকে ‘মার্কসিস্ট-লেলিনিস্ট ট্রান্সফরমেশন প্রোগ্রাম’। যদিও এই মার্কসবাদ নিয়ে দুইটা কথা বলতেই হয়, একটু পেছনে ফিরে যেতে হয় ষাটের দশকে। খেমার-রুজ পার্টির গুরু পল পট ফ্রান্স গিয়েছিলেন পড়ালেখা শিখতে, সেখানেই তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ফ্রান্স থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে ফিরে পল পট কম্বোডিয়ায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং কম্বোডিয়ার বিদ্রোহী কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। তখনকার সময় কম্বোডিয়াতে আলাদা তিনটি প্রধান কমিউনিস্ট দলের অস্তিত্ব ছিল, যেগুলোকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত কমিউনিস্ট দল গড়ে তুলতে সক্ষম হন পল পট। তার গড়া এ ঐক্যবদ্ধ দলটিই ‘কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ক্যাম্পুচিয়া’ নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।

সংগঠিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করার পরে পল পটের খেমার রুজ বাহিনী তৎকালীন কম্বোডীয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা শুরু করে। তৎকালীন কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহানুক এক পর্যায়ে বামপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

সেসময় আত্মগোপনে থেকে এক পর্যায়ে ভিয়েতনাম চলে যান পল পট, সেখানে থাকতেই তিনি উত্তর ভিয়েতনাম সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। কম্বোডিয়ার তৎকালীন রাজতন্ত্র দমন ও শোষণমূলক হওয়াতে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট দলগুলো পল পটকে সমর্থন দিতে কুন্ঠিত হয়নি । বিপত্তি ঘটে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে। নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তার দলকে নিজের মত করে ঢেলে সাজান। শহুরে শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে গড়া প্রচলিত মার্ক্সিস্ট সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করে পল পট গ্রামের কৃষকশ্রেণীকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চিন্তা করেন। এই নতুন সমাজতান্ত্রিক ধারণাই কম্বোডিয়ার জনগণের জন্য উপযোগী বলে ঘোষণা করেন।

পল পটের এই নতুন খামখেয়ালী নীতি আর ধ্যান-ধারণার কারণে ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পল পট এবং তার দলের প্রতি বিরাগভাজন হয়, সরিয়ে নেয় সহযোগিতার হাত। তাই বলা যায় পল পট যখন মার্কসবাদের কথা বলছেন তা কি সহি মার্কসবাদ অর্থাৎ মার্কসের সহি ইন্টারপ্রিটেশন কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
এবার দেখা যাক রাজতন্ত্র ডিমোলিশ করে পল পট যে নতুন কমিউনিস্ট সরকার গঠন করলেন তার একেবারে শুরুর দিকে গৃহীত কিছু নীতি:

১) ধনী-গরিব মুক্ত শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের জন্য প্রথম দিনেই সমস্ত অর্থ (money) বাতিল ঘোষণা করা হয়।
২) সমস্ত প্রাইভেট ও পাবলিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ এই স্কুল গুলোই তো পশ্চিমা শিক্ষার আঁতুড়ঘর। এই স্কুল গুলোকে পরিণত করা হয় টর্চার সেল।
৩) সমস্ত বাজার, মার্কেট, কাপড়ের দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
৪) প্রাইভেট পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রাইভেট গাড়ি গুলো ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
৫) ব্যাক্তি সম্পত্তি অর্জন নিষিদ্ধ করা হয়। অর্জিত পূর্বের সম্পদ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
৬) ধর্মীয় স্থাপনা যেমন: প্যাগোডা, মসজিদ ও চার্চ নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্ম পালন অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়।
৭) অ-বিপ্লবি এন্টারটেইনমেন্ট, খেলাধূলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৮) পরিবার প্রথা বিলোপ করা হয়। পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা, মায়া মমতা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়।
৯) একসাথে ৩ জন একত্র হলে গ্রেফতার করা শুরু হয়, অনেক ক্ষেত্রে স্পটেই হত্যা করা হয়।

পরিবার প্রথা বিলোপ করে বয়সের ভিত্তিতে মানুষদের ক্লাস করা হয়। যেমন: ৭ থেকে ১৭ ‘এ’ গ্রুপ ১৮ থেকে ২৮ ‘বি’ গ্রুপ। তারপর এই গ্রুপ গুলোর ১০০ বা ২০০ জনকে একত্রিত করে গড়ে তোলা হয় co-opretive। এই co-opretive গুলোর সদস্যরা আর কখনোই নিজের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কখনো দেখা হয়ে গেলেও অপরিচিতদের মত আচরণ করতে হতো। মায়া-মমতার আভাস পাওয়া গেলেই হত্যা করা হতো। co-opretive গুলোকেই ঘোষণা করা হয় এক একটি পরিবার হিসেবে। এইসব পরিবারে কোন পিতা মাতা থাকে না। কারণ সবার পিতা মাতা একজনই। সেটা হল পার্টি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে co-opretive গুলোর সদস্যদের অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ রাখা হতো। সমস্ত সদস্যদের গুচ্ছপদ্ধতিতে বিয়ে দেয়া হতো। কারো মতামত প্রকাশের কোন প্রশ্নই ছিল না।

বিল্পবের প্রথম দিনেই অস্ত্রের মুখে আমেরিকা-আসক্ত পাতি বুর্জোয়া নমপেনবাসীকে নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের দিকে। রাস্তার ওপর হাজার হাজার নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হাঁটছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে পথেই মরতে থাকে অনেকে।

মাঝে মাঝে ট্রাক এসে থামতো রাস্তার পাশে। বেছে বেছে খেমার রুজ গেরিলারা লোকজনকে তুলে দিত সেই ট্রাকে। তারপর ট্রাকটা চলে যেতো কোন নির্যাতন কেন্দ্রের পথে যেখানে একদিন আগেও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের।

দুই

প্রিন্স নরদম সিহানুককে একরকম বলা যায় কম্বোডিয় জাতির পিতা। ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন কম্বোডিয়া আসে তার হাত ধরেই। কম্বোডিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় ১৯৫৩ সালে। তারপর থেকে চলতে থাকে প্রিন্স নরদম সিহানুকের শাসনামল।

ষাটের দশকের সূচনালগ্নে আমাদের বড়ভাই পল পট কম্বোডিয়ায় কমিউনিজমকে চাঙ্গা করে তুললেন, সবগুলো কমিউনিস্ট দল পল পটের নেতৃত্বে এক ছাতার তলায় এসে দাঁড়ালো। সারাদেশে পল পট এবং তার বাহিনীর ভালোই একটা জনপ্রিয়তা দেখা দিল। প্রিন্স সিহানুকের বিষয়টা পছন্দ হল না। উনি এই কমিউনিস্ট গ্রুপের নাম দিলেন খেমার-রুজ। রুজ শব্দের অর্থ লাল।

নামটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেওয়া হলেও ধীরে ধীরে এই নামটাই স্টাব্লিশড হয়ে গেলো। সিহানুক কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলেন। আমাদের বড়ভাই সাগরেদদের পালালেন ভিয়েতনাম। আগে তো বড়ভাইয়ের হাতে ছিল শুধু থিওরি। এবার আসলো অস্ত্র।

সিহানুক ভেবেছিলেন পল পট ভালা না, উনি পল পটকে তাড়িয়ে ভালা নিয়ে থাকবেন। কিন্তু সুখ বেশিদিন টিকলো না। ৭০-এর মার্চে মার্কিন মদদে কম্বোডিয়ায় একটা ক্যু হয়ে গেলো। মার্শাল লন নল প্রিন্স নরদম সিহানুককে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেন। এই সময় সিহানুক নিলেন চীনে রাজনৈতিক আশ্রয়।

ক্ষমতার লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় বিপাকে পড়লো বেচারা সাধারণ মানুষ। সিহানুক যে খুব ভালো শাসক ছিলেন ইতিহাস তেমনটা বলছে না, কিন্তু ফ্রান্সের হাত থেকে স্বাধীনতা বুঝে নেয়ার কান্ডারি হিসেবে কম্বোডীয় সাধারণ নাগরিকদের কাছে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল বৈ-কি।

যা হোক প্রিন্সকে উৎখাতকারী এই আমেরিকা সমর্থিত সরকারকে মানুষ কিছুতেই মেনে নিতে রাজি হল না। এমনিতেই ভিয়েতনামের সীমান্তে আমেরিকার নিয়মিত বোমাবাজিতে কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী মানুষজন নিয়মিত আহত-নিহত হচ্ছে। ফলে ১৯৭৫ সালে যখন খেমার-রুজেরা বিপ্লবের মাধ্যমে লন নলের সরকারকে উৎখাত করে তখন নমপেন শহরের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে পল পটের বাহিনীর বিপ্লবিদের অভিবাদন জানায় এবং শ্লোগান দিতে থাকে।

এই ভাগ্যাহত মানুষেরা কখনো হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি পরবর্তী কয়েকঘন্টার মধ্যে তাদের জীবনে কি বিভীষিকা নেমে আসছে।

ক্ষমতা দখলের চার ঘণ্টার মধ্যে বড়ভাইয়ের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা খেলা শুরু করে দিলেন। যেই মানুষেরা তাদের রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন, যেই মানুষেরা মার্কিন আগ্রাসনের হাত থেকে মুক্তি চাচ্ছিলেন, খেমার-রুজেরা সেই মানুষদের অশুদ্ধ, মার্কিন-প্রেমি, পাতি বুর্জুয়া শহুরে বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের গৃহ ত্যাগে বাধ্য করে। অস্ত্রের মুখে এক কাপড়ে পুরো শহরকে রাস্তায় বের করে নিয়ে এসে গ্রামের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। মালপত্র সহ দালানগুলো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।

সেই গল্পে সামনে আসছি...

শুরুতেই আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী সহ সরকারি কর্মকর্তাদের পাইকারি হত্যা করতে থাকে খেমার-রুজ বাহিনী। এরপর সামরিক বাহিনীতে যাদের অবাধ্য মনে হয়েছে তাদেরই কচুকাটা করা হয়েছে। এরপর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে একটি স্কুলের পথে। যেই স্কুলটির নাম সময়ের বিবর্তনে হয়েছিল S-21।

নমপেন শহরের সেই হাই স্কুলের নাম ছিল ‘টুঅল সাভি প্রেই’। ধবধবে সাদা রং করা পাঁচটিটি দালান মিলে ছিল তিন তলা স্কুলটি। এই স্কুলে পরবর্তী চার বছর ধরে প্রায় ২০,০০০ মানুষকে বন্দি করে নির্যাতন করা হয়েছিল। স্কুলের নতুন নাম দেওয়া হল Security Prison 21 (S-21) । স্কুলটার ক্লাসরুমগুলিই হয়ে ওঠে এক একটি টর্চার চেম্বার। গড়ে প্রতিদিন ১০০০ থেকে ১৫০০ বন্দি আনা হতো এই কেন্দ্রে। এখানে যারা মারা যেতো, তারা বেঁচে যেতো, আর যারা বেঁচে থাকত-তাদের পাঠানো হতো বধ্যভূমিতে হত্যা করার জন্য। আরও নির্মম মৃত্যু অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য।

S-21 টর্চার সেলে নির্যাতনের কিছু প্রক্রিয়া:

১) ইলেকট্রিক শক দেওয়া।
২) লোহার তার গরম করে শরীরের নানা জায়গায় ঢোকানো।
৩) সিলিং থেকে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা
৪) মাথায় প্লাস্টিকের ব্যাগ ভরে নিঃশ্বাস আটকে রাখা।
৫) ধারালো ছোরা দিয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফালিফালি করে কাটা।
৬) নখ তুলে ফেলা এবং নখের ক্ষতে অ্যালকোলহল ঢালা।
৭) মাথা পানিতে চুবিয়ে রাখা হত
৮) মেয়েদের ধর্ষন করা।

বধ্যভূমির কথা বলছিলাম। চোয়েয়ুঙ্গ- এক ছিল তেমন একটা বধ্যভুমি। ১৯৮০ সালের পর এখানে একটি গর্ত খুঁড়ে প্রায় সাড়ে আট হাজার মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতরা সবাই ছিল S-21 ফেরত।

বন্দিরা দিয়ে প্রথমে মাঠের ওপর বড় গর্ত খোঁড়ানো হতো। অনেকে ভাবছেন এরপর নিশ্চয়ই বন্দিদের লাইন ধরে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা হতো? কিন্ত না, পাতি বুর্জুয়াদের জন্য গুলি নষ্ট করতো না খেমার-রুজেরা। তাদের পিটিয়ে, ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে, যে কোন কোনভাবে মেরে কিংবা আধমরা অবস্থায় মাটিচাপা দিয়ে দিতো।

এই সমস্ত বন্দিদের বাচ্চাদের মারা হতো গাছে আছাড় দিয়ে। একজন দুজনকে না, সবাইকে। কম্বোডিয়ার একটি গণকবরে একসাথে ৫০০০ শিশুর মাথার খুলি পাওয়া যায়, যেগুলো ছিল নানা দিক দিয়ে আঁকাবাঁকা ভাবে ফাটা।

এতো গেলো বুদ্ধিজীবী, সন্দেহভাজন লোকজনের গল্পকথা। যেই মানুষদের হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এবার তাদের দিকে ফিরে যাওয়া যাক।

খেমার রুজরা বিপ্লবের আগ থেকেই একটি চতুর্বার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল কৃষি-বিপ্লব সংগঠনের। খাদ্যই তাদের মুক্তি দেবে। অথচ ততদিনে পৃথিবী শিল্পায়নের পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। কৃষিকে এগ্রেসিভভাবে কেন্দ্রে রাখায় শিল্পের শ্রমিকেরাও বিপ্লবিদের শত্রু হয়ে গেলো।

খেমার রুজদের পরিকল্পনা ছিল কম্বোডিয়া বছরে তাদের জমির প্রতি হেক্টর থেকে ৩ টন চাল উৎপাদন করবে।

এই লক্ষ্য পূরণের জন্য, মানুষজনকে সারা বছর ধরেই কৃষিকাজ করতে হতো। সমস্ত অঞ্চল কৃষিকাজের উপযুক্তও ছিল না। এখানে বলে নেওয়া ভালো 'প্রতি হেক্টর' বলতে 'প্রতি হেক্টর কৃষি জমি' বোঝানো হয়নি।, বোঝানো হয়েছে সবরকম জমিকে। এই জমিতে যেমন পাহাড় পর্বত ছিল তেমন ছিল জলাশয় কিংবা চাষের অযোগ্য জমিও ছিল।

তাতে কি? পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই হবে। দেখা গেলো অধিকাংশ অঞ্চলে খেমার সাধারণ মানুষজনকে দিনে ১২ ঘন্টা করে কাজ করতে হচ্ছে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য। দেওয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রামের সুযোগ।

চার বছর পর দেখা গেলো দেশজুড়ে ২০,০০০ বধ্যভূমিকে হত্যাকান্ডের বাইরেও অতি পরিশ্রমে আর ক্ষুধার যন্ত্রণায়, পর্যাপ্ত সাস্থ্য সেবা আর চিকিৎসাসেবার অভাবে শহুরে ৫ লক্ষ মানুষ নির্মমভাবে মারা গেলো।

এইবার বিপ্লবিরা দেশটির ১৪ থেকে ১৭ বছরের ছেলে-মেয়েদের খুনি হিসেবে গড়ে তোলার এক মাষ্টার প্ল্যান হাতে নেয়। কম বয়েসের এইসব ছেলে মেয়েদের মধ্যে যারা তাদের দলে ভিড়ে মানুষ হত্যার কাজ করতে রাজি হয়নি তাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার করা হতো।

ফলে অল্প সময়ের মাঝেই তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ হয়ে ওঠে ভয়ংকর খুনি। কম্বোডিয়া হত্যাকান্ডের ছবি দেখলে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাশের পাশে দাঁড়ানো খুনিটি একজন কিশোর।

এদেরকে নিয়মিত ঘরোয়া মদ খেতে বাধ্য করা হতো। নিয়মিত ডাবের পানির সাথে মিশিয়ে মানুষের রক্তপানে অভ্যস্ত করে তোলা হতে থাকে। পল পট এমন এক ফিলসফির জন্ম দেন যে, ‘দূষিত’ মানুষের রক্ত নিয়মিত পান করে তারা ‘বিশুদ্ধ’ মানুষে পরিণত হতে পারবে।

পুরো কম্বোডিয়া জুড়ে এই ‘দূষিত’ আর ‘বিশুদ্ধ’ খেলাটা চলতে থাকে। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যা করার কারণ হিসেবে খেমার-রুজদের দাবী ছিল ‘ওরা দূষিত’।

বিপ্লবের আগের সরকার ছিল ‘দূষিত’, সেই সরকারের আমলে যারা সরকারি চাকরি করেছে তারও ছিল ‘দূষিত’, নমপেন শহর ছিল ‘দূষিত’, সেই শহরের প্রতিটা মানুষ ছিল 'দূষিত', যারা বার্গার খায় তারা ‘দূষিত’, যারা জিন্স পরে তারাও 'দূষিত', যারা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেনি তারা ‘দূষিত’, যারা শিল্পশ্রমিক তারাও ‘দূষিত’ শেষমেশ যারা সবকিছু মেনে নেওয়ার পরেও খেমার-রুজদের কথা মত যথেচ্ছ হত্যাকান্ড করতে রাজি হয়নি তারাও ‘দূষিত’।

চার বছর পর দেখা গেলো সত্তুর লক্ষ মানুষের দেশে ত্রিশ লক্ষ মানুষ খুন হয়ে গেছে। হত্যাকান্ডের স্বীকার অধিকাংশ মানুষগুলোর অপরাধ ছিল তারা শহরের বাসিন্দা, তারা শিক্ষিত…


তিন

নমপেন শহরের কথা বারবার বলছি, তবে কম্বোডিয়ার অন্যান্য শহরগুলোর অবস্থাও ছিল কমবেশি একই রকম। সবখান থেকেই মানুষকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের দিকে। গ্রামে ধান চাষ করার জন্য কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ সবাইকেই দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। ২৫ বছর বয়সের একজন মানুষকে যেই পরিমাণ পরিশ্রম করতে হতো ১০ বছরের শিশু কিংবা ৬৫ বছরের বৃদ্ধকেও ঠিক একই পরিমাণ পরিশ্রম করতে হতো। শিশুর বয়স ছয় বছরের বেশী হলেই তাকে বাবা-মার কমিউন থেকে বের করে নিয়ে আসা হতো।

কমিউনের সদস্যরা সব সময় গোপন দালালের নজরদারির মধ্যে থাকতো। নাগরিকদের মধ্যে যারা ‘অন্যরকম’ আচরণ করত, তাদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের অভিযোগ বা তাদের প্রতিবাদের ফলাফল ছিল “সন্দেহ ভাজন ব্যাক্তি” এবং “বিরোধী পক্ষ” হিসেবে তালিকা ভুক্ত হওয়া এবং খতম হওয়ার জন্য চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। এই ‘অন্যরকম’ আচরণগুলো কি কি বোঝা দরকার।
১) মুক্তভাবে ভাবার, হাসি, কান্না এমন কি আপন জনের জন্য শোক করা ছিল অন্যরকম আচরণ।
২) যে কোন ধরণেরর হতাশা, করুণা বোধ, অনুরোধ এসবই ছিল অন্যরকম আচরণ।
৩) যে কোন নির্দেশে অসন্তুষ্টি প্রকাশ ছিল অন্যরকম আচরণ। 
৪) যে কোন প্রকার দুঃখ, কাতরতা এবং অসহিষ্ণুতা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল।

কমিউনের অভ্যন্তরে সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন গুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হতে থাকে। বিবাহিত দম্পতিকে পরস্পর থেকে আলাদা করে দেয়া হয়, শিশুদের তাদের বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাঝে যে কোন ধরনের যোগাযোগ ও আদান প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়। মানুষের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে এমন সব মাধ্যম; যেমন: বাজার, টেলিফোন, পোস্ট অফিস এর মত সবধরনের যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়। একই পরিবারের মানুষদেরপরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখতে দেয়া হতো না। বিপদে সাহায্যে এগিয়ে আসতে দেয়া হতো না। সমবেদনা জানাতে কিংবা মৃতের জন্য কোন প্রকার শোক করতে পর্যন্ত দেওয়া হতো না। ফলে লোকজন অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসতে ভীত হয়ে পড়ত। নিজের জীবন রক্ষা করতে পারলেই সবাই বাঁচে আরকি।

যাদের পিতামাতাকে ইতোমধ্যে হত্যা করা হয়েছিল সেই সব অসহায় সন্তান সন্ততিদের সাহায্য সহযোগিতায়ও ছিল নিষিদ্ধ। এসব শিশুরা সবাই তাই ছিন্নমূল জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। এধরনের শিশুদের প্রায়ই ভিক্ষাবৃত্তির অভিযোগে ধরে প্রচণ্ড মারধরের পর প্রায়ই মেরে ফেলা হতো।

পরিশ্রম, খোলা জায়গায় কাজ করা আর অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে অপুষ্টির কারণে নানান রোগের বিস্তার ঘটতে থাকে কিন্তু সেসবের মোকাবেলায় নূন্যতম চিকিৎসা সেবাও ছিল না। পল পট শাসনামলের শেষে দেখা যায় সেখানকার ৬৮৩ জন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ৬৯ জন বেঁচে ছিলেন। বাদবাকি সব চিকিৎসকদের শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল করা হয়। সেই সময় কেবল ম্যালেরিয়া এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়াকে অসুস্থতা হিসেবে গণ্যকরা হতো। অন্যান্য অসুস্থদের অলসতা বলে দোষারোপ করা হতো। গর্ভাবস্থাকে কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাবার অজুহাত হিসেবে মনে করা হতো এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের কম পরিমাণে খাবার দেয়া হতো।

খেমার রুজদের নিয়ম কানুনের যে কোন প্রকার বরখেলাপে ভয়ানক শাস্তি প্রদান করা হতো। এক্ষেত্রে কেবল দুই ধরনের শাস্তির বিধানই লক্ষ্য করা যায়:

১) প্রত্যহিক কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়া 
২) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা

পল পট আমলে কম্বোডিয়ার ২৮০০টি প্যাগোডা ধ্বংস করা হয়। অনেক প্যাগোডাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং বন্দীশালায় রূপান্তর করা হয়। এই তাণ্ডবের কারণে ৮২ হাজার বুদ্ধ ভিক্ষুর মধ্যে ৯০% নিহত হয়। দেশের ১১৪টি মসজিদের মধ্যে সবগুলোকে ভেঙ্গে দেয়া হয়। এগুলোর কোন কোনটিকে শূকর খানায় রূপান্তরিত করা হয়। মুসলমান চ্যাম গোষ্ঠীকে সমূলে বিলুপ্ত করা হয়। দেশটির মুসলিম অধ্যুষিত কম্পোং চ্যাম প্রদেশে কম্পোং জিম জেলার মোট পাঁচটি গ্রামের সর্বমোট মুসলমান ছিল বিশ হাজারেরও কিছু বেশী। দের একজনও গণহত্যার পর বেঁচে ছিলনা। অন্যদিকে দেশটির কুং নিয়াস জেলার মোট সাতটি গ্রামে প্রায় বিশ হাজারে জনের মধ্যে প্রাণে রক্ষাপায় মাত্র চারজন।

দেশটির বুদ্ধিজীবীদের সমূলে হত্যা করা হয়: ডাক্তার, চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, এবং পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের দেশটির শাসন ব্যবস্থার স্থায়ী শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এসময় বিশ্বাস করা হতো যে এদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা যদি প্রযুক্তির উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে রাষ্ট্র যন্ত্রের মাঝে শত্রু পক্ষের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে; এতে করে বিপ্লবের ক্ষতি হবে। চশমা পরিহিত, পড়ুয়া, বিদেশি ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ, ভদ্র-সাজ পোশাকের যে কাউকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিরূপণ করা হতো।

এই নীতির কারণে ৭২৫ জন অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের মধ্যে বেঁচে থাকা মাত্র ৫০ জনের মাধ্যমে দেশটির উচ্চশিক্ষা পুনঃস্থাপিত হয়। এগার হাজার ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জন প্রাণে রক্ষা পায়। ২৩০০ জন মাধ্যমিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ২০৭ জন অবশিষ্ট থাকে। ১০৬,০০০ জন মাধ্যমিক ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৫৩০০ জন প্রাণে রক্ষায় সক্ষম হয়। ২১,৩১১ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মধ্যে ২৭৯৩ জন পানে বাঁচতে সক্ষম হন। প্রাথমিক স্কুল গুলোর মোট ছাত্র সংখ্যা ছিল ৯৯১,০০০ জন। যাদের মধ্য থেকে মাত্র ৩২২,৩৭৯ টি শিশু বেঁচে থাকে। দেশটির ১,৩৪১ জন শিল্প কর্মীদের মাত্র ১২১ জন মানে টিকে থাকে। তিনশত জন সাংবাদিক এবং ছাপাখানা কর্মীর পাঁচজন মাত্র রেহাই পায়।

বিদেশের মাটিতে অবস্থান করা দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবী কম্বোডিয়াদের দেশের পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে দেশে ফেরার আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রায় একহাজার প্রবাসী জনতা সরকারের এই আহবানে সাড়া দিয়ে দেশে ফিরে আসে। তাদের সবাইকে বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেয়া হয়। এবং এক পর্যায়ে এদের সবাইকেই হত্যা করা হয়।

নমপেন থিয়েটার প্রাদেশিক কেন্দ্র গুলোর থিয়েটার, যাদুঘর, সিনেমা হলের মতো শিল্প, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সমূহ গুড়িয়ে দেয়া হয়। টেলিভিশন আর খেলার মাঠের চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। একইভাবে চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়, নাটক ও সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি সমূহের অস্তিত্বও বিলোপ সাধন করা হয়। বাদ্যযন্ত্র, ঐতিহ্যবাহী মঞ্চের পোশাক এবং শিল্প বিষয়ক যে কোন প্রকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। স্কুল ঘরগুলোকে গুড়িয়ে দেয়া হয় নতুবা কারাগার, পীড়ন কেন্দ্র অথবা গম আর সারের গুদামে রূপান্তরিত করা হয়। লাইব্রেরি, শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হতে পাওয়া সকল বই এবং যাদুঘরে প্রাপ্ত প্রদর্শনীয় সকল বস্তু আর সংগ্রহ ধ্বংস করে ফেলা হয়। এবং প্রাচীন অমূল্য সব শিল্প সংগ্রহ ধ্বংস করা হয়।

এখানে আগ্নেয় অস্র, নিড়ানি, ধাতব দণ্ড দিয়ে, জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলে, আগুনে দগ্ধকরে, কুমিরের খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করে ইত্যাদি বহুবিধ উপায়ে নিরীহ জনগণকে হত্যা করা হয়। মানুষদের মুখে নীল প্লাস্টিকের ব্যাগ গুজে দম আটকে, অথবা মাটি খোড়ার বেলচা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হতো। গোলা-বারুদের সরবরাহ কম ছিল বলে তাদের হত্যাযজ্ঞের প্রধান পন্থা ছিল পানিতে ডুবিয়ে বা কুপিয়ে হত্যা।

পল পটের শাসনামলে পুরো কম্বোডিয়াতে সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য গণকবর ও বদ্ধভূমি। সে দেশে এখন পর্যন্ত সেসময়ের ২০,০০০ গণকবরের সন্ধান মিলেছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, খেমাররুজদের শাসনামলে মৃতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৭ লক্ষ থেকে ২২ লক্ষ, যার প্রায় অর্ধেকই খেমাররুজ সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল।

পল পট তার দেশের মানুষদের মধ্যে ভিয়েতনাম বিরোধী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার শক্ত ভিত গড়েছিলেন। কম্বোডিয়ার সকল দুর্ভোগের জন্য তিনি ভিয়েতনামের বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করতেন।

সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম ১৯৭৯ সালের দিকে কম্বোডিয়া আক্রমণ করে। ভিয়েতনামী বাহিনী সেসময় খেমাররুজদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জঙ্গলের ক্যাম্পে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করে। পল পট পালিয়ে যান এবং আত্মগোপন করেন। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ কম্বোডিয়া থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এরই সাথে খেমাররুজদের ভয়াবহ শাসনামলের সমাপ্তি হয়।

ভিয়েতনামী সেনাবাহিনীর আক্রমণে যদিও খেমাররুজদের মূল বাহিনী গুড়িয়ে যায় ১৯৮০ সালের দিকেই, তবু তারা কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। এরপরও ১৫ বছর ধরে কম্বোডিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের দুর্গম বনে খেমাররুজদের অবশিষ্টাংশকে পুনর্গঠিত করে নেতৃত্ব দেন তাদের নেতা পল পট।

নব্বইযের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কম্বোডিয়ার নবগঠিত সরকার খেমাররুজদের নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে (যদিও সেই সরকার প্রধান ছিল পল পটের একসময়ের ডান হাত)। ধীরে ধীরে খেমাররুজদের সংখ্যা আরও কমতে থাকে এবং পল পটের কাছের বন্ধুদের অনেকেই মারা যায় অথবা আত্মসমর্পণ করে। ১৯৯৬ সালে পল পট খেমাররুজদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং নিজের সৈন্যদের দ্বারাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কম্বোডিয়ার একটি আদালত তার অনুপস্থিতিতেই তার মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়। অন্যদিকে খেমাররুজদের আরেকটি আদালত তার লোকদেখানো বিচার করে এবং তাকে যাবজ্জীবন গৃহবন্দীত্বের সাজা প্রদান করে।

মূলত ৫১ই জুলাই ১৯৭৯, কম্বোডিয়ার পিপলস রেভ্যুলেশনারি কাউন্সিল কর্তৃক জারি করা এক আদেশ বলে পিপলস রেভ্যুলেশনারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। উক্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্তকৃত দলিলাদি পড়লে নমপেনের জনগণের বিরুদ্ধে শাসক গোষ্ঠীর প্রতিহিংসার মাত্রা অনুমান করা যেতে পারে।

নমপেন বিপ্লবী জনতার ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণ ও সত্যাসত্য বিশ্লেষণে পলপট-ইংসারে দলের গণহত্যযজ্ঞ সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ১৯ আগস্ট ১৯৭৯ এ বিপ্লবী জনতার আদালত (People’s Revolutionary Tribunal) দোষীদের বিচারের রায় ঘোষণা করে। কম্বোডিয়ার পিপল’স রেভ্যুলেশনারি ট্রাইব্যুনাল অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত ও একই সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ঘোষণা করে।

১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় পরিচালিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মেনে খেমাররুজরা পল পটকে কম্বোডিয়ান সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। সম্ভবত এ কারণেই ৭২ বছর বয়সী খেমাররুজদের পরাজিত, বন্দী নেতা পল পট আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। মৃত্যুর পর কম্বোডিয়ার সরকার তার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করতে চাইলে খেমাররুজরা তাতে বাধা দেয়। তারা পল পটের মৃতদেহ পুড়িয়ে সে ছাই ছড়িয়ে দেয় উত্তর কম্বোডিয়ার বনাঞ্চলে, যেখানে প্রায় ২০ বছর ধরে পল পট তার বাহিনীকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয় কুখ্যাত এক স্বৈরশাসকের জীবনের আখ্যান।

জাতিসংঘের সহায়তায় কম্বোডিয়ার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে খেমার রুজ নেতাদের বিচার করার জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেই ট্রাইব্যুনাল পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে, যাদের দু’জন (লেং সিরি ও লেং থিরিত) বিচার চলাকালীন সময়ে মারা যায়, বাকিদেরকে (কাং কেক লিউ, নুওন ছেয়া, ও খিউ সাম্ফান) দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই বিচার এখনো চলছে।

কম্বোডিয়ার গনহত্যা আমাদের শিক্ষা দেয় অন্ধ আদর্শ মানুষকে ভয়াবহ গণহত্যাকারি করে তুলতে পারে। পল পট এবং তার খেমার রুজ বাহিনী এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ…

(ঋণস্বীকার: A HISTORY OF DEMOCRATIC KAMPUCHEA (1975-1979) বইটি এই লেখার মূল উপাদান (ইংরেজি ভালো না পারা আমি এই বইটির ইংরেজি সহজে বুঝে পড়তে পেরেছি), এই লেখার প্রথম দুই পর্বের উপাত্তের উৎস এই বইটি। Philip Short এর বিখ্যাত Pol Pot: Anatomy of a Nightmare এবং উইকি পিডিয়ার Combodia Jenocide পাতা এবং Pol Pot পাতা ব্যাবহার করেছি। ইরফানুর রহমান রাফিনের ‘আদর্শবাদের অন্ধকারঃ খেমার রুজ ও গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’(bit .ly/2PyVI5V) লেখাটির নানা অংশ কাজে লাগিয়েছি। শেষ লাইনটিও তার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। বাংলা ভাষায় কম্বোডিয়া গণহত্যা নিয়ে প্রথম লেখেন সম্ভবত প্রয়াত ব্লগার ইমন জুবায়ের। তার লেখা ‘কম্বোডিয়ার গনহত্যা: খেমার রুজ শাসনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়’ (somewhereinblog .net/blog/benqt60/28872635 ) থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম। সামহয়ার ইন ব্লগের সোহরাব সুমনের লেখা ‘কম্বোডিয়ায় গণহত্যা’ (somewhereinblog .net/blog/lights007/29863609) লেখাটি বেশ ভালো তৃতীয় পর্বে এই লেখাটি থেকে বেশ কিছু অংশ সরাসরি তুলে দিয়েছি। রোয়ার বাংলায় ইতি মল্লিক লিখেছেন খেমাররুজ নেতা পল পট: নৃশংস এক স্বৈরশাসকের আখ্যান (roar .media/bangla/main/history/khmer-rouge-the-autocrat-of-cambodia/) এই লেখাটি থেকেও যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি।)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ