স্বাধীনচেতা 'বেলুচিস্তান' যেন পাকিস্তানের 'কাশ্মীর'

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১৭:২৮

বেলুচিস্তান দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম এই প্রদেশটির আয়তন ৩,৪৭,১৯০ বর্গকিলোমিটার এবং এটি পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৮% গঠন করেছে। বেলুচি জাতির লোকদের নামে অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে। এর পশ্চিমে ইরান (ইরানি বেলুচিস্তান), উত্তরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল, পূর্বে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশ এবং দক্ষিণে আরব সাগর।

বেলুচিস্তানের পতাকা

বেলুচিস্তানের পতাকা

বেলুচিস্তানের রাজধানী কুয়েটাকে বলা হয় পাকিস্তানের ‘ফলের বাগান’ আর এতে উৎপন্ন হওয়া শুকনো ফল সারা বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ। প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার এই প্রদেশটি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আজ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও তরুণদের সম্মুখভাগের নেতৃত্বে বিদ্রোহে ফুঁসে উঠেছে পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের আশায়। ঠিক যেমনটা একসময়ের পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ফুঁসে উঠেছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

বেলুচিস্তানের উৎপত্তি ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে। যেইসময়ে ম্যাসেডোনিয়ার রাজা মহাবীর আলেকজান্ডার প্রদেশটি জয় করেন। এর পরবর্তী সময়কালে প্রদেশটি কখনো পারস্য আবার কখনো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসকদের অধীনে ছিলো প্রদেশটি। ৭ম শতকে আরব শাসকেরা বেলুচিস্তান দখল করে। ১৬৬৬ সালের দিকে আফগান শাসকদের অধীনে চলে যায় এবং গোড়াপত্তন হয় বেলুচিস্তানের।

বেলুচিস্তানের সীলমোহর

বেলুচিস্তানের সীলমোহর

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ৪টি করদ প্রদেশের মধ্যে তিনটি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বেলুচিস্তান প্রদেশের শাসক মির আহমেদ ইয়ার খান (খান সাহেব) নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। এই কালাট প্রদেশই হলো আজকের বেলুচিস্তান। পরবর্তীতে এই বেলুচিস্তান নিয়ে বহু সমঝোতার হলেও কোন সমঝোতায় না যাওয়ায় ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কালাট প্রদেশকে নিজেদের অধীনস্ত হিসেবে ঘোষণা করে সামরিক অভিযান চালায়। এরপর থেকে বেলুচিস্তান আজও স্বাধীনতার আশায় রয়েছে।

বেলুচিস্তান রাজ্য পাকিস্তানের জ্বালানী সম্পদের সমৃদ্ধ মজুদ ক্ষেত্র, পারমাণবিক অস্ত্রের বড় মজুদ এবং পরীক্ষাগার হিসেবে খ্যাত। তাছাড়া চীনের অর্থায়নে এখানে নির্মিত হয়েছে গোয়াদর বন্দর যা বাণিজ্য করিডর হিসেবে ব্যাবহার করবে চীন। পুরো আরব সাগরে চীনের আধিপত্য নিশ্চিত করতে এই বন্দরের গুরত্ব ছিলো অপরিসীম।

২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষনাও দিয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এত বড় বিনিয়োগ ইতিপূর্বে কোন রাষ্ট্র করেনি। এই বিনিয়োগের ফলে বেলুচিস্তানে গড়ে উঠবে বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাইপলাইন সংযুক্তকরণসহ বহু অবকাঠামোগত কাজকর্ম।

এদিকে বেলুচিস্তান জাতি হিসেবে স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং অদম্য সাহসিকতার জন্য বহু আগে হতেই পরিচিত। যার কারণে বহুবার অধীনস্ত হলেও কেউই পুরোপুরি বেলুচিস্তানকে শাসন করতে পারেনি। দ্বিদশক শতাব্দীর শুরু থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীতে সোচ্চার হয় তারা বেলকুচিস্তান। এরইপ্রেক্ষিতে ১৯৩১ সালে গঠিত হয় ‘আঞ্জুমান ই ইত্তেহাদ ই বেলুচিস্থান’ নামের স্বাধীনতাকামী জিহাদী সংগঠন যার পরবর্তী নাম হয় ‘কালাট স্টেট ন্যাশনাল পার্টি”। কিন্তু পরবর্তীতে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে তৎকালীন পাক সরকার।

১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান স্বাধীন হয় তখন বেলুচিস্তান সম্পর্কে ধুম্রজাল থেকেই যায়। স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় সংগঠিত হয় প্রথম বিদ্রোহ যখন ১৯৪৮ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে খান সাহেবকে গ্রেপ্তার করে পাক সেনা। তার অবর্তমানে ভাই প্রিন্স আবদুল করিম দায়িত্ব গ্রহণ করে আন্দোলন সচল রাখে এবং গঠন করে ‘বেলুচ ন্যাশনাল লিবারেশন কমিটি’। ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যান।

পরবর্তীতে বহুবার বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। তাতেও কোনো ফল আসেনি। বিশেষ করে, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওযায় বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭৩-এ তেজময় হয়ে ওঠে। বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নেওয়ার জন্য বেলুচদের একজন ‘বঙ্গবন্ধু’ খুবই অপরিহার্য। এখনও বেলুচদের মধ্যে কেউ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি

স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বেলুচিস্তান আত্মনিয়ন্ত্রণের ঘোষনা দেন। তার ভাষ্যমতে বেলুচিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। পাকিস্তান বা ভারতের সাথে যুক্ত হবে না। সমতার ভিত্তিতে একটি চুক্তি করার কথা থাকলেও সেই চুক্তি কখনোই করা হয়নি।

বিদ্রোহ চরম আকার ধারন করে ষাট ও সত্তর দশকের দিকে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নিজেদের ভিত্তি পাক্কা করার করার পর বেলুচিস্তানও উত্তাল হয়ে উঠে নিজেদের স্বাধীনতার আশায়।

একুশ শতকের দিকে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ শক্ত হাতে আন্দোলন দমনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে অন্ধের যষ্ঠী বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি নির্মমভাবে নিহত হন পাকসেনাদের হাতে। তবে দমে যায়নি বেলুচ জাতি। তারা ক্ষোভে ফেঁপে উঠে ইসলামাবাদের বিপক্ষে এবং স্বাধীনতার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। তবে ভাগ্য বাংলাদেশের মত সহায় হয় নি বেলুচ জাতিদের। বেলুচ জাতির এই আন্দোলন আজও সক্রিয় রয়েছে। মৃত দেহের সংখ্যা বাড়তে থাকে অগণিতহারে।

ভারত সরকারও বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলে ঘাটতে শুরু করে। সাম্প্রতিক সময়ে বেলুচিস্তানের দুই নেতা ওয়াহিদ বালুচ এবং মুনির মেহুল ফ্রান্স হতে ভারত সফর করেন। তারা বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের সাহায্য কামনা করেছেন। তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় কাশ্মির ইস্যুতে যখন ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ প্রায় আসন্ন সে সময়ে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার ইস্যুকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

যতোবারই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়েছে ঠিক ততোবারই পাকিস্তানি সেনারা বেলুচদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় দশবার পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে বেলুচ জাতি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ