বন্ধুত্বের একাল সেকাল ও "বিশ্ব বন্ধু দিবস"

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০১৯, ১৭:৪০

বন্ধু কথাটি সর্বকালেই খুবই তাৎপর্য ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় যুগের বিবর্তনের ধারায় বদলে যাচ্ছে বন্ধুত্বের ধরণ, কিন্তু বদলায়নি বন্ধুত্বের টান। রক্তের সম্পর্কের পর যদি কোন উত্তম সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তা অবশ্যই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একজন ভালো বন্ধু অবশ্যই আশীর্বাদ স্বরূপ। কারণ, বন্ধুত্বের সম্পর্ক হচ্ছে আত্মার সম্পর্ক তাই বন্ধুকে অনেকে আত্মার আত্মীয় ও বলে থাকেন।

আগেকার দিনে বন্ধু দিবসকে উপলক্ষ করে এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে কার্ড পাঠানোর প্রচলন ছিল। ১৯১৯ সালের দিকে জয়েস হল এই কার্ডগুলোর প্রচলন শুরু করেন, একে 'হলমার্কের কার্ড' ও বলা হয়ে থাকে। এটি খুব শীঘ্রই সবার মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যা পরবর্তীতে তা আগস্ট এর প্রথম রবিবার 'বন্ধুত্ব দিবসে' জয়েস হল বন্ধুত্ব দিবসের কার্ড হিসেবে এই কার্ড গুলোকে উৎসর্গ করেছিলেন।

তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন এসেছে উপহার দেয়ার ধরণেও। বর্তমানে বন্ধুকে উপহার হিসেবে শুধুমাত্র কার্ড বিলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এখন কার্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্রেসলেট, ফ্রেন্ডশিপ বেল্ট, চকলেট, গ্রিটিং কার্ড, ইনবক্সে উইশ ইত্যাদি নানা মাধ্যম স্থান করে নিয়েছে। বন্ধু দিবসের ফুল দেয়ার মধ্যেও লক্ষ করা যায় ভিন্নতা। বলা হয়ে থাকে বন্ধুত্বের রং হলুদ। তাই বন্ধু দিবসে একে অপরকে বিভিন্ন ধরণের হলুদ রঙের ফুল ও গোলাপি গোলাপ সবার করে থাকে। আর এ প্রচলনটি বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করে নিয়েছে।

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে- "বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের আরো বেশি মানবিক বানায়, শেখায় অন্যের প্রতি আরও বেশি সহনশীল হতে।"

বন্ধু দিবস পালনের ইতিহাস প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু হয়েছিল। তবে আমেরিকাতে ১৯৩৫ সাল থেকেই বন্ধু দিবস পালনের প্রথা চলে আসছে। জানা যায়, আমেরিকাতে ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন। আর দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদস্বরূপ পরের দিন রবিবার ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষেই আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রবিবার কে বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত উপনীত হয়। এবং মার্কিন কংগ্রেস ঘোষণা করেন যে আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বিশ্ব বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হবে।

বন্ধু দিবস পালনের প্রথম প্রস্তাব আসে আমেরিকা (ইউএন) থেকে। ১৯৫৮ সালের ২০ জুলাই ডঃ আর্টেমি ব্র্যাচো ৩০শে জুলাইকে আন্তর্জাতিকভাবে "বিশ্ব বন্ধু দিবস" হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেন। আর সেই থেকেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের আত্মত্যাগ কে সম্মান জানাতে আমেরিকার মার্কিন কংগ্রেস বন্ধুদের সম্মানে একটি দিন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তখন থেকেই মূলত দিনটি শুরু হয়। তখন থেকেই প্রতিবছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার কে ঘিরে বিশ্ব জুড়ে পালন হয়ে আসছে "বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস।"

১৯৯৭ সালের দিকে জাতিসংঘ বিশ্বময় বন্ধুত্বকে আলাদা অবস্থানে নিয়ে যায়। কাগজে-কলমে প্রায় ৮০ বছরের অধিক সময় ধরে বন্ধু দিবসের যাত্রা অব্যাহত ও চলমান থাকলেও আনুষ্ঠানিকতার দিক টিকে বিবেচনা করলে মাত্র দুই আড়াই শতক ধরেই বন্ধু দিবসকে নিয়ে উৎসবের ঘনঘটা চোখে পড়ে। ২০১১ মতান্তরে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে ৩০ জুলাই কে অফিসিয়ালভাবে ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ ডে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বিলাসের বন্ধুত্ব নিয়ে গাওয়া গান "উইথ অল হেলপ ফ্রম মাই ফ্রেন্ডস" এই অমর গানটি বন্ধুত্বের প্রতিপাদ্য নিয়ে কাজ করেছিল। যা এখনো বন্ধুত্ব দিবসে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা একটি বিখ্যাত গান হিসেবে পরিচিত রয়েছে।

উল্লেখ্য, "বিশ্ব বন্ধু দিবস" দিনটি তাদের নিজস্ব ইতিহাসের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালন করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বাংলাদেশ সহ আরো কিছু সংখ্যক দেশে আগস্টের প্রথম রবিবারে দিবসটি পালন করে। তবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় ২০ শে জুলাইকেই বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্যারাগুয়েতে অবশ্য ৩০শে জুলাই পালন করা হয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড এবং অত্যন্ত আনন্দঘন ঘন করার মাধ্যমে বন্ধুদের দিবসটি পালন করা হয়।

তবে পেরো "এল ডিয়া দেল আ্যমিগা" অর্থাৎ বন্ধু দিবস ২০০৯ অব্দি পেরু ভ্যালেন্টাইন্স ডে এর পাশাপাশি বন্ধুত্ব দিবস পালন করে আসছে। কারণ, এতে তারিখ নির্দিষ্ট নয়। আগস্ট এর প্রথম রবিবার তারিখ যাই আর হোক না কেন, যে কোন দেশের সংস্কৃতির ওপর অনেকটা খানি নির্ভর করে। কারণ বন্ধুত্বের টান কে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগে না বন্ধুত্ব দিবস। একই সুতোয় গাঁথা বন্ধু ও ভালবাসায় একটি নাম "বন্ধুত্ব"। তবুও যুগে যুগে বন্ধুত্বের আত্ম ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই এই বন্ধু দিবসের আয়োজন।

বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এরিস্টটল লিখেছিলেন- “প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়,ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়।” আসলে বন্ধুত্ব হল এমন একটি সম্পর্ক যে আপনার সমস্ত গোপনীয়তাকে জানে এবং ধারণ করে, আপনার সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রক্ষা করার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আর এমনিভাবে বন্ধুত্ব প্রতি বন্ধুর ভালোবাসার স্মৃতি, আত্ম-ত্যাগের মহিমা কালের সাক্ষী হয়ে বন্ধু দিবস উদযাপনের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ