শুভ জন্মদিন দুঃখিনী বাংলার তাজ

প্রকাশ | ২৩ জুলাই ২০১৯, ১২:২০

এক.

তাজউদ্দীন আহমদ-এই নামটার সাথে আমাদের জাতীয় ইতিহাস এমন ভাবে জড়িত যে চাইলেও বাংলাদেশ শব্দটা থেকে তাজউদ্দীন শব্দটাকে আলাদা করা যায় না। এমন একজন নেতাকে জানতে জানতে আরও বুঁদ হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে তাঁর কাজের ভেতর। শুধু তাজউদ্দীন আহমেদের গল্প বলতে বলতে একটা পুরো রাত কাটিয়ে দেয়া যায়। ভুট্টো বলেছিলো-

"আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়, কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, হি উইল বি আওয়ার মেইন প্রবলেম।"

আর আমাদের এই ভূমিতে দেশের জন্য কাজ করা প্রত্যেকটা মানুষের ওপর যেই খড়গ নেমে আসে সেই খড়গটা তাজউদ্দীন আহমদের ওপরই পড়েছিলো সবার আগে। সেটা হচ্ছে তাঁকে বারবার নাস্তিক, পারতপক্ষে হিন্দু প্রমাণের চেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আর জামায়াতের পক্ষ থেকে লিফলেট ছড়ানো হতো-

"তাজউদ্দীন ভারতে গিয়া হিন্দু হইয়াছেন..."

১৯৭১ এ একজন পাকিস্তানি অফিসার তাজউদ্দীন আহমদের শশুরকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ

“ সৈয়দ সাহেব, আপনি ছিলেন আরবি প্রফেসর এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধেও আপনার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। অথচ আপনার মেয়ের কি না বিয়ে দিলেন এক হিন্দুর সঙ্গে”।

অথচ তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন কোরআনে হাফেজ!!!

যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দৈনিক সংগ্রামের লেখা গুলো পড়েছেন তারা ভালো করেই জানেন পুরোটা একাত্তর জুড়ে তাজউদ্দীন আহমেদ কে তারা 'শ্রী তাজউদ্দীন' লিখতো। গোলাম আজম সংগ্রামের সম্পাদকীয় লিখেছিলো;

"বাংলাদেশ বাঙালীদের দ্বারা শাসিত হবে এ মতবাদ শ্রী তাজউদ্দীনের..."

 

দুই.

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য সবসময়ই ছিলো ৩০ মিনিট। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কাজ করত, চলত ভারতের সময়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কোনো দিন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, সেটি চলত বাংলাদেশের সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি দানবেরা এই দেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলো। তখন আকাশে শকুন উড়ত, নদীর পানিতে ভেসে বেড়াত ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ, শুকনো মাটিতে দাউ দাউ করে জ্বলত আগুনের লেলিহান শিখা, বাতাস ভারী হয়ে থাকত স্বজনহারা মানুষের কান্নায়। শুধু বাংলাদেশের সময়টুকু তারা কেড়ে নিতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ পরম মমতায় সেই সময়টুকুকে তাঁর হাতঘড়িতে ধরে রেখেছিলেন।

ঘাতকের বুলেট তাজউদ্দীন আহমদের হৎস্পন্দনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতের ঘড়িতে ধরে রাখা বাংলাদেশের সময়টিকে কোনো দিন থামাতে পারবে না। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়ি আমাদের হৃদয়ে টিকটিক করে চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে।

-মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 

তিন.

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে মিটিং-এ বসেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রাথমিক আলোচনার পর বিস্তারিত আলোচনার জন্য ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার।

তাজউদ্দীন আহমদ বললেন,
'আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি-না আমার সন্দেহ আছে।'

ম্যাকনামারা বললেন,
'মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে।'

তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন,
'মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার।

যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে-ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে।

পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষিরা এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষি ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে?

কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলো গরু।'

ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে, তাজউদ্দীন আহমদ বলে চলেছেন,

'আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে,
এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন।
গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।'

অস্বস্তিকর এই মিটিং শেষে যখন তাজউদ্দীন আহমেদকে জিজ্ঞেস করা হল, কেন তিনি এরকম করলেন। উনি তখন বললেন,

'কেন?
গরু ছাড়া কি চাষ হয়?

আর এই লোকটাই তো আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিলেন,
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদেরকে স্যাবোটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আর তার কাছে সাহায্য চাইবো আমি?'

 

চার.

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতায় আগুনে পোড়া নিজের পৈত্রিক ভিটার সামনে এসে দাঁড়ালে সমবেত জনতা বলে ওঠে- আর চিন্তা কি, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।

তিনি তখন বলেছিলেন-

“যতদিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে
ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না”।

সেই ভিটায় বাড়ি আর ওঠেনি।

 

পাঁচ.

তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন-

"আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো। যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়; কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে..."

শুভ জন্মদিন দুঃখিনী বাংলার তাজ...