রাজপুত্রের নাম মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ

প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৯, ১১:৪৭

কালো কোটি পরা আজাদ

রাজপুত্রের নাম মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। গান পাগল সিনেমা পাগল এক ছেলে। এলভিস প্রেসলির পোকা ছিল আজাদ আর ইংরেজি সিনেমার। সেই আমলে চলত রাজকীয় চাল-চলনে যা আমরা এই প্রজন্মও পারেনা।

বড়লোক বাবার আহ্লাদি মায়ের পুত্র ছিল আজাদ। শৈশব কেটেছিল তাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায়। সে সময় নিউ ইস্কাটন ছিল সবচাইতে অভিজাত এলাকা।

আজাদ ছোট থেকেই ছিল সিনেমা পাগল ছিল। ইংরেজি সিনেমার পোকা। নাজ সিনেমা হলে স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যেতো। নিজের টাকায় টিকিট কেটে দিতো সহপাঠীদের। কমিকস পড়ার নেশাটাও ছিল। মিলস এন্ড বুন থেকে পেঙ্গুইন ক্লাসিকস, লরেন্স থেকে ডস্টয়ভস্কি, বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র সবই পড়তো আজাদ। এমনকি বাউন্ডুলেটার ড্রয়ারে লুকানো থাকতো প্লেবয়। সেই সময় একবারে দেড়হাজার টাকারও রেকর্ড কিনতো। 

করাচি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে প্রেমে পড়ে মিলির। সেখানের পাট চুকিয়ে ফিরে আসে ঢাকায়। ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আজাদের বন্ধু ছিল জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, কাজী কামাল, হাবিবুল আলমরা। 

তারপরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেও যুদ্ধে যেতে চায়।

দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আজাদ এর সাথে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামালের। কামাল বললেন, “চল, অপারেশনে চল। তুই তো তোর বাপের বন্দুক চালাইতে পারস।” 

তবে প্রয়োজন মায়ের অনুমতি। কেননা মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। আবার তাকে ছাড়াও মায়ের কেউ নেই। তাই মায়ের অনুমতি প্রয়োজন। 

আজাদ বলল, এ জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নাই, মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নাই। মা যদি আমাকে অনুমতি দেন, তাহলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি।

আজাদ ভেবেছিল মা হয়তো মানা করবেন। কিন্তু সাফিয়া বেগম বললেন, "ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যেতে পারিস, আমার দোয়া রইল। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলে মায়ের মুখের দিকে, বুঝতে চেষ্টা করে, মা কি সত্যিই বলছেন না রেগে গিয়ে অনুমতিটা দিচ্ছেন…

–মা, তুমি কি অন্তর থেকে পারমিশন দিচ্ছ, নাকি রেগে গিয়ে?
–আরে রাগ করব ক্যান? দেশটা স্বাধীন করতে হবে না?"

আজাদের ট্রেনিং ছিল না, তা সত্ত্বেও সে গেরিলা বন্ধুদের সহযাত্রী হয়ে দুটো অপারেশনে যোগ দিয়েছিল। আজাদদের বাড়ি হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের ক্যাম্প। সেখানে এসে উঠলেন জুয়েল, ক্রিকেটার জুয়েল, আজাদ বয়েজে খেলতেন, মারকুটে ব্যাটসম্যান আর উইকেটকিপার ছিলেন। উঠলেন কাজী কামাল। সেখানে থাকতেন মর্নিং নিউজ-এর সাংবাদিক আবুল বাশার। তাদের বাড়িতে অস্ত্র, গোলাবারুদ মজুত করা হলো।

ক্রাকপ্লাটুনের হয়ে আজাদ রুমি বদি জুয়েল সহ বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়ে পাকিদের মনে ধরিয়ে দিয়েছিল মৃত্যু ভয়। মগবাজারের বাসায় ১৯৭১ এর ৩০ আগস্ট ধরা পড়ে আজাদ রুমি জুয়েল সহ আরো অনেকে । এরপর রমনা থানায় ছুটে গিয়েছিলেন আজাদের মা ছেলের সাথে দেখা করার জন্য। মাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আজাদ। 

মা জানতে চাইলেন ‘কেমন আছো’, আজাদ মাকে বললেন, ‘খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি’। ছেলের সামনে তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। বরং ছেলেকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোন কিছু স্বীকার করবে না’। সেদিন মায়ের কাছে বলেছিল মা ভাত খেতে ইচ্ছা করে দুদিন ধরে ভাত খেতে পারিনি। 

মা সাফিয়া বেগম আবার ছুটে গিয়েছিলেন পরে ভাতের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজাদকে আর দেখতে পাননি মা।

এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কখনোই ভাত মুখে নেননি আজাদের মা সাফিয়া বেগম। ছেলে জেলে থাকাকালীন সময়ে নরম বিছানায় শুতে পারেনি বলে মা'ও আর কখনো নরম বিছানায় শোননি।

শুভ জন্মদিন আজাদ। সালাম তোমায় মা।

 

তথ্যসূত্র: আনিসুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস 'মা'