বাংলাদেশ ও জনগণের রাজনীতি

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৫:৩৬

কত লড়াই আর সংগ্রামের পর আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা পেয়েছি! ব্রিটিশরা আমাদের প্রায় ২০০ বছর পরাধীন রেখে শোষণ, অত্যাচার নিপীড়নের পর ধর্মের উপর ভিত্তি করে পুরো ভারতবর্ষকে (ব্রিটিশ ভারত) দুই ভাগ করে বিদায় নেয়। বাংলা ও পাঞ্জাব – ব্রিটিশ ভারতের এই বৃহত্তম প্রদেশ দুটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামে স্বাধীন দুটি দেশ! ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিধিবদ্ধ ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ অনুসারে উক্ত রাষ্ট্রদুটির মেয়াদ ছিল তাদের নিজস্ব সংবিধান প্রখ্যাপিত না হওয়া পর্যন্ত। ভারতের ক্ষেত্রে সংবিধান কার্যকর করার তারিখ ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০; এই দিনই প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় প্রজাতন্ত্র। অন্যদিকে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংবিধান কার্যকর করার তারিখ ছিল ২৩ মার্চ, ১৯৫৬। এই দিনই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান।

১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কংগ্রেসের এবং মুসলিম লীগ নেতারা ক্ষমতা হস্তান্তর ও ভারতের বিভাজনে সম্মত হন। বাম থেকে: বালদেব সিং, আচার্য ক্রিপালানী, জওহরলাল নেহেরু, লর্ড মাউন্টব্যাটেন, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান এবং আব্দুর রাব নিশতার। [ছবি: এক্সপ্রেস আর্কাইভ]

অথচ ব্রিটিশদের কবল থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই সংগ্রামে শত সহস্র জীবন দেয়াদের মধ্যে বাঙালিরাই ছিলো সংখ্যায় বেশী! যে বাঙালিদের কারণে বাধ্য হয়ে ব্রিটিশরা চলে যায় সেই বাঙালিদের একাংশ পরাধীন থাকলো!

আমাদের মাতৃভূমি ‘পূর্ব বাংলা’ পূর্ব পাকিস্তান (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) নামে স্বাধীন পাকিস্তানের একটি অংশ হয়ে গেলো! মূলত বাকি অংশগুলো মিলেই স্বাধীন পাকিস্তান, যা পশ্চিম পাকিস্তান (ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রদেশ, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত) নামে আমাদের মাতৃভূমিতে পরিচিত ছিলো! পাকিস্তানের এই দুটি অংশের মধ্যে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধান। এছাড়া কেবল ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার ফলে এই দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান। এরপর আমাদের মাতৃভূমি পূর্ব বাংলায় শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নিপীড়নের আরেক করুণ অধ্যায়!

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইংরেজীতে প্রদত্ব বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি।

এসময়কালে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন ছাড়াও বিভিন্ন দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও ভূমি সংস্কারের মতো গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে জনগণ সোচ্চার হয়। তেভাগা-হাজং-টঙ্ক আন্দোলন, চা শ্রমিকদের আন্দোলন, সুতাকল ও রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের পাশাপাশি, বিভিন্ন পেশার আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এছাড়া সকল মানুষের সমান অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সভা-সমিতি-সংগঠন করার স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার, যুক্ত নির্বাচনসহ প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন, ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ নীতির আশু বাস্তবায়ন, বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবিতে সরব হতে থাকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ। কোথাও কোথাও শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

১৯৫০ সালে রাজশাহী খাপড়া ওয়ার্ডে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করল পূর্ব বাংলার জনগণ। ১৯৫২ সালের শুরু থেকেই আরো তীব্রভাবে মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, তেজোদীপ্ত তরুণ সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।

পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

১৯৫৭ সালে করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করে বলেন, পূর্ববাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। ‘আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তা হলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা-সে জন্য গণভোট নিতে হবে।’

তার পর ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস নামে ছাত্রলীগের একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। যারা স্বাধীনতার পক্ষে চিন্তাভাবনা করত। তারা এই অঞ্চলকে বলতেন-স্বাধীন পূর্ববাংলা। এর পর ১৯৬৯ সালে শুরু হয় আইয়ুব পতন আন্দোলন। সেই সময় গণঅভ্যুত্থানে স্লোগান দেয়া হয় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ইতিহাস অনুযায়ী-ওই প্রথম পূর্ববাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়। পরে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন-‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’।

আওয়ামী লীগের নেতারা ওই বৈঠকে বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন। এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন--১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে- বাংলা। এর পর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে- দেশ। এই দুটি ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়। এর পরও নথিপত্রগুলোয় পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও কেউ মুখে পূর্ব পাকিস্তান উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে, তাতেও বলা হয়- এই দেশটির নাম হল ‘বাংলাদেশ’। উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে বলা হতো- বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে বঙ্গদেশ শব্দের উল্লেখ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তিরিশের দশকে তার কবিতায় বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করেছেন। আবার সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও উচ্চরিত হয়েছে বাংলাদেশ নামটি। অন্যদিকে জীবনানন্দ দাস বলেছেন- রূপসী বাংলা আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন সোনার বাংলা বলে।

ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেও পরাধীন হয়ে পড়া বাংলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদের সাথে নিয়ে বাঙালিরা ১৯৪৭ এর পর থেকেই নানাভাবে স্বাধীনতার যে সংগ্রাম শুরু করলো পর্যায়ক্রমে সেই সংগ্রামের প্রধান নেতা হয়ে উঠলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “৬ দফা দাবি” পেশ করেন। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালির মুক্তির সনদও বলা হয়।

ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নারীদের মিছিল [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

এরপর ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে ৷ আইয়ুব খানের পদত্যাগ এর দাবী তুলে পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষ একযোগে পথে নামেন। মূলত ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গণঅভ্যুত্থানের মুখেই আইয়ুব তার ১১ বছরের রাষ্ট্রপতিত্বের অবসান ঘটান পদটি থেকে পদত্যাগ করে। এই আন্দোলনকেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বলা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছেন। [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

১৯৭১ এর ০৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়লো পশ্চিম পাকিস্তান! ২৫ মার্চ দিনের শেষে রাতে ঘুমিয়ে পড়া বাঙালিদের নিধন শুরু করলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী!

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এর নাম দিলো ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা বঙ্গবন্ধুর আহবানে সারা দিয়ে ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী শাষকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত ‘অপারেশন ব্লিটজ্‌’ এর পরবর্তী অনুষঙ্গ। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

অপারেশন সার্চলাইটের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ। এদিন হতাহতের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়, ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকায় ০৭ হাজার বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়। ঘোষণাটি নিম্নরুপ-

‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’

২৬শে মার্চ বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাসেমসহ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েক’জন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নান প্রথম শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। পরে ২৭শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণাপত্রটির ভাষ্য নিম্নরুপ-

“আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।”

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সাথে যুদ্ধরত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

১৯৭১ সালে জাতির পিতার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর, চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও পুনরায় ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে উচ্চারিত স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়। ০৯ মাস যুদ্ধ শেষে আমাদের মাতৃভূমি, জন্মভূমি, প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় আসে। ০৯ মাস যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ৩০ লক্ষ মানুষ। দুই লাখ মা-বোন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন।

মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়ন করলেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে গণতান্ত্রিক ভিত্তি রচনা করলেন। সেই নির্বাচনে এদেশের জনগণ বিপুল ভোটে বিজয়ী করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রিয় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পন্থায় আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি হলেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি ছোট্ট দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান যোগারের পাশাপাশি দেশকে উন্নত করতে নিরলসভাবে কাজ করছেন ঠিক সেই সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে একদল পাকিস্তানি মতাদর্শের সেনা অফিসার।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর লাশ এভাবেই সিড়িতে পড়ে থাকে। [ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ]

নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী খন্দকার মোশতাক। মোশতাক দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিনের মাথায় ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমানকে চীফ অফ আর্মী স্টাফ নিযুক্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে এই আর্মি অফিসারের ভূমিকা বিতর্কিত। ১৯৭৫ সালে মুজিবের হত্যাকারীদের বিচারকার্য বন্ধ করার জন্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের অনুমোদিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জিয়ার দ্বারা বৈধকরণ করে। এরপর নানা ঘটন অঘটনের পর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম এঁর উত্তরসূরি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কতিপয় হত্যাকারীকে বিদেশে প্রেরণে সহায়তা করেন। এছাড়া জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা নিহত অথবা গুম হন। ১৯৭৭ সালের ০২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাখান করে জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে এবং পাকিস্তানীদের এদেশীয় দোসরদের রাজনৈতিক সংগঠনকে জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানী ভাবধারার রাজনীতি করার সুয়োগ দেয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করা সেই জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ যা বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পরিচিত। এরপ ১৯৮১ সালের ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হয়।

ক্ষমতার পালাবদলের পরিক্রমায় ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি ০৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ বাতিল করেন। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সকল দল বয়কট করে। এরশাদের স্বৈরাচারের বিরূদ্ধে দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে সকল বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে ০৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে।

এবার ক্ষমতায় আসে খালেদা খানম পুতুল। খালেদা খানম পুতুল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী যিনি বেগম খালেদা জিয়া নামে পরিচিত। ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়। তিনি নিহত স্বামীর পথ অনুসরণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজের কাছে টেনে নেয়। এরপর সকল বিরোধীদলের আপত্তির পর ও খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচন বয়কট করে। এই সংসদ মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী হয়। প্রবল গণ আন্দোলন ও বর্হিবিশ্বের চাপে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। একই বছরের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। জাতির পিতার কন্যা দলের প্রধান শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার কাজ। কিন্তু অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সাথে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ০১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করে। এই সরকারে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী ও ৭১ সালে বাঙালি নিধনে অংশ নেওয়া জামায়াতে ইসলামী নেতাদের মন্ত্রী বানানো হয়। যে দেশটির স্বাধীনতার বিরোধীতা করলো সেই স্বাধীন দেশেই তারা মন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করলো। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।

এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং পর্যায়ক্রমে ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছে।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। বিশেষ করে জহির রায়হানের মা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে ডা. এম এ হাসানের নেতৃত্বে শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মঞ্চ হতে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি ১০১ জন সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। তিনি হন এর আহ্বায়ক। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬শে মার্চ ’গণআদালত’ এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালাতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ২০০৬ সালে এ আন্দোলনের ডাক দেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জরুরী অবস্থার হুমকির মধ্যেও সরকারি বাঙলা কলেজ -এর শিক্ষার্থীবৃন্দ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ও বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা করে এবং পর্যায়ক্রমে মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, সমাবেশ, পথসভা, মিছিল, নিরবতা পালন, প্রতীকী বেদীতে পুষ্প অর্পণ ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করে। ২০০৭ হতে ২০১০ পর্যন্ত রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রিরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডিজিটাল আন্দোলন সবসময়ই অব্যাহত রাখে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ইশতেহার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা। সে নির্বাচনে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বিজয়ী হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ ২০০৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইবুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয় এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আল-শামসসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের (বর্তমান ছাত্রশিবির নামে পরিচিত) নেতাকর্মীদের বিচারকার্য শুরু হয়। জামায়াতের এসব কর্মীরা একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণের মত ঘৃণিত অপরাধ সংগঠিত করে। বিচারকার্য শুরুর পর ২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি জ্যেষ্ঠ বদরনেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণা করে। কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যাসহ মোট ৬টি অপরাধের ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু এতোগুলো হত্যা, ধর্ষণ, সর্বোপরী গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকার শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করে এবং এর অনুসরণে দেশটির বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগানরত শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠক  ও সাংবাদিক সাকিল আহমদ [ছবি: মিল্টন]

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে শাহবাগের এই আন্দোলন সবচেয়ে বড় অহিংস গণআন্দোলন। সেসময় সারা দেশের লক্ষ কোটি কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও যুদ্ধপরাধীদের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার সময়ই জামায়াতের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। শাহবাগের গণজাগরণ ছিলো জামায়াতে ইসলামীর কফিনের শেষ পেরেক। এই আন্দোলনে জীবন দিতে হয়েছে শাহবাগীদের। শতাধিক আন্দোলনকারীরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আমরা আন্দোলন চালিয়ে গেছি কিন্তু দিনের পর দিন বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সবকিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের প্রজন্ম এই লড়াইটা শেষ করতে পেরেছি। জামায়াতের রাজনীতি কার্যত স্থবির হয়ে আছে। ২০১৯ সালের ০৬ ফেব্রুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় তার সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জনদাবি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। শেখ হাসিনা বলেন, এই কুখ্যাত রাজনৈতিক দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সংক্রান্ত একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে। যতক্ষন পর্যন্ত না এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়, ততক্ষন পর্যন্ত আমরা (সম্ভবত) এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারব না। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শিগগিরই আদালতের রায় পাই, তাহলে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াত বেআইনি হবে।’

শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম মিছিল [ছবি: মারুফ রসূল]

বিএনপির আশ্রয় নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বিগত সাধারণ নির্বাচনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে এবং বাংলাদেশের জনগন তাদেরকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের শর্তাবলী পূরণ করতে ব্যার্থ হওয়ায় জামায়াত কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের আইনের আওতায় এনেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর জিয়াউর রহমান তাদের বিচার বন্ধ করে দেয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১২ বিলোপ এবং অনুচ্ছেদ- ৩৮ আংশিক সংশোধন করে জিয়াউর রহমান তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ এবং নাগরিক অধিকার দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির এক কলংকজনক অধ্যায় চালু করেছিলো। সম্প্রতি ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ‘ক্ষমা না চাওয়ায়’ জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। যিনি জামায়াতে ইসলামীকে বিলুপ্ত করে দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতি প্রকৃতি। ইতিহাসের এই পরিক্রমায় আরো অনেক ঘটন-অঘটন আছে। তবে ২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয়। আর সেই পথ ধরেই আমাদের আগামি প্রজন্ম ঘাতক-দালাল-হায়নাদের ক্ষমতার আস্ফালনমুক্ত এক বাংলাদেশে বেঁচে থাকবে।

জয় বাংলা

লেখক: সংগঠক, শাহবাগ আন্দোলন ও বার্তা সম্পাদক সাহস২৪.কম

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ