ভোলার উন্নয়ন ভাবনা: পানি সেক্টর ও অন্যান্য

প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:১৬

দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের লোয়ার মেঘনা, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেঁতুলিয়া নদী বিধৌত ভোলা উপকূলবর্তী দ্বীপ জেলা যার বর্তমান আয়তন ৩৭৩৭.২১ বর্গ কি:মি: ও লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ। ভোলার প্রস্থ পূর্ব পশ্চিমে প্রায় ১১ থেকে ২৫ কি:মি: ও দৈর্ঘ্য উত্তর দক্ষিণে প্রায় ১২০ কি:মি:। ভোলার ভূমি সমতল ১.৭৫ মি: পিডব্লিউডি থেকে প্রায় ৩.২০ মি: পিডবিডব্লিউডি লেভেলে।

ফ্লানেল আকৃতির উপকূলভাগ, নিম্ন সমতল ভূমি, দূর্বল ভূমি গঠন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস, অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ঝড় হাওয়া, জলোচ্ছাস, জোয়ারভাটা, সাইক্লোন প্রভূতির ব্যাপকতা বৃদ্ধি, লবক্ততা, নদী ভাঙ্গন, যত্রতত্র চরপড়া, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, নাব্যতা সংকট প্রভৃতি নানা কারণে দক্ষিনাঞ্চল ও বিশেষ করে তার বৈশিষ্ট মন্ডিত দ্বীপ জেলা আগে থেকেই অত্যন্ত সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আবহমন্ডলের পরিবর্তন জ্বনীত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অসময়ে অতিবৃষ্টি, সমুদ্র সমতলের বৃদ্ধি প্রভৃতি নানা কারণে দুর্যোগের মাত্রা ও প্রকৃতি ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় পানি সেক্টরের সমস্যা এই অঞ্চলে অধিকতর প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বন্যা, জলোচ্ছাস ও লবনাক্ততা থেকে ভোলাকে রক্ষার জন্য এর চতুর্পার্শ্বে সেই ষাট এর দশকে নির্মিত হয়েছে পোল্ডার ৫৬/৫৭ যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৮ কি:মি:। পানি নিষ্কাশনের ও প্রবেশের নিমিত্তে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য রেগুলেটর ও ইনলেট। মনপুরাতেও তেমনি নির্মিত হয়েছে পোল্ডার ৫৮/১,২ ও ৩ যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কি:মি: এবং রেগুলেটর সহ নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু অবকাঠামো।

ভোলার মূল ভূখন্ডে নদী ভাঙ্গন রোধে ৫টি প্রকল্পের আওতায় ৩টি পর্যায়ে প্রায় ৩০.৫০২ কি:মি: নদী তীর সংরক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে এবং বর্তমানে ৭টি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩২.৯৮৮ কি:মি: তীর সংরক্ষণের কাজ চলমান আছে। এর বাইরেও ভোলার বিভিন্ন স্থানে প্রলয়ঙ্কারী মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙ্গণ জনীত প্রায় ১৬ কি:মি: অত্যান্ত স্পর্শকাতর স্থান রয়েছে যার সংরক্ষণ কাজ অতিশীঘ্রই শুরু হওয়া দরকার। ইতোমধ্যেই পশ্চিম রাজাপুর, চরকাইচ্চা, শিবপুর, ধনিয়া, চৌকিঘাটা, হাকিমউদ্দিন বাজার, ভবানিপুর, লালমোহন ও শাহবাজপুরের গ্যাস ফিল্ড অংশ, গঙ্গাচরা, ছোট মানিকের চর ও কুতুবা অংশের ভাঙ্গন রোধে ৫টি নতুন প্রকল্প ও কতিপয় চলমান প্রকল্পের সংশোধনী আনয়ন করে নতুন করে প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১২.০০ কি:মি: নদী তীর সংরক্ষণ কাজের সংস্থান রাখা হয়েছে।

সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের নিমিত্তে ভোলা সেচ প্রকল্প ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর আওতায় নদী/খাল খনন সহ অসংখ্য অবকাঠামো নির্মিত হয়।
পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষন ব্যয়ের স্বল্পতার কারনে এগুলোর কার্যকারিতা বিঘ্নিত হওয়ায় প্রকল্প সমূহের উদ্দেশ্য পুরন সর্বাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে। তাছাড়া সেচ ও নিষ্কাশন প্রকল্প দুটির লাইফ স্প্যানও উত্তীর্ন হওয়ার পথে। জনগনের চাহিদার প্রেক্ষিতে এগুলো দ্রুত পুনর্বাসন করে এর অংগ সমূহের কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

ইতোমধ্যেই ভোলা জেলার সকল ভরাটকৃত নদী/খালের তালিকা প্রস্ত্তত করে প্রাথমিকভাবে প্রতি উপজেলা থেকে ১টি করে নদী/খাল এবং সদর উপজেলার ২টি খাল অগ্রাধীকারের ভিত্তিতে পুন:খনন এর নিমিত্তে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রকল্প প্রস্তাব প্রনয়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। পর্য্যায়ক্রমে সকল ভরাটকৃত নদী/খাল প্রকল্পভূক্ত করে খননের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার।

ভোলাকে সিঙ্গাপুরের রোল মডেল হিসেবে তৈরী করার অঙ্গীকার সম্প্রতি ব্যক্ত করেছেন ভোলার কৃতিসন্তান জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় বানিজ্য মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ। ভোলার বিভিন্ন উপজেলার উন্নয়নের নিমিত্তে ও ভোলাকে স্বপ্নপুরী বানানোর লক্ষ্যে অকাতরে কাজ করে চলেছেন মাননীয় সাংসদ জনাব আলী আজম মুকুল, মাননীয় সাংসদ জনাব নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ও মাননীয় সাংসদ এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপমন্ত্রী জনাব আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। স্ব-স্ব সংসদীয় এলাকার উন্নয়নে এমন জোর তৎপরতা ও প্রতিযোগীতা সচরাচর অন্যত্র দৃষ্টিগোচর হয়না।

মাননীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদগণের স্বপ্ন পূরণে এবং ভোলার পানি সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নের নিমিত্তে কতিপয় প্রস্তাব ও সুপারিশ নিম্নে পেশ করা হলো-

১) গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাস, জোয়ার-ভাটা মোকাবেলায় ভোলা, মনপুরা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন চরাঞ্চল গুলোর চারপাশের বেড়ীবাঁধ গুলোকে সমীক্ষার ভিত্তিতে নূন্যতম ১ মিটার উঁচু ও চওড়া করে নির্মান করা দরকার যাতে করে বাঁধের উপর দিয়ে দুই লেনের রোড ওয়ে এবং বিনোদন পিপাসুদের জন্য ওয়াকওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

২) বাধেঁর দেশকুলের ঢালে সুদৃশ্য গাছের সারি রোপন করা যেতে পারে এবং নদীকূলের ঢালে যেখানে সরাসরি জলোচ্ছাস ও ঢেউ এসে আঘাত হানে সেখানে সিসিব্লক দ্বারা ঢালের প্রতিরক্ষা কাজ সম্পাদন করতে হবে এবং স্থানে স্থানে ঘাটলার ব্যবস্থা করতে হবে।

৩) বাঁধের ঢালের শেষ প্রান্ত বরাবর দেশকূলে ২ কিংবা ৪ লেনের ইনার সার্কুলার রোড করা যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে ট্যুরিজম বা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে অধিকতর ফলপ্রসু বিবেচিত হতে পারে।

৪) দেশকূলে রাস্তার পাশের স্থানে স্থানে পর্যটন মোটেল, ইকোপার্ক, সাফারী পার্ক, রেষ্টুরেন্ট বা কফিকর্নার এবং ট্যুরিজম বিষয়ক বানিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলা যেতে পারে।

৫) ভাঙ্গন প্রবন স্থানগুলোতে নদী তীর সংরক্ষনের আওতায় আনতে হবে।

৬) চরফ্যাশন ও চরকুকরীমুকরী, চরকুকরীমুকরী ও চরমন্তাজ, চরমন্তাজ-চর মোতাহার, মনপুর-কলাতলী প্রভৃতিস্থানে ক্রসবাঁধ নির্মাণ করে ভূমি পুনরুদ্ধার ও মিঠা পানির আধার তৈরী করা যেতে পারে।

৭) চরফ্যাশন-চরকুকরীমুকরী প্রস্তাবিত ক্রসড্যাম বরাবর পুনরুদ্ধারকৃত ভূমিতে বিমান বন্দর নির্মাণ করা যেতে পারে যা ট্যুরিজম ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্য্যক্রমে বিশাল ভূমিকা রাখবে।

৮) মাঝের চর, চর সত্যেন, ঢালচর , ছেড়াদ্বীপ, চরকুকরীমুকরী, কলাতলী, চর খালেক, চর নাওয়াল, চর বাঘমারা, চর নজরুল প্রভৃতি চর শাহবাজপুর ও তেঁতুলিয়া নদীর খননকৃত মাটি দ্বারা উচু করে চারপাশে বেড়ী বাঁধ ও ঢাল প্রতিরক্ষা কাজ সম্পাদন করে ইকোনমিক জোন হিসেবে প্রস্তুত করা এবং ক্ষেত্র বিশেষে সৌন্দর্য্য বর্ধন করে ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কূটীর ও সুইমিংপুল সহ অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যেতে পারে।

৯) পোল্ডারের অভ্যান্তরীণ সকল নদী/খাল সিএস মৌজা ম্যাপ অনুযায়ী চিহ্নিত এবং অবৈধ দখল ও দুষণ মুক্ত করতে হবে জন প্রশাসন ও পুলিশ প্রসাশনের সহায়তায় এবং এগুলোর উৎসমুখ ও পতনমুখ, কমান্ড এরিয়া, ক্যাচমেন্ট এরিয়া, সেক্টোরাল ব্যবহার ও ভবিষ্যতের চাহিদা অনুযায়ী হাওর, বাওড়, বিলের সাথে সংযোগ সাধন ও সঠিক ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের নিমিত্তে যথাযথ পরিকল্পনা ও পাউবো কর্তৃক প্রনীত নকশার আলোকে খনন সম্পাদন করতে হবে।

১০) নদী/খালের দুই পারে কর্তৃনকৃত মাটি দ্বারা ওয়াকওয়ে এবং রাস্তরা ঢালে বনায়ন করে সেগুলো পশু-পাখির অভয়ারন্য বা অভয়াশ্রম হিসেবে উন্নয়ন করা যেতে পারে।

১১) নদী/খালের বাঁক গুলোতে এবং বিল গুলোকে মাছ ও জলজ প্রানীর অভয়াশ্রম হিসেবে প্রস্ত্তত করতে হবে।

১২) নদী ভিত্তিক ইকোট্যুরিজম এবং নৌ-বানিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।

১৩) ভোলা-বরিশাল ব্রীজ নির্মাণ করতে হবে এবং নৌরুটকে আকর্ষনীয় করার জন্য লঞ্চ-টার্মিনাল ও ফেরী টার্মিনাল গুলোকে আধুনিকায়ন করতে হবে এবং পর্যাপ্ত আধুনিক লঞ্চ ও ফেরীর ব্যবস্থা করতে হবে।

১৪) চরফ্যাশন-চরকুকরী মুকরী ও চরমমত্মাজ হয়ে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা সী-বিচে চলাচলের সড়ক ও নৌ পথের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

১৫) ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাস, কৃষি ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর। এ সম্পদ সমূহের যথাযথ উন্নয়ন ও সংরক্ষণ, বাজারজাত করণ ও বিপননের ব্যবস্থা করতে হবে।

ভোলাকে সিঙ্গাপুরের রোল মডেল হিসেবে তৈরী করতে হলে এর বাইরেও এলাকার অভ্যান্তরীণ রাস্তাঘাট, ব্রীজ ও নদীপথের ব্যপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল সেক্টরের সমন্বিত উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করণে এখনই মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ভিডিওতে যে মডেলটি প্রদর্শিত হচ্ছে সেটি তৈরী করে করেছেন সিদ্দিকুর রহমান, প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, বাপাউবো।

লেখক: প্রধান প্রকৌশলী, দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ