মহৎপ্রাণ মুহিত

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ২১:২৪

জালাল আহমেদ

বুল মাল আব্দুল মুহিত, একটু অসাধারণ নামের এই মানুষটি ছিলেন “অসংশোধনীয় আশাবাদী”, একজন সত্যিকারের মহৎপ্রাণ! তিনি ছিলেন একজন প্রাক্তন সিএসপি, সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান এর সদস্য। ষাটের দশকে যখন সিএসপিদের দোর্দণ্ড প্রতাপ তখন তিনি ছিলেন ক্ষমতা কাঠামোর একেবারে অভ্যন্তরে। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা ১৯৭৮ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ভর্তি হয়েছি লোক প্রশাসন বিভাগে আর তিনি ও কিছুদিন আগে দেশে ফিরে এসে বহিঃসম্পদ বিভাগ (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) এর সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন। জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার একটি বৃত্তি প্রদান কর্মসূচি ছিল। ১৯৭৮ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এ আমি মেধা তালিকায় থাকার সুবাদে বৃত্তি তালিকায়ও আমার নাম ছিল। শাহবাগ এর বারডেম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেই অনুষ্ঠানে আমি আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর হাত থেকে বৃত্তির চেক গ্রহণ করি।

আমি লোক প্রশাসন বিভাগে পড়তাম সিভিল সার্ভিস এ যোগদানের লক্ষ্য নিয়ে। ঐ সময়ে একটি ঘটনার কারনে ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর নাম আলোচনায় আসে। ১৯৮১ সালে দুইজন বিখ্যাত সিভিল সারভেন্ট চাকুরিতে ২৫ বছর পূর্তির পর স্বেচ্ছায় অবসরে যান। একজন প্রাক্তন পাকিস্তান ফরেইন সারভিস (পিএফএস) শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া (এসএএমএস কিবরিয়া) এবং অপরজন প্রাক্তন সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান আবুল মাল আব্দুল মুহিত। মুহিত সাহেবের বিষয়টা একটু আলোচিত ছিল কারন তিনি ১৯৭৯ সালেও একবার একই আবেদন করেছিলেন। তিন ১৯৫৬ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তান সরকারের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তিনি দুই বছর জেষ্ঠ্যতা লাভ করেন এবং ১৯৫৪ সালের ব্যাচের পর তাঁর অবস্থান নির্ধারিত হয় তাই তিনি ১৯৭৯ সালে ২৫ বছর পূরণ হয়েছে ধরে নিয়ে স্বেচ্ছাবসরের আবেদন করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে এটর্নি জেনারেলের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত দেন যে বাস্তবে ২৫ বছর চাকুরি হবার পরেই এই আবেদন করা যাবে। দায়িত্বের আসন থেকে স্বেচ্ছাবসরে যাবার খুব বেশি নজির নেই তাই এই বিষয়টি আমার মনে তাঁর নামটি স্থায়ী করে দেয়। এর কিছুদিন পরেই তিনি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর সরকারে অর্থ মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দুই বছর পর আবার ছেড়ে ও দেন। এর পর তিনি দেশে ও বিদেশে পরামর্শক এর পেশা বেছে নেন এবং পরে দেশে নাগরিক সমাজের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বা বাপা প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে বাপা বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী চিন্তক বা থিঙ্কট্যাঙ্ক এ রূপান্তরিত হয়।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি সিলেট ১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন। আমি তখন পেট্রোবাংলা’র চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত ছিলাম। সে পদ থেকে আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয় ও এরপর ভাইস চেয়ারম্যান হিসাবে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে কর্মরত থাকাকালে আমাকে সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপর দীর্ঘদিন আর আমার পদায়ন হচ্ছিল না। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে জালালাবাদ এসোসিয়েশনে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রাক্তন গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন অর্থ মন্ত্রীকে বললেন যে সরকার আমার সার্ভিস কেন ব্যবহার করছেনা? অর্থমন্ত্রী মহোদয় আমাকে দেখা করতে বললেন। আমি দেখা করলাম ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২। আমি দেখা করার আগেই তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আমাকে অর্থ বিভাগে পদায়নের জন্য বলে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি সরকারি সফরে চীন চলে যান। ১১ সেপ্টেম্বর আদেশ হয়ে যায় আর আমি অর্থ বিভাগে যোগদান করি ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি ফিরলে ২০ সেপ্টেম্বর আমি আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ততদিনে আমি অতিরিক্ত সচিব ( প্রশাসন ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা) হিসাবে কাজ শুরু করেছি। মন্ত্রী বিদেশে থাকা অবস্থায়ই সচিব আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে অনেক মন্ত্রনালয়ে সচিবগণ সিনিয়র সহকারী সচিব এর দায়িত্ব ও বন্টন করতে পারেন না। জনাব মুহিত এর পরিমিতিবোধ ছিল এমনই!

অতিরিক্ত সচিব হিসাবে শুরুতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রশাসন ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ এর। ক্রমান্বয়ে এর সঙ্গে সামষ্ঠিক অর্থনীতি এর দায়িত্ব ও পালন করি। সে সময় অনুসন্ধানে জানতে পারি যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ভ্রমণভাতা সংক্রান্ত একটি নথি দীর্ঘদিন ধরে বিবেচনাধীন আছে। অর্থমন্ত্রী এতে যৌক্তিক ভাবে বিভিন্ন দেশের শ্রেণীবিভাগ এবং কর্মকর্তাদের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছিল। আর বিলের মাধ্যমে বৈদেশিক ভাতা তোলার পরিমাণ ও থোক ভাতা গ্রহণ এর মধ্যে বড় ধরনের ফারাক থাকায় অনেক কর্মকর্তাই বিল বানানোর জন্য প্রলুব্ধ হতেন। অর্থমন্ত্রীকে এটি বুঝালে তিনি কোন পরিবর্তন ছাড়া তাৎক্ষনিক ৪০% ভাতা বৃদ্ধিতে সম্মতি দিলেন আর পরবর্তীতে থোক ভাতার পরিমাণ ও এর উপর প্রায় ৫০% বাড়িয়ে দিলেন। এতে অনেক কর্মকর্তাই টাকার অংকে কম হলেও বিল এর মাধ্যমে হোটেল ভাতা গ্রহণের চেয়ে থোক ভাতা গ্রহণে আগ্রহী হন।

২০১৪-১৫ সালের বাজেট প্রনয়ণকালে অতিরিক্ত সচিব বাজেট ছিলেন আমার ব্যাচমেট নিরীক্ষা ক্যাডারের রণজিৎ চক্রবর্তী। তিনি পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ (পি আর এল) এ যাবেন মে মাসে তাই তৎকালীন অর্থ সচিব পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক এর গভর্নর ফজলে কবির ফেব্রুয়ারি ২০১৪ থেকে আমাকে বাজেট প্রনয়ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করেন যাতে রণজিৎ চক্রবর্তী পি আর এল এ গেলেও বাজেট প্রনয়ণের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে। বাজেট এর আসলে দু’টি অনুবিভাগ, ১ ও ২, যার নেতৃত্ব দেন দুজন অতিরিক্ত সচিব, তাঁদের অধীনে তিন তিন ছয়টি অধিশাখা ও ছাব্বিশটি শাখা। ফলে অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) মূলতঃ একটি উর্ধ্বতন দায়িত্ব বা সুপিরিয়র চার্জ, মূল দায়িত্ব বাজেট প্রস্তুত, সমন্বয় ও অনুসরণ(মনিটরিং)।  আমি প্রায় চার বছর বাজেট এর দায়িত্বে ছিলাম। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ সালে বাজেট প্রনয়ণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ সালের বাজেট আমার তত্ত্বাবধানে তৈরী হয়। আমার সঙ্গে অত্যন্ত সমর্থ দুই অতিরিক্ত সচিব ছিলেন মুসলিম চৌধুরী (পরে সচিব অর্থ বিভাগ ও বর্তমানে মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক) ও শাহাবুদ্দিন আহমদ (বর্তমানে জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) এবং কিছুদিন সুধাংশু শেখর বিশ্বাস।

বাজেট প্রনয়ণ একটি বিস্তারিত প্রক্রিয়া যা অংশীজনদের সাথে নিয়ে সারা বছর ধরেই চলতে থাকে। পরিকল্পনা-পরামর্শ-বাজেট-বাস্তবায়ন-মনিটরিং-পরিকল্পনা এই চক্রে বাজেট এর কাজ চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ বিভাগ প্রায় ৬০টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় (পরিকল্পনা বিভাগসহ) সভা করে থাকে। এর আগে অর্থ মন্ত্রীর সভাপতিত্বে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা হয়ে থাকে যেখানে মূলতঃ সম্ভাব্য সম্পদ বা রিসোর্স সম্পর্কে একটি ধারণা গ্রহণ করা হয়। এই সভায় কর আহরণ এবং মূদ্রাপ্রবাহের বিষয়গুলোও আলোচিত হয়। জনাব মুহিতের একটি গুনগত ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ ছিল অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৯ প্রনয়ণ। সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরেও এই আইনটি প্রণীত হয় নাই যা’ উনার সময়ে হয়েছিল। বাজেট প্রনয়ণে অর্থ বিভাগ একটি বিস্তারিত বাজেট ক্যালেন্ডার প্রনয়ণ করে থাকে এবং বাজেট প্রক্রিয়ায় তা’ অনুসরণ করে থাকে। জনাব মুহিত এই ক্যালেন্ডারের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ  করতেন এবং প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করতেন। জনাব মুহিতের এই একটি গুণ ছিল অনন্য যে তিনি যে কোন বিষয়ের গভীরে যেতেন এবং কোন রকম “স্পুন ফিডিং” ব্যাতীরেকে নিজেই বুঝে নিতেন। তবে তিনি আলোচনার সুযোগ দিতেন এবং আলোচনাকালে যে কোন যুক্তিসংগত মতামত গ্রহণ করতেন।

মূল বাজেট দলিল প্রনয়ণে মূখ্য ভূমিকা ছিল বাজেটের দুই উইং এ আমার সহকর্মীদের। মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামো তৈরী করতেন সামষ্ঠিক অর্থনীতি অনুবিভাগের সহকর্মীগণ। সেখানে অনুবিভাগ প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থ মইনুল হোসেন। তবে বাজেট দলিল প্রস্তুত করার পাশাপাশি বাজেট বক্তব্য তৈরী করাও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি অনেক দিন ধরে চলতে থাকতো। প্রাথমিক খসড়া তৈরি করার পর এর উপর আরও অনেক কাজ করা হতো। আমার চার বাজেটের অভিজ্ঞতায় আমরা এতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে আমার দ্বিতীয় বছরে ২০১৫-১৬ সালের বাজেট বক্তব্য আমরা অনেকখানিই নতুনভাবে করার চেষ্টা করেছিলাম। দুইটি দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন ছিল বক্তব্যের আকার ছোট করে আনা আর ছক সমূহকে মূল বক্তব্য থেকে বের করে সংযুক্তি হিসাবে যুক্ত করা। এ জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীদের বাজেট বক্তব্য সংগ্রহ করে দেখাই। সে বছর আমরা তাই করতে সমর্থ হই। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের বাজেট বক্তব্য ও ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট তবে ২০১৭-১৮ সাল থেকে এটি আবার আগের আকারে ফিরে যায়।  তবে এই চার বছরেই লক্ষ্য করে অবাক হয়েছি যে তিনি কি গুরুত্বের সঙ্গে বাজেট বক্তব্যের প্রতিটি লাইনে অবদান রাখেন।  ২০১৬-১৭ সালে তিনি পূর্বাচলে বংগবন্ধু ট্রাই টাওয়ার করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং নিজ হাতে লিখে বাজেট বক্তব্যে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ও উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প বাস্তাবয়নের পদ্ধতি স্থির না হওয়ায় আমাদের পরামর্শে তিনি এ থেকে পিছিয়ে আসেন।

জনাব মুহিত এর একটি সুবিধা ছিল যে তিনি “আমলা থেকে রাজনীতিক” হলেও তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করতেন না। পদ ও পদবী অর্জন বা পদ রক্ষার রাজনীতি করতে আমরা কাছ থেকে দেখি নাই। আর ১৯৮১ সালে সরকারি চাকরি ত্যাগ করার পর যখন ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন তাঁর মাঝে কেটে গিয়েছিল অনেক বছর। মাঝে তিনি কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। এ বিষয়টি তাঁর মানসিকতাকে অনেকখানি প্রসারিত করতে পেরেছিল। আমরা সাধারনতঃ রাজনীতিকদের অর্থমন্ত্রীর নিকট আসতে দেখতাম না। তথাকথিত তদবিরকারকগণ ছিলেন অর্থ বিভাগে অনুপস্থিত। যে কারণে তিনি দাপ্তরিক কাজে অধিক সময় দিতে পারতেন। আমাদের কাছেও বাইরের কোন লোক কোন তদবির নিয়ে আসতো না। আর অর্থমন্ত্রী নিজে কাউকে আমাদের কাছে কোন কাজে পাঠিয়েছেন এ ছিল এক বিরল ঘটনা। ফলে বাজেট প্রণয়ণের ব্যস্ত সময়, ফেব্রুয়ারি-মে এই চার মাস আমরা নিজেদের কাজে যথেষ্ট মন দেবার  সুযোগ পেতাম। জনাব মুহিত নিজের কাজে ছিলেন অত্যন্ত মনযোগী। বেশিরভাগ কাজ নিজেই করতেন। অন্যের কাজ কে নিজের নামে চালানোর কোন ভনিতা তাঁর ছিলনা। তিনি যেকোন নথি মনযোগ দিয়ে দেখতেন। আমি প্রথম দিকে অবাক হতাম যে এটা কিভাবে সম্ভব যে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ নথিতে তিনি বিস্তারিত সংশোধনী যোগ করতেন বা কিভাবে তিনি দীর্ঘ তথ্যবহুল নোট লিখতে পারতেন!

পরে জানতে পারলাম যে তিনি অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নথি বাসায় দেখতেন, কারো সহায়তা ছাড়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি গভীর রাত পর্যন্ত নথি দেখতেন আর মাঝে মাঝেই পায়চারী করতেন, বসতেন, চিন্তা করতেন। এর পরেই এক একটি সুচিন্তিত বিস্তারিত নোট বা মন্তব্যের সৃষ্টি হতো। যে কোন দীর্ঘ পরিপত্র বা নীতি-দলিল তিনি প্রতি লাইন পড়তেন এবং মন্তব্য যোগ করতেন যার সবই ছিল আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী। তিনি যে কোন বিষয়ই নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখতে পারতেন। আমার ৩৭ বছরের সিভিল সার্ভিসে চাকুরিকালের ৫ বছরের বেশী চাকুরি করেছি জনাব মুহিত এর সঙ্গে। আমার চাকুরিজীবনে এর চেয়ে বেশী নৈর্ব্যক্তিক অথচ মানবিক আচরণ কোন সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনীতিক এর মধ্যে দেখিনাই। আমি সাধারানতঃ যা বলে থাকি তা হল “জনাব মুহিত এর কোন ব্যক্তিগত এজেন্ডা ছিল না”, তিনি যাই করতেন তা’ করতেন জনস্বার্থে!  এ জন্য অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে তিনি সিলেট অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট করেননি।  আসলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি সিলেটকে কখনও আলাদা করে দেখেননি। আর আমি বলতাম যে উনার তো কোন নিজস্ব ঠিকাদার গ্রুপ নাই, থাকলে তারাই নিজ স্বার্থে প্রকল্প নিয়ে আসতো পার করিয়ে দেবার জন্য। আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেটের জনগনের স্বার্থে যে সকল প্রকল্প প্রয়োজন তার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করেছেন যার অনেকগুলো বাস্তাবায়িত হচ্ছে আর কিছু এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

জনাব মুহিত এর যে বিষয়টি আমাকে অবাক করতো তা হলো প্রবল প্রাণশক্তি। বয়স হয়ে যাবার পরেও চলাফেরায় ছিলেন স্বচ্ছন্দ। একটু ঝুকে দ্রুত হাটতেন। একটি বহু ব্যবহৃত সাধারণ ব্যাগ বহন করতেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বার (সবমিলিয়ে তৃতীয়বার) অর্থমন্ত্রী পদে শপথ নেবার পর তিনি ছিলেন জেষ্ঠ্য মন্ত্রী, মন্ত্রীদের মধ্যে মানক্রমে জেষ্ঠ্য, তখন বয়সও হয়েছিল ৮০! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং তা’ প্রদর্শন ও করতেন। কিন্তু ঐ বয়সেও তারুণ্যের দীপ্তি নিয়েই তিনি পালন করেছেন দায়িত্ব। খেতে পছন্দ করতেন এবং কখনও কখনও আমাদের বারণ সত্ত্বেও খাও্যা উচিত নয় এমন খাবার থেকে বিরত থাকতেন না। দপ্তরে আসতেন নিয়মিত এবং দীর্ঘ সময় থাকতেন। আর বাসায় তো রাত তিনটা/চারটা পর্যন্ত কাজ করতেন। ঘুমাতেন রাত চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত।

পড়ালেখার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। তিনি এই পরিণত বয়সেও নিয়মিত পড়তেন, লিখতেন এবং নিজে বই কিনতেন। বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ তাঁর। তিনি বলতেন ১৯৫৭ সালে যখন সিএসপি হিসাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়তে যান তখনকার প্রচলিত ধারা অনুযায়ী তিনিও ভেবেছিলেন যে ফেরার সময় একটি মোটরকার নিয়ে ফিরবেন। ঐ সময়ের বেশিরভাগ সিএসপি কর্মকর্তা অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ এ পড়া লেখা শেষ করে ফেরার পথে একটি মোটরকার করাচী/চট্টগ্রাম এর পথে জাহাজে তুলে দিতেন। কেউ কেউ নিজেদের মোটরকার জাহাজে তুলে কোন বন্ধুর মোটরকারে করে ইংল্যান্ড থেকে স্থলপথে পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন যেমনটি লিখেছেন সুলতানুজ্জামান খান তাঁর স্মৃতিকথা, স্মৃতির সাতকাহন এ। জনাব মুহিত ৯৩ পাউন্ড স্টারলিং সাথে নিয়ে গেলেন গাড়ি কিনবেন বলে, ১৫০ পাউন্ড হলে একটি গাড়ি কেনা যায়। কিন্তু তখন পাকিস্তানের যিনি শিল্পমন্ত্রী তাঁর নিজের ছিল গাড়ির ব্যবসা। তাঁর নিজের ব্যবসার স্বার্থে গাড়ির ট্যারিফ মূল্য আর কর কাঠামো দুইই পরিবর্তন হলে গাড়ি নিয়ে আসা আর লাভজনক ছিলো না। কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী এক লিখায় লিখেছিলেন জনাব মুহিত একটি মরিস গাড়ী কিনেও করকাঠামো পরিবর্তন হওয়ায় তা ফেরত দিয়ে দেন পরিবর্তে তিনি নিয়ে এলেন জাহাজ ভর্তি বই! তাঁর পর সারাজীবনই বই সংগ্রহ করে গিয়েছেন আর নিজে লিখেছেন ও। সব মিলিয়ে তিনি অন্ততঃ ৫০০০০ বইয়ের সংগ্রহ রেখে গিয়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তাঁর পাঁচ পর্বে সমাপ্য আত্মজীবনী তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। দুই পর্ব শেষে আমরা অধীর আগ্রহে তৃতীয় পর্বের অপেক্ষায় ছিলাম।

একটি বিষয় অবাক করা যে তিনি ছিলেন সবসময় প্রাসঙ্গিক। অনেকে এটি বুঝাতে ‘ভাগ্যের বরপুত্র’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে কিন্তু কেবল এ শব্দবন্ধ দিয়ে তাঁর বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাবে না ১৯৪৬, সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত, আসাম প্রদেশ এর সিলেট পাকিস্তানে যুক্ত হতে চায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এলেন সিলেটে। মানপত্র দিলেন কিশোর আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ১৯৪৯ সালে প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৯৫১ সালে সারা পূর্ব পাকিস্তানে রেকর্ড নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ!! ১৯৫৪ ইংরেজী সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ে ইংরেজী অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ।.১৯৫৫ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। এম এ পাস করার পর কিছুদিন শিক্ষকতা করেন মুন্সীগঞ্জ হরগংগা কলেজে। ১৯৫৬ সালে সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিএসপি হন এবং ইংরেজীতে সারা পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশী নাম্বার পান। ১৯৫৯ সালে নিযুক্ত হন এসডিও বাগেরহাট পদে। ১৯৬১ সালে নিযুক্ত ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খান এর সঙ্গে আবার পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশন এর সেক্রেটারী পদে। ১৯৬৩-৬৪ সালে বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অধ্যয়ন করে মাস্টার্স ইন পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের উপর প্রতিবেদন প্রনয়ণ করেন যা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পেশ। ১৯৬৬ সালে লাভ করেন তমঘায়ে পাকিস্তান যা তিনি ১৯৭১ সালে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৬-৬৯ পাকিস্তান সিএসপি এসোসয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম বই ডেপুটি কমিশনারস ইন ইস্ট পাকিস্তান প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে ওয়াশিংটন এ পাকিস্তান দূতাবাসে ইকনমিক কাউন্সিলর পদে নিয়োজিত হন যে পদ থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাসে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। স্বাধীনতার পর অল্পদিন পরিকল্পনা সচিবের দায়িত্ব পালন করে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ১৯৭৪ সালে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ম্যানিলায় এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে দেশে ফিরে বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন যখন আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা। এরপর ১৯৮১ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সরকারি চাকুরি থেকে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে দুই দফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনি এসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব ও পালন করেন।

আর একটি ঘটনা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করবো। ২০০৯ সালে জনাব মুহিত যখন অর্থমন্ত্রী হলেন তখন তাঁকে হেয়ার রোডে একটি বাংলো বরাদ্দ করা হয়। তিনি বাংলো পরিদর্শন করলেন এবং থাকার জন্য পছন্দ ও করলেন। কিন্তু যখন যখন প্রয়োজনীয় সংস্কার এর পর যখন উঠলেন তখন দেখা গেলো যে বাংলোর আসবাব পত্র সব নতুন এবং প্রথম ভিজিটে যে সকল আসবাবপত্র দেখেছিলেন তার কিছুই নেই। আসলে প্রত্যেক মন্ত্রীর জন্য আসবাবপত্রের প্রাপ্যতা রয়েছে। ফলে একজন নতুন মন্ত্রী নিয়োজিত হলে তাঁর আবাসনের জন্য পূর্ণ সেট আসবাবপত্র সংগ্রহ করা হয়। তাহলে পুরনো আসবাব যায় কোথায়? এর কোন হিসাব রাখা হয়? নাকি পরিত্যাক্ত এবং রাইট-অফ করা হয়? তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর কাছে অনেকগুলো দফা উল্লেখ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পত্র দিলেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে যে কোন মন্ত্রী বাসা খালি করে দিলে তাৎক্ষনিক তার ভিডিও ধারন করা হবে এবং নতুন কোন মন্ত্রীকে বরাদ্দ দিলে ওই ভিডিও সহ তাঁকে দেখানো হবে। কোন আসবাব বা সকল আসবাব রিপ্লেস করতে হলে তা’ অনুমোদিত তালিকা থেকে চাহিদা পত্র অনুযায়ী করা হবে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয় নিশ্চিতভাবেই তা’ অনুসরণ করছেনা।

জনাব মুহিত ছিলেন স্পষ্টভাষী। যা মনে আসতো এবং তিনি বিশ্বাস করতেন তা’ তিনি বলতেন। বর্তমান সময়ে যখন কেউই নিজের কথা প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত তখনো তিনি যা বলার তা বলে দিতেন। বাংলাদেশের সব সময়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এর জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পাঁচগুণ বেশী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তিনি বিরোধী ছিলেন। তিনি এটা একনেক এবং মন্ত্রী পরিষদে বলেছেন ও। অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর অন্যতম বড় সাফল্য ছিল বাজেটের পরিমাণ বা সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। তিনি প্রবল সাহসিকতার সংগ প্রতি বছর বাজেটের আকার বিপুল ভাবে বাড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেটকে এক করতে এবং জেলা বাজেট প্রচলন করতে যা’ সকলের সহযোগীতা না পাওয়ায় সম্ভব হয়নি। তাবে তাঁর সময়ে জেন্ডার বাজেট ও শিশু বাজেট আমরা আলাদা ভাবে প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়েছিলাম। বিশেষ করে জেন্ডার বাজেট আলাদা ভাবে প্রদর্শন করায় আমাদের অবস্থান ছিল সার্ক দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে।

যে কথাগুলো বেশী উল্লেখ করা হলোনা তা’ হলো জনাব মুহিত এর ব্যাক্তিগত মহত্ব। আমি খুব কাছ থেকে তাঁর সঙ্গে পাঁচ বছরের বেশী কাজ করেছি। তিনি প্রায় সময়েই ঝলমলে পাঞ্জাবী পরতেন যার অধিকাংশই ছিল ইউনিক নকশার। তাঁর পুত্রবধু নিজে ছিলেন একজন নকশাবিদ আর মন্ত্রীমহোদয় পুত্রবধুর নকশা করা অনেক পাঞ্জাবীই পরেছেন। এই সময়ে অসংখ্য উপলক্ষ ছিল কাছে বসে কাজ করার বা সামনে বসে নির্দেশনা নেবার। এরকম সময়ে তিনি তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা থেকে যা ভাগ দিতেন তা’ অবিস্মরনীয়। তাঁর প্রবাদপ্রতিম স্মরণশক্তির সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। তিনি অবলীলাক্রমে ৪০/৫০ বছর আগের অসংখ্য ঘটনা দিন তারিখ সহ, অনেক ব্যাক্তির নামোল্লেখ সহ বলে যেতেন। তাঁর সমস্ত এপয়েন্টমেন্ট কারো উপর নির্ভর না করে তিনি নিজে ডেস্কটপ এ টাইপ করে গুছিয়ে রাখতেন। মিটিং এর শিডিউল সাধারণত মিস করতেন না। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল তাঁকে ফোন করলে ফোন ধরতে না পারলেও তিনি কলব্যাক করতেন যা তাঁর মতো ব্যস্ত মানুষের থেকে বিরল পাওয়া। এটা আমি যখন অর্থ বিভাগে কাজ করতাম না তখনও হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন, স্নেহ করতেন। আমার নিজের সমস্যাসংকুল সময়ে আমি তাঁর নিকট থেকে এমন সমর্থন পেয়েছি যা’ কখনো মন থেকে যাবে না। মহৎপ্রাণ মুহিত একজন অসাধারণ সিভিল সার্ভেন্ট, অক্লান্ত সংগঠক, জনকল্যাণমুখী রাজনীতিক, এবং অনন্যসাধারণ মানুষ ছিলেন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত