ভারতবর্ষ বিভক্ত: ভারত-পাকিস্তানের স্থায়ী সংঘাত

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২২, ০০:০১

সাহস ডেস্ক

মুঘলদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষমতার গদিতে আরোহণ করে ব্রিটিশরা। এর পরই চলতে থাকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের স্রোত-ধারা। আর এই শাসন টিকে থাকে প্রায় ১৯০ বছর। সমগ্র ভারতবাসী শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে, ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশরা দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম দুই ভাগে বিভক্ত করে সমগ্র ভারতবাসীর অন্তরে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্পকে স্থায়িত্ব দান করতে সক্ষম হয়।

১৯৪৭ এর ভারত ভাগ-
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগ করার দায়িত্ব ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র‍্যাডক্লিফের হাতে তুলে দেন। তিনি মাত্র ৫ সপ্তাহ সময়ে ভারত কে ভাগ করে ফেলেন। পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রদেশ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতের বাকি অংশ নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র। বাংলা ও পাঞ্জাব কে ভাগ করা হয়েছিল এখানকার হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমান সংখ্যক থাকার কারণে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আর এর মাধ্যমেই ভারত ভাগের ষোলকলা পূর্ণ হয়।

ভারত ভাগের কারণ-
ভারত বিভক্তির মুল কারন ছিল দ্বি-জাতি তত্ত। কংগ্রেস এর নেতৃত্বে ধাপে ধাপে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলন চলছিল। ব্রিটিশরা পরজায়ক্রমে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের হাতে কিছু ক্ষমতা ছাড়ছিলো, ক্রমেই ব্রিটিশ বিরোধী “ভারত ছাড়” আন্দলন দানা বাঁধতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু প্রমুখের নেতৃত্বে দুরবার গণ আন্দলন চলতে থাকে। ১৯০৬ সালের পূর্বে কংগ্রেস একক ভাবে আন্দলন করলেও ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পড়ে মুসলমানরাও ব্যাপক মাত্রায় শরিক হয়। প্রথমে মুসলমানরা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুই সংগঠনে জড়িত থাকতেন। পড়ে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে মুসলমানরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করতে থাকে। মুসলমানদের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়, স্বতন্ত্র জাতি স্বত্তার দাবি উঠতে থাকে। প্রথমে কংগ্রেস পাত্তা না দিলেও লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের পৃথক আবাস ভুমির দাবির মাধ্যমে এই দ্বি-জাতি তত্তের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই দ্বি-জাতি তত্তের বাস্তবায়নে ভারতকে হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

ভারত ভাগের ফলাফল-
ভারত ভাগের প্রতিক্রিয়াকে এক পাক্ষিক-ভাবে বিচার করা যায় না। কারণ ভারত ভাগকে মুসলমানরা দাবি করেছিল তাদের বিজয় হিসেবে এবং তারা বহুদিনের আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে আনন্দের জোয়ারে ভাসছিল। অন্যদিকে ভারতীয় হিন্দু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতে বিশ্বাসী মুসলিমদের মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। যদিও ব্রিটিশরা মনে করেছিল যে ভারতকে বিভাজনের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসন হবে। কিন্তু ভারত ভাগের পর পরই দেখা যায় পাঞ্জাব ও বঙ্গ প্রদেশের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা যা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও নাজুক করে দেয়, দীর্ঘমেয়াদী অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ব্রিটিশরা ভারতকে ভাগ করার সময় কিছু বিষয় অমীমাংসিত অবস্থায় রেখে যায়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার উদ্ভব হয়। যেমন কাশ্মীর- ভারত ভাগের সময় কাশ্মীরের মত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অবস্থান কি হবে তা না বলে দেয়ার জন্য কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিবাধ শুরু হয় যা আজো বর্তমান। তাছাড়া ভারত ভাগের সময় কেন্দ্রীয় সম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্রের মত বিষয়গুলো কিভাবে বণ্টন হবে তা পরিষ্কার ছিল না ফলে উভয়ের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার কারণে এসব অঞ্চলের মানুষের মনে নিজ জাতিসত্তা ভেঙ্গে যাবার ক্ষোভ দানা বাধে। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ অন্য জাতিসত্তার শাসনকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের মত স্বাধীন দেশের উত্থান হয়। এর পিছনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল পাকিস্থানীদের শোষণ বঞ্চনা।

ব্রিটিশরা অতি সাধারণ বাণিজ্যিক বেশে এদেশে আসলেও তাদের চলে যাওয়াটা ছিল অত্যন্ত নাটকীয়। তারা আসার সময় একটি অখণ্ড ভারতে আসলেও চলে যাওয়ার সময় তা খণ্ড বিখণ্ড করে রেখে যায়। আর ভারত খণ্ডিত হওয়ার সকল রসদ যুগিয়েছিল তারাই। কারণ তারাই পরোক্ষভাবে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে। তারা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিকে ভয় পেত, যদি সম্মিলিত আন্দোলন তাদের পতন ঘটায়, যা ভারত ভাগ করার কালেও টিকিয়ে রাখে। পরবর্তী সময়ে ভারত ভাগের পর এই সম্প্রীতি আর গড়ে উঠেনি বরং তা চরাই উতরাই পেরিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়ে আজো টিকে আছে। যা বর্তমানের ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত সমস্যা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, খেলাধুলা সব জায়গায় আছে। কবে এই আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা শেষ হবে তা এখনি বলা যাচ্ছে না। তবে সকল শান্তি-প্রিয় মানুষ চায় এই উত্তেজনার সমাধান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত