মহাসাগর বাঁচাতে যৌথ প্রচেষ্টা চাই

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২২, ১৩:৪৩

সম্মোহন ঋক

অনেকটা অগোচরেই চলে গেলো বিশ্ব সমুদ্র দিবস। সারাদেশ থেকে এবারের সমুদ্র দিবস পালনের দু’একটি খবর এসেছে বৈকি তবে যেভাবে সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে সেরকম বাংলাদেশে হয়নি। তবে বরাবরের মতো পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সমুদ্র দিবসের আয়োজনটি ছিলো ব্যতিক্রম। সংগঠনটি দেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলি উপজেলায় স্থানীয় সমুদ্র তীরবর্তী মানুষদের মাঝে সচেতনতা তৈরির জন্য আলোচনা সভা ও শপথের আয়োজন করে। তালতলি উপজেলা মিলনায়তনে সমুদ্র দিবসের আয়োজনে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সংগঠনের চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় বিভিন্ন ইউনিয়নের বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা, কাব, বয় ও রোভার স্কাউটস্-এর সদস্যরা, গার্লস্ গাইড-এর সদস্যরা এবং স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। আলোচনা শেষে সবাই মিলে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে পানি ছুয়ে ‘সমুদ্র দূষণ করবো না’-বলে শপথ করেন। পরে ইসাবেলার গবেষকরা বঙ্গোপসাগরের জেগে উঠা একটি দ্বীপ (স্থানীয় নাম সোনাদ্বীপ) পরিদর্শন করেন। সমুদ্রকে দূষণমুক্ত রাখতে ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সমুদ্র দিবসের আয়োজনের মত প্রতিনিয়তই সমুদ্র নিয়ে এরকম সচেতনতামূলক আয়োজনের বিকল্প নেই।

সমুদ্রের সাথে মানবজীবনের নিবিড় এক সম্পর্ক বিরাজমান। সমুদ্র হলো উদ্ভিদের ভান্ডার, বহু প্রজাতির প্রাণি এবং গুরুত্বপূর্ণ জীবের আবাসস্থল। যা পৃথিবীকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে।   বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুসারে, মহাসাগরে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণী আছে। প্রকৃতপক্ষে সামুদ্রিক ও জলজ প্রাণীর সংখ্যা নির্ণিত সংখ্যার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মহাসাগরের জীব-বৈচিত্র্য। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০ মিলিয়ন মানুষ সমুদ্র ভিত্তিক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হবে বলে অনুমান করেন বিশেষজ্ঞরা। তবুও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিনিয়ত সমুদ্রের ক্ষতিসাধন হচ্ছে যার মধ্যে অন্যতম হলো: প্লাস্টিক, কলকারখানার বর্জ্য, তেল দূষণ ইত্যাদি।

২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা UNEP থেকে ‘বিশ্বের প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন নদী ও শাখানদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণগত দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম। এই প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ সমুদ্রের সৌন্দর্য্য নষ্টের পাশাপাশি সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানের ক্ষতিসাধন করে। প্লাস্টিক কণাকে খাদ্য ভেবে মাছ তা গ্রহণ করে এবং ফলশ্রুতিতে বিষাক্ত প্লাস্টিকের নানা রোগে আক্রান্ত হয়। গবেষণামতে প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করায় সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন বাঁধাগ্রস্ত হয়। এই যে প্রতিনিয়ত সমুদ্রে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্য জমা হচ্ছে এর পেছনে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা অন্যতম কারণ। কেননা সাধারণ মানুষের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক দ্রব্য নদীনালার মাধ্যমে বাহিত হয়ে সমুদ্রে পৌঁছায়। তাই আমরা যদি পরিকল্পিতভাবে প্লাস্টিক দ্রব্য recycling প্রক্রিয়ার জন্য সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি তাহলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

কলকারখানাগুলো সাধারণত নদী কিংবা খালের আশেপাশে তৈরি করা হয় যেন সহজেই বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে যে সমস্যা ঘটে সেটা হলো এই বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে কোন বিধিনিষেধ মান্য করা হয় না। যার কারণে অপরিকল্পিতভাবে বর্জ্য পদার্থগুলো নদীনালার জলের সাথে বাহিত হয়ে একসময় সমুদ্রে জড়ো হয়। এই বর্জ্য পদার্থগুলোর মধ্যে থাকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন: পারদ, সীসা ইত্যাদি। এইসকল পদার্থ সমুদ্রে থাকা জীবের দেহে প্রবেশ করে বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কলকারখানার বর্জ্য অপসারণে যেন নীতিমালা মেনে চলা হয় এই বিষয়ে সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের সচেতন থাকা অতীব জরুরী। আমাদের আশেপাশের এলাকায় হয়তো এমন কলকারখানা থাকতে পারে যা নদীর সাথে যুক্ত। সেই কলকারখানার বর্জ্য নিয়ম মেনে অপসারিত হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে আমরা লক্ষ রাখতে পারি। এছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোতে প্রতিনিয়ত বিপুল সংখ্যক জাহাজ আসা যাওয়া করে। জাহাজে থাকা বিভিন্ন ধরণের বর্জ্য পদার্থ কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যেখানে সেখানে নিষ্কাশিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধি থাকলেও বেশিরভাগ সময় সেগুলো মানা হয় না। কর্তৃপক্ষ যেন নিয়মনীতি পালনে সচেষ্ট হয় সেই বিষয়ে প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে কেননা এইভাবে বঙ্গোপসাগরের দূষণ ঘটতে থাকলে অচিরেই সমুদ্র তার বৈচিত্র্যতা হারাবে। এভাবে চলতে থাকলে এই পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য।

আমরা যারা এই মুহূর্তে বেঁচে আছি তারা হয়তো একসময় এই পৃথিবীতে থাকবো না। কিন্তু সমুদ্রকে আমরা যেভাবে পেয়েছি তার থেকেও সুন্দরভাবে নতুন প্রজন্মকে উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত