মুক্তিযুদ্ধের অজানা স্মৃতিকথা: ০১

৫০ বছরেও স্বীকৃতি না পাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধার আত্মস্মৃতি

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:২৮ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ২২:১৪

অনলাইন ডেস্ক

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল শনিবার, আমার মনে আছে সেই দিন সকাল দশটায় সর্ব দলীয় সংগ্রাম কমিটির বৈঠক হবার কথা ছিল। তাই বাড়ি থেকে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। অনুমান সকাল ৯টা হবে, আকাশে বিমান চক্কর দিচ্ছে। আর হলুদ এক জাতীয় পদার্থ বিমান থেকে ফেলছে। বুঝতে পারলাম বিপদ ঘনিয়ে আসছে। তখন সকালে গফরগাও হাট বসে, মানুষ গিজ গিজ করছে। এর মধ্যে বিমান থেকে শেল ও বোমা ফেলতে থাকল। আমরা সবাই জান বাঁচানোর জন্য ছুটাছুটি আরম্ভ করলাম। এক দিকে মানুষের কান্না অন্য দিকে চারদিকে হতাহত মানুষের স্তুপ।

দেখলাম ব্যবসায়ী আব্দুল ব্যাপারী চিৎকার করে মানুষ কে সরে যেতে বলছে, তার দালানে বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়ছে, তিনি নামাতে গেলে পাশেই বোমা বিস্ফোরিত হলো, তার ডান পাশ উড়ে গেল। আমরা ধরাধরি করে পুরাতন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সেখান থেকে মধ্য বাজারের দিকে দৌড় দিলাম, সামনেই একটি লাশ চিনতে দেরী হলো না। যমুনার মা, বাজার পরিস্কার করত। তার মাথার ঘিলু, নাড়ি- ভুড়ি বের হয়ে রাস্তায় পরে ছিল। আমি সব একত্র করে টুকরি দিয়ে ঢেকে দিলাম। বিমান চলে গেলে বেঁচে যাওয়া মানুষরা ছিন্ন ভিন্ন লাশ একত্র করে নদীর পাড়ে মাটি চাপা দিলাম। আহত মানুষ নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাদের আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

এসময় আমাদের এলাকার বিমান বাহিনীতে চাকুরী করা এক ছেলে আনিস নাম, সে এগিয়ে আসল। সে কিছুদিন আগে করাচী থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। সে তখন আমাকে নিয়ে স্টেশনে গেল। ময়মনসিংহ থেকে একটি ইঞ্জিন ও কামরা আনার ব্যাবস্থা করল। আমরা দুজনে মিলে আহত রোগীদের ময়মনসিংহ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম সাথে আহতদের দু-একজন নিকটাত্মীয় গেল। আহতদের মধ্যে একজনের নাম মনে আছে সে ডাঃ জগদিশের ভাতিজা মিন্টু। তার এক পাশ দিয়ে শেল ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সেদিনের ঘটনায় কম পক্ষে ২৫/৩০ জন মানুষ শহিদ হয়েছিল।

গোরস্থানের মত নিরব হয়ে গেছে গফরগাও বাজার। বাড়িতে আসলাম। জামা কাপড় রক্তে লেপ্টে গেছে। শরীর ভীষন খারাপ হতে লাগল। সাবান দিয়ে গোসল করে পরিস্কার হলাম। রাতের খাবার খেয়ে মার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, দশটার দিকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার উদ্দেশ্য হালুয়াঘাট হয়ে ভারতে ঢুকব।

ভোর ছটায় ময়মনসিংহ পৌছলাম। সেখানেও মানুষের আনাগোনা কম। শম্ভূগঞ্জ খেয়া পার হয়ে বাজারে পৌছলাম। এক যুবকের সাথে দেখা হলো সে যাত্রা দলের নায়ক, সিলেট থেকে এসেছে। সেও ভারতে যাবে, মনের সাহস দ্বিগুন হয়ে গেল। দুজনে হালুয়া ঘাটের দিকে রওনা হলাম। পথে একটি ট্রাক পেলাম, সেটিতে উঠে পড়লাম। ১৮ই এপ্রিল গাছুরি পাড়া হয়ে ডালুতে পৌছলাম। ডালু ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। সেখানে দেখা হল গফরগাওয়ের প্রথম শহীদ বেলালের ছোট ভাই ছাত্রনেতা আলালের সাথে। সেখানে দুই দিন অবস্থান করে অন্য দিকে হাটা শুরু করলাম। পাহাড়ের পাদ দেশ দিয়ে হাটতে হাটতে বাঘ মারা শরনার্থী শিবিরে পৌছলাম। সেখানে শুনলাম মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) “নবজোগ” অপেরার মেয়েদের আটকে রেখেছে। আমি ও যাত্রা দলের নায়ক হেম ঘোষ কে সাথে নিয়ে হেটে ও লঞ্চে করে আবার মহিষ গুলা হয়ে ধর্মপাশা হয়ে মোহনগঞ্জ পৌছলাম সন্ধায়। পৌছে যাত্রা দলের মেয়েদের খুজতে লাগলাম। এবং তাদের পেয়েও গেলাম, তবে তাদের কেউ আটকে রাখেনি। জীবন বাঁচাতে তারা একটি গুদামে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের অভিভাবক দের সাথে আলাপ করে রাতেই নৌকায় করে রওনা হলাম। তাদের সব অলংকার আমার কাছে রক্ষিত ছিল।

নৌকা চলছে কারো চোখে ঘুম নেই। মুক্তারপুর নামে এক জায়গায় দেখলাম তিন চারটা নৌকা আমাদের দিকে আসছে। মাঝিরা বলল এরা বোধ হয় ডাকাত, একথা বলার সাথে সাথে দেখলাম নৌকা গুলো আমাদের নৌকা ঘিরে ফেলেছে। আমি আস্তে করে পানিতে নেমে পড়লাম। ডুব দিয়ে, সাঁতার কেটে ডাঙ্গায় উঠলাম। সকালে নৌকার খোজ করলাম, কিন্ত কোথাও পেলাম না। সারা রাত পানিতে থেকে শরীর সাদা হয়ে গেছে, কোন শক্তি পাচ্ছিলাম না। রোদের তাপে কিছুক্ষন পর একটু বল আসল , আমি নদীর পাড় ধরে হাটতে লাগলাম। কিছুদুর পর একটি বসতি পেলাম, মনে হল হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা। তারা জানালো এই এলাকার নাম নজরপুর।

আরো জানতে পারলাম এ গ্রামের সব চেয়ে ধনী ব্যাক্তি হেম চন্দ দাশের বাড়িতে কিছু যাত্রার মেয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমার কথা কেউ মনে করেনি। বিচিত্র এই জগত, আর বিচিত্র মানুষের মন।

ভাগ্য ভালো যে বাড়ীতে মেয়ে গুলো আশ্রয় নিয়েছে সেই হেম চন্দ্র গফরগাওয়ের আঠারো দানা গ্রামের দাস বাড়িতে বিয়ে করেছে। সেই সুবাদে হেম বাবু আমাকে বড় শ্যালক বলে সম্বোধন করতেন। নজরপুর গ্রামটা নদীর ধারে। দিনে স্পিড বোট দিয়ে পাঞ্জাবীরা আনা গোনা করতো।

তাই মনের মধ্যে ভয় ছিল কখন যেন পাঞ্জাবীরা আক্রমন করে। সবাই মিলে স্থির করলাম আজ রাতেই ভারতে রওনা হব। সেই অনুসারে নৌকা ঠিক করা হল। সবাই মধ্য রাতে আল্লাহর নাম নিয়ে নৌকা ছেড়ে দিলাম। সকালে আমরা রাধা ঘাটে পৌছলাম। সেখান থেকে পায়ে হেটে ভারতের বট ছড়ায় প্রবেশ করলাম। আমাদের দলে পুরুষের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশী ছিল। সবাই বন জঙ্গল , পাথরের পাহাড় পার হয়ে ওয়ারেংকা নামক এক জায়গায় এসে থামলাম। সেই জায়গাটি খাসিয়া রানীর অধীন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ঝোপ , জঙ্গল কেটে থাকার মত ঘরের ব্যবস্থা করা হল। এই ক্যাম্পের পাশে পাহাড় থেকে রাতে বাঘের গর্জন শোনা যেত। জুলাইয়ের দিকে বন্যার পানির মত মানুষ আসতে লাগল। মানুষ যত আসছে, রোগের প্রকোপ তত বাড়ছে। আমাশয়, কলেরা, ডায়রিয়ার মত রোগে বেশি মানুষ মরতে থাকল। ঝোপে জঙ্গলে লাশ আর লাশ। ইচ্ছে ছিল মুক্তিযুদ্ধে যেতে কিন্তু এই অসহায় মানুষ দের ছেড়ে যেতে মন সায় দিল না। জুনের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুর দিকে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে গেলে পাহাড়ের রানী রেজিনা, কাছাড় জেলার বালাট থানা অফিসার পার্থ বাবু, বি এস এফ কমান্ডার  বি, আর, খান  উনাদের নিয়ে বৈঠকে বসলাম। স্থির হল রেড ক্রস কে খবর দিতে হবে। তাই হল, সে মোতাবেক আমাকে ১৫ দিনের ট্রেনিং এ দিয়ে কিভাবে স্যালাইন পুশ করা হয়, কিভাবে তৈরি করতে হয়, ইত্যাদি শিখিয়ে মাঠে ছেড়ে দেয়া হল। আল্লাহর নাম নিয়ে কাজে ঝাপিয়ে পড়লাম। মানুষের সেবায় ওয়ারেংকা, পানছড়া, মনাই এই তিন শরনার্থী শিবিরের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হল। মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের কেও সেবা দেয়া লাগত। অনেক লাশের কোন নিকটাত্মীয় ছিল না এসবের সৎকারের ব্যবস্থা করতে হত। দিন যত যাচ্ছিল শরনার্থীর সংখ্যাও বাড়তে লাগল। আমাদের তিন শরনার্থী ক্যাম্পে তাহেরপুর ও সুনামগঞ্জের মানুষ বেশি ছিল। এখানে একটি ঘটনার কথা এখনো মনে আছে, ওস্থাদ সুরকার গোপাল দত্ত কলেরায় আক্রান্ত হলেন। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। আমি, তার প্রিয় শিষ্য আদিত্য, বারী সিদ্দিকী ওস্তাদের সেবায় রাত দিন অতিবাহিত করছিলাম। কিন্তু অসুখ সারার কোন লক্ষন নেই। আমরা রানী রেজিনার শরনাপন্ন হলাম। বিস্তারিত বলার পর রাতেই সে শিলং লোক পাঠালো স্যালাইন আনার জন্য। পর দিন স্যালাইন নিয়ে লোক ফিরল। সেই স্যালাইন পুশ করার পর ওস্তাদ আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল। ওস্তাদের আরেক  জন শিষ্য ছিলেন তিনি হলেন লোক সংগীত শিল্পী বারী সিদ্দিকী। দুজনেই নেত্রকোনার বাসিন্দা। স্বাধীনতার পর গোপাল দত্ত বেতার ও টেলিভিশনে খেয়াল পরিবেশন করতেন। এখন বারী সিদ্দিকীর নাম সবাই জানে, গুরুর প্রতি শিষ্যের যে ভক্তি তা অতুলনীয়।

প্রায় নয় মাস সেই পাহাড়ের পাদদেশে কাটিয়েছি, তখন মনে হতো হয়তো কোন দিন দেশে যেতে পারব না। কত লাশ পুড়িয়েছি তার হিসাব নেই। একটা লাশের কথা মনে আছে সেই ভদ্রলোক মুসলমান, বাড়ি গাজীপুরের শ্রিপুরে। সে সুনামগঞ্জের কৃষি ব্যাংকের পিয়ন। তার একমাত্র ছেলে কলেরায় মারা গেছে তার বয়স দুই বছর। সে আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল, তার ছেলেকে যেন কবরের ব্যবস্থা করা হয়।

সেখানে কবর দেবার মত পরিবেশ নেই। চার দিকে পাথুরে জমি। তাকে বললাম দুটি শাবল জোগাড় করতে। তারপর দুজনে মিলে চার ঘন্টা শাবল চালিয়ে এক ফুট মত গর্ত তৈরি করে, লাশটি সাদা কাপড় দিয়ে পেঁচালাম। কিন্তু জানাজার মানুষ নেই। এ সময় দেখলাম দুজন লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, তারা জানালো তারা মুসলমান। একজন সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন বরকত এবং তার ছেলে নেক বরকত। তাদের নিয়ে আমার ইমামতিতে জানাজা শেষ করলম। হাজার হাজার মানুষ, হাজারো ঘটনা, সব মনে নেই। যাত্রার মেয়েদের মধ্যে অঞ্জলী বন্দনা আমাদের সাথে থাকত তার মা সহ। কে হিন্দু কে মুসলমান সব ভুলে গিয়ে শুধু ভাবতাম আমরা মানুষ। ওয়ারেংকা ক্যাম্প আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায়। যা পরবর্তীতে মানুষের সেবা করার মন মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে।

নভেম্বরের প্রথম দিকে সকাল ১০/১১ টা হবে, মাথায় স্যালাইন, হাতে ঔষধের পুটলা নিয়ে পানছড়ি শরনার্থী ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলাম, সেখানে মোহনগঞ্জের কিছু লোকের মধ্যে কলেরা দেখা দিয়েছে। তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। হঠাৎ দেখি ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে হেটে হেটে যাচ্ছে। কাছে আসতেই সবাইকে চিনতে পারলাম। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ফজলু (বাড়ি মিগুয়ারি ইউনিয়ন), মফিজুল হক চেয়ারম্যান, সলিম চেয়ারম্যান (মশাখালী ইউনিয়ন), কছিম উদ্দিন নাম না জানা আরও অনেকে। প্রায় ছ'মাস পর এলাকার মানুষকে পেয়ে আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলাম। তাদের কাছে জানলাম ভিতরে যুদ্ধ করে তাদের গোলা বারুদ শেষ হয়ে গেছে, তাই তারা ভারতে এসেছেন গোলা বারুদের জন্য। ছাত্রনেতা বেলাল ও অনিল কে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা করেছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাদের সাথে রাজনৈতিক মিল ছিল না তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের অনুসারী আর আমি ভাসানী ন্যাপের কর্মী। কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা দুজনেই এক মত ছিলাম।

আরো শুনলাম পাকিস্তানী বাহিনী চর আলগী ইউনিয়ন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার যতটুকু সাধ্য তাদের আপ্যায়ন করে বিদায় দিলাম। তারা বালাটের দিকে রওনা হল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আর ভাবলাম কোন দিন কি তাদের পরিবার পরিজনের সাথে দেখা হবে?

চলবে....