জাতিসংঘের হীরক জয়ন্তীতে ইমরান খানের গলাবাজি

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৭:২৩

হাসান ইবনে হামিদ

জাতিসংঘ বিশ্ব জাতিসমূহের একটি সংগঠন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার ও নীতির উপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সকল মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করাই এর উদ্দেশ্য। তাই জাতিসংঘের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে যখন একজন রাষ্ট্রনায়ক কথা বলেন তখন তা এক বিশেষ বার্তা হিসেবে ধরা হয়। জাতিসংঘের হীরক জয়ন্তীতে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভাষণ দিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আগে থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, কাশ্মীর ইস্যু বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘের মতো বড় প্লাটফর্মকে কাজে লাগাতে চাইবেন তিনি, হয়েছেও তাই। তিনি কাশ্মীর ইস্যুকে সামনে এনে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে তিনি এমন কিছু শব্দচয়ন করেছেন যা একেবারেই অনভিপ্রেত এবং মধ্যযুগীয় মানসিকতার প্রতিফলন। জাতিসংঘ এর আগেও ২০১৯ সালের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এই ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে এবং তখনো বক্তা ছিলো সেই ইমরান খানই! একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এসেও শান্তির পরিবর্তে হুমকি এবং ঘৃণাভরা বক্তব্য এখন আর কেউ দেয়না কিন্তু ইমরান খান ঠিকই দিয়ে যাচ্ছেন! তবে এই ভাষণ নতুন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে সবাইকে, যে প্রশ্নগুলোর জন্মদাতা খোদ পাকিস্তানই।

দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে আমরা প্রায়ই উত্তেজনা দেখি এবং রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করার বক্তব্যও শুনি। তবে তা শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য একবিংশ শতকের এই যুগে এসেও সম্মুখ যুদ্ধের সরাসরি হুমকি শুনতে হলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কাছ থেকে। জাতিসংঘের মতো ফোরামে তিনি সরাসরি বলেছেন, ভারতের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা যা খুবই নীচুমানের কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ! পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কের পুরো বক্তব্য ছিলো হিংসা আর বিদ্বেষের! পুরো বক্তব্যে ইমরান খান পাকিস্তানের তলাবিহীন ঝুড়ির দিকে না তাকিয়ে গলাবাজি করে গিয়েছেন। যে সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আগামীর বিশ্ব কিরকম হবে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সেখানে শুধুই বিদ্বেষ আর হিংসাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন ইমরান খান। মিথ্যে, যুদ্ধে উস্কানিমূলক কিছু বিভ্রান্তিকর বক্তব্য বিশ্ববাসীর কাছে তিনি তুলে ধরেছেন যা খুবই অপ্রীতিকর ও অগ্রহণযোগ্য। 

জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইমরান খান এথনিক ক্লিঞ্জিং এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার এর ব্যাপারে ভারতের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কি নিজের দেশ বা ব্যক্তি ইমরানের আদর্শিক জায়গা থেকে দিয়েছেন? কারণ তার বক্তব্য ছিলো পুরোটাই দ্বিচারিতামূলক। একদিকে আপনি নিজের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করবেন অপরদিকে মেকি মানবতার বাণী শুনাবেন, তা কপটতা এবং ভন্ডামি। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে মাইনোরিটি কমিউনিটি ছিলো ২৩% যা আজ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩% এ। খ্রিস্টান, শিখ, আহমাদিয়া, হিন্দু, শিয়া, পশতুন, সিন্দিজ, বেলুচিসসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা মধ্যযুগীয় বর্বর ব্লাসফেমি আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট। নিজ দেশে যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের নির্মূল করা হচ্ছে সেখানে বিশ্ব মানবতা সম্পর্কে কিভাবে শিক্ষা দিতে আসেন ইমরান খান?

ইমরান খান সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে দায়মুক্তির দিকে হেঁটেছেন। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের পদক্ষেপের কথাও বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কি বলছে? আসুন একটু দেখে নেই। জাতিসংঘের তালিকায় থাকা ১৩০ জন জঙ্গি ও ২৫টি জঙ্গি সংগঠনের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান এবং তারা যে এখনো তাদের দেশেই রয়েছে সেটা হয়তো ইমরান খান ভুলে গিয়েছেন, হয়তো ভুলে গিয়েছেন পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র সরকার যারা জাতিসংঘের নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা আল-কায়দাকে পেনশন দেয়। জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই তৈয়বা প্রধান হাফিজ সইদ, জইশ ই মহম্মদের মাসুদ আজহাররা জামাই আদর পেয়ে আছে পাকিস্তানে, পাকিস্তান সরকার তো স্বীকার পর্যন্ত করতে নারাজ যে তারা জঙ্গি! সবচেয়ে বড় সার্কাসটি ছিলো, জাতিসংঘ যে শহরে অবস্থিত সেই নিউইয়র্ক শহরটিই পাকিস্তান জঙ্গিবাদের সবচাইতে বড় ক্ষত চিহ্ন বহন করে চলছে। এই শহরটিতেই টুইন টাওয়ারের ধ্বংসযজ্ঞ রয়েছে যার মূল হোতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তান লালন পালন করেছিলো। বিশ্ববাসীই দেখেছে, মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লাদেন পাকিস্তানের খাইবার পখতুনের এবোটাবাদেই ছিলো। আর গত জুলাইয়ে স্বয়ং ইমরান খান ওসামা বিন লাদেনকে শহিদ আখ্যা দিয়েছে নিজ দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে। আরেকটি তথ্য সবার জানা দরকার, এই নিউইয়র্ক শহরেই পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকের অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতায় কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে। ইমরান খানকে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বসমক্ষে তিনি স্বীকার করেছিলেন, পাকিস্তানে এখনও ৩০ থেকে ৪০ হাজার জঙ্গি রয়েছে, যারা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তান ও জম্মু-কাশ্মীরে ভারতের অংশে হামলা চালাচ্ছে৷ এতো কিছু সহজেই কিভাবে ভুলে যায় পাকিস্তান! ভুলে যান ইমরান খান!

এখানেই শেষ না, ব্যক্তি ইমরান কিভাবে নিজের রাজনীতির সাথে জঙ্গিবাদী নেতাদের জড়িয়েছেন তা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার। পাকিস্তান ‘তেহরিক ইনসাফ পার্টি’ বা পিটিআই গঠনকালে ইমরানের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন তালেবান ও আল-কায়েদা। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল জামায়াত-ই-ইসলাম ও কওমি ওয়াতানের সঙ্গে আঁতাত করে খাইবার পাকতুন খোওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এটা হচ্ছে সেই খাইবার পাকতুন খোওয়া যেখানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ওসামা বিন লাদেনকে লালন করেছিলো। এখানেই আল কায়েদার শক্তিশালী ঘাঁটি যা এখনো বিদ্যমান। নির্বাচনে তাকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল তালেবান ও আল-কায়েদা গোষ্ঠী । মোল্লা ওমর ও জালালুদ্দিন হাক্কানির মতো তালেবান জঙ্গিরা তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকেই পড়াশোনা করেছে। এমনকি এবারের নির্বাচনেও পাকিস্তানে ধর্মীয় ডানপন্থীদের সরাসরি আনুকূল্য পেয়েছে ইমরান।

‘তালেবানের জনক’ খ্যাত মাওলানা সামিউল হক ইমরানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তবে এনিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি সামিউল হকের সঙ্গে জোটবেঁধে। চলতি মাসের শুরুর দিকে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-মুজাহিদিন প্রকাশ্যেই ইমরান খান ও তার দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের সাথে হাত মেলানো কোন রাষ্ট্রপ্রধান যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলবেন তখন সেটা নিতান্তই হাসির খোঁড়াক। আয়নায় ইমরান খান হয়তো নিজের চেহারাটা দেখেন নি, চেহারাটা দেখলে ভুলো মনা ইমরান খান হয়তো নিজেকে চিনতে পারতেন, চিনতে সহজ হতো তার জাতকেও!

৭৫তম সাধারণ পরিষদের বক্তব্যে ইমরান খান ধর্মান্ধতার নোংরা কার্ড খেলার চেষ্টা করেছেন। ইমরান খান কাশ্মীরের মুসলমানদের নিয়ে বলেছেন, কিন্ত চীনে শত বছর যাবত মুসলিম উইঘুর সম্প্রদায়ের নির্যাতন নিয়ে টু শব্দটিও উচ্চারণ করেন নি। কিন্তু কেন? কারণ চীন তার বন্ধু রাষ্ট্র এবং ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনকে তার সবার আগে দরকার তাই। এমনকি সৌদী আরব দ্বারা ইয়েমেনে ঘটা স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যা নিয়েও কিছুই বলেন নি কেননা সৌদি অর্থায়ন তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে।

জাতিসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মানবতার বুলি কপচানোর আগে একাত্তরে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। তার সে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে বাংলাদেশে সংঘঠিত সবচেয়ে কম সময়ে বড় গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি। সুযোগ ছিলো পাপমুক্ত হওয়ার। গোড়া কেটে দিয়ে আগায় পানি ঢাললে তো হবে না। আর তাই মানবতার বুলি বিশ্বকে শুনাতে হলে আগে নিজে পাপমুক্ত হয়ে আসতে হবে। সেটা করার জন্য তাকে অবশ্যই নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাসের বর্বরোচিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য। এই ‘ইসলাম আর মুসলিম’ আর ‘ইসলামো ফোবিয়া’ শব্দচয়নে যারা গলে যাচ্ছেন তাদেরকে ভালো করে একাত্তরের সময়টার কথা স্মরণ করাতে চাই। এই ইসলামের কথা বলেই পাকিস্তান আমাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিলো, ইমরান খান নিয়াজির দুঃসম্পর্কের চাচা আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর হাত রাঙা হয়েছিলো আমাদের রক্তে।

গত ৭০ বছরে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মতো পাকিস্তানের কাছে কি আছে? তাদের একমাত্র গৌরব হল, সন্ত্রাসবাদ, আদিবাসীদের নির্মূল, সংখ্যাগুরু মৌলবাদ, পরমাণুর গোপন ব্যবসা আর সাম্প্রদায়িকতার তীর্থভূমি হিসেবে গোটা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরা! তাই জাতিসংঘের মঞ্চে মেকি মানবতা দেখে বিগলিত নাহয়ে ইমরান খান এবং পাকিস্তানের ইতিহাস জানুন, নিজের ইতিহাস জানুন, নিজেকে চিনুন।

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত