আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস ও মহাত্মা গান্ধি

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২০, ১৮:৩৯

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর গুজরাটের পোরবান্দরে যার জন্ম। ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ, ভারতের আজাদী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের অন্যতম একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। যার মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের আন্দোলন ঘোষিত হয়েছিল। এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের উপর এবং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি, সারা বিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা।

তার এই অহিংস মতবাদকে স্বীকৃতি দিতেই তার জন্মদিনকে জাতিসংঘ ঘোষিত 'আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস' হিসেবেও পালিত হচ্ছে। ২০০৭ সালের ১৫ জুন রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবর-কে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এ দিবস পালনে সম্মতি জ্ঞাপন করে।

১৯৩০ সালে গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন। লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হাঁটেন ৪০০ কিলোমিটার পথ, যা ছিল ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের সূত্রপাত। পরের দিনগুলোতে তিনি ছিলেন উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রনকারী ব্যাক্তি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কারণে বেশ কবার দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতে কারাবরণ করেন মহাত্মা গান্ধী। তবে সব পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ ও সত্যের ব্যাপারে ছিলেন অটল। সাধারণ জীবনযাপন করা এই রাজনীতিবিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আশ্রম।

এক জন শিক্ষিত ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে, গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ভারতে ফিরে আসার পরে কয়েক জন দুঃস্থ কৃষক এবং দিনমজুরকে সাথে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা এবং বহু বিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাৎ ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।

ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি আর আনুষ্ঠানিক রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। বরং রাজনীতি থেকেই তিনি অবসর গ্রহন করেছিলেন। ওই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে নামে এক ব্যক্তি তাকে গুলি করে হত্যা করেন। তাঁর মহান দর্শন ও কর্মময় জীবন স্থান-কালের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তার দর্শন বিভিন্ন দেশ ও জাতিকে দেখিয়েছে আলোর পথ। জুনিয়র মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, দলাইলামা থেকে শুরু করে অং সান সু চি'র মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও অধিকার কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছে গান্ধীর মহান দর্শন৷

আজ সারাবিশ্বে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, জাতিতে-জাতিতে যে বিদ্বেষ, হিংসা ছড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস বাণী প্রেরনা যোগায়। হিংসা দিয়ে পৃথিবীতে কখনই কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি। আর বাংলাদেশের মানুষ সকল সময়ই শান্তিপ্রিয়। তারা সকল সময় শান্তির জন্য কাজ করে। বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মিলনের কথা বলে। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম সে সে লক্ষ্যে অবিচল। সংঘাতমুক্ত সমাজ, সংঘাতমুক্ত পৃথিবী, যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব গঠনে মহাত্মা গান্ধীর দর্শন অত্যন্ত মানুষকে অনুপ্রানীত করে। সামরিক অস্ত্রের বিপরীতে অহিংস অস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিলেন, নিজের রক্ত দিয়েছিলেন। এমন একটি দেশ তারা চেয়েছিলেন যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কিন্তু, তাদের সে আকাঙ্খা এখনও অধরা রয়ে গেছে।

বর্তমানে চারদিকে রাজনীতি, ধর্মসহ বিভিন্ন কারণে হানাহানি, দ্বন্দ্ব আর সহিংসতা চলছে। যেখানে সহিংসতা রয়েছে, সেখানে ইতিবাচক কিছু ঘটে না। সহিংসতা শুধু ধ্বংস করে, সৃষ্টি করে না। সহিংসতা, দ্বন্দ্ব, হানাহানি জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাই আমাদের এগিয়ে যেতে হলে এই দ্বন্দ্ব- হানাহানির অবসান ঘটাতে হবে, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত, ন্যায় বিচার ভিত্তিক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ত্রুটিমুক্ত ও পরিশুদ্ধ করা আজ সময়ের দাবী। গুম, খুন, অপহরণসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য।

মহাত্মা গান্ধী সারাজীবন হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। গান্ধীর জন্মদিনে আমাদের হিংসা, অশান্তি ও সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহন করা প্রয়োজন। তাহলে মহাত্মা গান্ধির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন সম্ভব হবে।

লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত