মানচিত্র রাজনীতি ও কাশ্মীর ইস্যুতে বন্ধুহীন পাকিস্তান!

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১১

হাসান ইবনে হামিদ

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের উত্তেজনা সেই শুরু থেকেই। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাবার আগে থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। এই ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলওয়ামার ঘটনা ও মোদী সরকারের কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় আবারো উত্তপ্ত হয় কাশ্মীর। আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মীর ইস্যুকে উত্থাপনসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তাও চায় পাকিস্তান। এমনকি প্রয়োজনে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতেও তুলার হুমকি দেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। যথারীতি পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়ায় চীন। কিন্তু ইমরান খানের এতোসব আয়োজনের সার্বিক ফলাফল কি? চীনের সহায়তায় পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কতোটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছে তা এখন সর্বমহলেই প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে!

গতবছর কাশ্মীর ইস্যুতে নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে দু’দেশ। পাকিস্তান নানা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিলেও বাস্তবে কতটুকু সফল তারা! সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান ও ভারতের কূটনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, প্রায় প্রতিটিক্ষেত্রে পুরোপুরো ব্যর্থ পাকিস্তান সরকার। এ বছরের শুরুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তার বিষয়টি উত্থাপন করে চীন। মূলত পাকিস্তানের হয়ে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের এই সিদ্ধান্তকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলে চীন। কিন্তু সেখানে একটা বড় ধাক্কা খায় চীন-পাকিস্তান! নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তৃতীয়বারের মতো কাশ্মীর ইস্যু তোলার চেষ্টা করে চীন ব্যর্থ হয়। কেননা আলোচনা শুরু হতে না হতেই নিরাপত্তা পরিষদের অন্য চার সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, এটা একেবারেই ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হতে পারেনা। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব গৃহীত হতে হলে স্থায়ী পাঁচ দেশের সম্মতি প্রয়োজন হয়। কোনো একটি দেশ ভেটো দিলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় না। আর কাশ্মীর ইস্যুতে আলোচনা তো দূরে থাক, কথা শুরুর আগেই তা বন্ধ করে দেয় বাকি চার সদস্য দেশ। এতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তান ভিন্নপথ অবলম্বন করে।

এ মাসের শুরুর দিকে ওআইসি-র সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটা সম্মেলন আয়োজনের কথা উত্থাপন করেন। এবং এরপর আরেকটি কথা তিনি যুক্ত করেন। কুরেশি বলেন, সকল পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পক্ষে সম্ভব না হলে কাশ্মীর প্রশ্নে যে দেশগুলো পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত, তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে সম্মেলন আয়োজন করা হোক। আর এতে দারুণ ক্ষিপ্ত হয় সৌদি আরব। ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ সৌদি আরব তেল ঋণ সংক্রান্ত ৩২ লাখ ডলারের অফার স্থগিত করে আগের পাওনা ৩০০ কোটি ডলার পরিশোধের জন্য চাপও দিতে শুরু করেছে পাকিস্তানকে৷ পরিস্থিতি ভালো না তা বুঝতে পেরে সৌদি আরবের মন রক্ষার জন্য গত ১৭ আগস্ট অনেকটা হুট করেই রিয়াদ সফরে যান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া ও আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ। কিন্তু সৌদি সরকার এতোটাই ক্ষুব্ধ যে তাদের কারো সঙ্গেই দেখা করেননি সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এতে গোটা মধ্যপ্রাচ্য তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে পাকিস্তান। মধ্যপ্রাচ্যে মিত্র রাষ্ট্র বলতে পাকিস্তানের এখন আর কেউ নেই!

আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে ব্লক সেখানে সৌদি আরব নতুন করে পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইরানের মধ্যে কোন ‘ব্লক’ তৈরির চেষ্টা মেনে নেবেনা। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি চুক্তির বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব না থাকলে সেব্যাপারেও কঠোর পদক্ষেপে যাবে সৌদি আরব। চীনের ইন্ধনে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অতি বাড়াবাড়িতে বিরক্ত সৌদি আরব স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো বৈঠকে বসবে না। এমনকি পাকিস্তানকে সৌদি আরব কিছু শর্ত দিয়েছে তা মানা না হলে খুব দ্রুতই সৌদি সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের গদর বন্দরে সৌদি ২০ বিলিয়ন ডলারের যে বিনিয়োগ করেছে তা স্থগিত করবে। তেল সরবরাহ বন্ধসহ পূর্ববর্তী সব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাতিল করা হবে। পাকিস্তানের শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো এবং ২০৩০ ভিশনের আওতায় হাজার হাজার জনশক্তি সোর্সিং ভারতের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। সৌদি আরব কর্তৃক পাকিস্তানের দেওয়া ঋণ দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি কার্যকর করা হবে এবং পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোর অর্থায়ন বাতিল করা হবে।

পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ডকেও সৌদি আরব আমলে নিয়েছে বিশেষ করে চীনের ইন্ধনে জম্মু-কাশ্মীরকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র উন্মোচনের বিষয়টি। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের বর্ষপূর্তির ঠিক আগে গত মে মাসে ইমরান খান এই ম্যাপ প্রকাশ করেছেন। সেই ম্যাপে পুরো জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ এবং পশ্চিম গুজরাটের কিছু এলাকা পাকিস্তানের বলে দেখানো হয়েছে। তবে যেভাবে নেপালের পর পাকিস্তানও নতুন ম্যাপ প্রকাশ করে ভারতের এলাকা নিজেদের বলে দাবি করল, তাতে এর পিছনে যে চীনের কৌশল রয়েছে তা স্পষ্ট। নতুন ম্যাপ প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতকে চাপে রাখা। কিন্তু একজন সরকারপ্রধান কিভাবে একটা অমিমাংসিত ইস্যুকে নিয়ে হুট করে কাগজে কলমে মানচিত্র আকারে প্রকাশ করেন তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে চলছে জোর সমালোচনা। কেননা রাজনৈতিক বক্তব্যকে মানচিত্র আকারে প্রকাশ করাটা কখনোই কোন গ্রহণযোগ্য কাজ হতে পারেনা। এটা চূড়ান্ত রাজনৈতিক অবাস্তবতা। পাকিস্তান ভারতের রাজ্য গুজরাট, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ তাদের এলাকা বলে দাবি করেছে। এটা চরম হাস্যকর দাবি। কেননা এর কোনো আইনি বৈধতা নেই। আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও নেই। শুধু ভারত নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবে এই ম্যাপ খারিজ হয়েছে সকল দেশেই। নতুন মানচিত্র উন্মোচনের মাঝে দেশে সাধারণ মানুষের সাময়িক হাততালি ছাড়া আর কিছু প্রাপ্তির আশা নেই বলেও মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে পাকিস্তানের নানামুখী সিদ্ধান্তে এবার আগুন জ্বলছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরেও। গত সোমবার রাতে পাকিস্তানের অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবল ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। রাতের অন্ধকারে হাতে মশাল নিয়ে স্থানীয়রা বিক্ষোভে সরব হয়েছেন। তাদের বিক্ষোভ মূলত চীনের বিরুদ্ধে। কেননা বহু কোটি টাকা খরচে চীনের সহায়তায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে একটি বাঁধ তৈরি করছে ইমরান খান সরকার। নীলম-ঝিলম নদীর ওপর এই বাঁধ তৈরিতে কাশ্মীরের মানুষের সমস্যা বাড়ছে। এতে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর পানিসংকটে ভুগবে। আর তাতে পরোক্ষে মদত যোগাচ্ছে চীন। সেই চীনের বিরুদ্ধেই এদিন প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়েন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরবাসী। চীন-পাকিস্তান সখ্যতার মাঝে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের হাজার হাজার মানুষ। এতে করে ঘরে বাইরে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে পাকিস্তান।

সৌদি আরব নাকি চীন এই সম্পর্কের দোটানায় আছে পাকিস্তান। একদিকে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক চীনের সাথে অপরদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতির একটা বড় অংশ এখন সৌদি কেন্দ্রিক। এর মাঝে সৌদি আরব কর্তৃক আরোপিত নানামুখী শর্ত। এমন বাস্তবতায় চীনকে বেশ কিছু দিক বিবেচনা করতে হচ্ছে। চীন-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে পাকিস্তানেই৷ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করতে থাকে চীন৷ সামরিক ক্ষেত্রেও দুই পক্ষের বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো৷ যৌথ মহড়া, অস্ত্র নির্মাণ, অফিসারদের প্রশিক্ষণ, পাকিস্তানে বিমান বাহিনীতে চীনা প্রশিক্ষণ বিমান, চীনা রাডার সিস্টেমের ব্যবহার তো রয়েছেই৷ দুই দেশ একত্রে জেএফ-১৭-এর মতো যুদ্ধবিমান তৈরি করছে বলেও বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তৈরিতে চীনের তরফে প্রায় ৫০ লাখ কোটি টাকা সহায়তার প্রস্তাব রাখা হয়েছে৷ এই প্রকল্পের অধীনে সড়ক, বিদ্যুৎ কারখানা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, বন্দর তৈরি হবে পাকিস্তানে৷ বাড়বে কর্মসংস্থান।কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও বারবার পাকিস্তানের পাশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থেকেছে চীন। এতোকিছুর মাঝে চীনকে উপেক্ষা করা সৌদি শর্ত মানাটাও কষ্টের পাকিস্তানের জন্য। আবার সৌদি শর্ত না মানলে মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক একটি বড় ব্লক থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে পাকিস্তান। এমন কূটনৈতিক জটিলতায় অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে চীনের দিকেই যাবে পাকিস্তান। ফলে ওআইসি, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক রাষ্ট্রই এখন কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান এবং চীন ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও পশ্চিমা সমাজ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন আনুকূল্যই পাবেনা পাকিস্তান। অতীতেও পাকিস্তান এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ মূলত কূটনৈতিক জায়গায় গিয়ে ভারতের শক্তি, অর্থনৈতিক অবস্থানের কাছে পরাজয় ঘটে পাকিস্তানের। এবারের অবস্থা তো আরো ভিন্ন। সৌদি আরব সরাসরি হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানকে! কেননা সৌদি আরবের কাছে ভারত হলো বড় বাণিজ্যিক বন্ধু, ফলে তারা চায় না দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক৷ তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কাশ্মীর ইস্যুতে পুরোপুরী বন্ধুহীন হয়ে গেছে পাকিস্তান! এখন দেখার বিষয়, পাকিস্তান কিভাবে এই সমস্যা সমাধানের পথে হাঁটবে!

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত