লাদেনকে শহিদের মর্যাদা

পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ তোষণ নীতির পুনঃমঞ্চায়ন!

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:৫৪

হাসান ইবনে হামিদ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল ভর্তি আমেরিকান এয়ারলাইনসের বোয়িং-৭৬৭ উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর দিকের টাওয়ারে। উড়োজাহাজটি ১১০ তলা ভবনটির ৮০তম তলায় ঢুকে পড়ে। হতবিহবল মানুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই ১৮ মিনিট পর দ্বিতীয় দফা আরেকটি উড়োজাহাজ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দক্ষিণ দিকের টাওয়ারের ৬০তম তলায় আঘাত হানে। এভাবে আরো দুটি হামলা হয় পরের এক ঘন্টার মাঝেই, একটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর পেন্টাগনে আর অন্যটি পশ্চিম পেনসিলভানিয়া। এই সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেয় প্রায় তিন হাজার মানুষ। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত এই সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিলো বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা। হামলাকারীদের আর্থিক মদদ দিয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের এই সংগঠন। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১০ বছর লাদেনকে খুঁজে অবশেষে ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে গোপন অভিযান চালিয়ে এই আল-কায়েদা নেতাকে হত্যা করে৷

নাইন-ইলেভেন এর পর থেকেই গোটা বিশ্বে ওসামা বিন লাদেন– এক হন্তারকের নাম; একটি আতঙ্কের নাম। ওসামা বিন লাদেন প্রগতিশীল বিশ্বের চরম প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মূল হোতার নাম। কিন্তু গত ২৫ জুন পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে আল কায়েদা জঙ্গি নেতা ওসামা বিন লাদেনকেই শহিদ বলে সম্বোধন করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। অনেক আগ থেকেই যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মদদ দেওয়ার দীর্ঘ অভিযোগ ছিলো তাতে বুঝি এবার ঘি ঢেলে দিলেন ইমরান খান। এই বক্তব্যের পর প্রত্যক্ষভাবেই বুঝি পাকিস্তান সরকার সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিলো।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানকে আঞ্চলিকভাবে সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে উল্লেখ করে। পরবর্তীতে ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতিতে প্রতিবেদনে উল্লেখিত অঞ্চলে আল কায়েদার শক্তি অনেক কমেছে বলে স্বীকার করা হলেও, আল কায়েদাকে ধ্বংস করার পেছনে পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোতে পাকিস্তান সরকার সেইঅঞ্চলে আল কায়েদা নির্মূলে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্বকে সম্যক ধারণা দিতে পারেনি। আর সেই প্রসঙ্গে পাকিস্তান পার্লামেন্টে ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদা নিয়ে বিবৃতি দেয়ার সময় ইমরান খান লাদেনকে শহিদ আখ্যা দেন। বর্তমানে এ নিয়ে পাকিস্তানের ঘরে বাইরে চলছে তুমুল সমালোচনা।

পাকিস্তানের সন্ত্রাস তোষণ নীতি দীর্ঘ সময়ের। যেহেতু বেশিরভাগ সময় সামরিক শাসনে রয়েছে পাকিস্তান তাই সামরিক বাহিনীর মাঝে সন্ত্রাসবাদ লালন ও চর্চা এক নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ডের মূল হোতারা বরাবরই আশ্রয় পেয়েছে তাদের কাছে। অনেকক্ষেত্রে তো তারা ধর্মীয় গুরুর আসন পেতে বসেছে। সামরিক শাসকরা বরাবরই জংগি তোষণ নীতিতে থেকে নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে। আর তাই জাতিসংঘের তালিকায় থাকা ১৩০ জন জঙ্গি ও ২৫টি জঙ্গি সংগঠনের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান। এমনকি পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র সরকার, যারা জাতিসংঘের নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা আল-কায়দাকে পেনশন দেয়। শুধু তাই না, আমেরিকায় পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকের অপারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতায় কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে।

একজন প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে দাঁড়িয়ে লাদেনকে স্বীকৃতি দেয়, শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে তখন সেটা গোটা রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। একটি রাষ্ট্র সন্ত্রাসীকে কিভাবে দেখে তা একজন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটে ওঠে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বায়োগ্রাফিও আমার মনে হয় জানা দরকার, জানা দরকার তার রাজনৈতিক দর্শনও! ব্যক্তি ইমরান কিভাবে নিজের রাজনীতির সাথে জঙ্গিবাদী নেতাদের জড়িয়েছেন তাও সবার জানার দরকার আছে বৈকি! পাকিস্তান ‘তেহরিকে ইনসাফ পার্টি’ বা পিটিআই গঠনকালে ইমরানের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলো বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন তালেবান ও আল-কায়েদা। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল জামায়াত-ই-ইসলাম ও কওমি ওয়াতানের সঙ্গে আঁতাত করে খাইবার পাকতুনখোওয়া প্রদেশে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এটা হচ্ছে সেই খাইবার পাকতুনখোওয়া, যেখানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ওসামা বিন লাদেনকে লালন করেছিলো। এখানেই আল কায়েদার শক্তিশালী ঘাঁটি, যা এখনো বিদ্যমান। নির্বাচনে তাকে জোরালো সমর্থন দিয়েছিল তালেবান ও আল-কায়েদা গোষ্ঠী। মোল্লা ওমর ও জালালুদ্দিন হাক্কানির মতো তালেবান জঙ্গিরা তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকেই পড়াশোনা করেছে। এমনকি এবারের নির্বাচনেও পাকিস্তানে ধর্মীয় ডানপন্থীদের সরাসরি আনুকূল্য পেয়েছে ইমরান। ‘তালেবানের জনক’ খ্যাত মাওলানা সামিউল হক ইমরানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তবে এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার শিকার হয়েছেন তিনি সামি উল হকের সঙ্গে জোট বেঁধে। আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-মুজাহিদিন প্রকাশ্যেই ইমরান খান ও তার দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের সাথে হাত মেলানো কোন রাষ্ট্রপ্রধান যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলবেন তখন সেটা নিতান্তই হাসির খোরাক। বরং ইমরান খান সংসদে দাঁড়িয়ে লাদেনকে শহিদ আখ্যা দিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাই প্রত্যাশিত। আয়নায় ইমরান খান হয়তো নিজের চেহারাটা দেখেছেন, চেহারাটা দেখে ইমরান খান হয়তো নিজেকে চিনতে পেরেছেন, চিনতে পেরেছেন তার জাতকেও!

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের লাদেনকে নিয়ে দেয়া বক্তব্য মূলত পাকিস্তানের সহিংস সন্ত্রাসবাদ তোষণের ইতিহাসকেই তুলে ধরেছে। ভুলে গেলে চলবে না, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত একটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে আল-কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে। তার মানে সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত আস্তানায় আয়েশেই ছিলো শীর্ষ সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন। তাই লাদেনকে শহিদ আখ্যা দিয়ে ইমরান খান তার রাষ্ট্রীয় নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে কী ভূমিকা পালন করবে বা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা এই এক বক্তব্যেই স্পষ্ট। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে গোটা বিশ্বে পাকিস্তান যে এক বড় বাধা, এই বক্তব্যের মাধ্যমে তা আবারো প্রমাণ করলো ইমরান খান।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত