মানুষের জন্যই স্বাভাবিক জীবন চাই

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২০, ১০:০১

পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি। ধরে নেয়া হয় পানি নাই মানে জীবনও নাই। মরুভূমিতে পানির পরিমাণ খুবই কম, তাই সেখানে জীবিত প্রাণীও খুবই কম। আবার দেখেন পৃথিবীর এই পানির বেশিরভাগই আছে সমুদ্রে, দুই মেরুতে আর উঁচু উঁচু পর্বতের চূড়ার জমাট বরফে। এইসব পানি সরাসরি ব্যবহার করা যায় না; গাছপালা পশুপাখির কাজে লাগেনা; তাই মানুষের জীবনে এই পানির গুরুত্ব নাই বললেই চলে। মানুষের কাছে পানির গুরুত্ব তখনই যখন সেই পানি তাঁর কাজে লাগে। যেমন ধরেন নদীর পানি থেকে ফসলের খেতে সেচ দেয়া যায়; গাছের গোড়ায় পানি পৌঁছে গিয়ে ফসল ফলে আর পশুপাখির তৃষ্ণা মেটায়। অর্থনীতিতে টাকাকে পানির সাথে তুলনা করা হয়। বড় লোকের ব্যাংকে জমানো টাকা সেখানে দুই মেরু আর পর্বতের চূড়ার জমাট বরফের মতোই; মানুষের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনে এই টাকার কোনোই দাম নাই। কারণ এই টাকা সাধারণ মানুষের হাতে থাকে না; জনগণের প্রতিদিনের কেনাকাটায় কাজে লাগে না।

লক ডাউন আর করোনা আতঙ্কে স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ। আতঙ্কের কারণও খুব স্বাভাবিক; হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেকে মারাও যাচ্ছেন। অন্যদিকে মধ‍্যবিত্ত, নিম্ন-মধ‍্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তের এখন শুধু গলায় দড়ি দেয়া বাঁকি। তাঁদের কাছে খাবার কেনার টাকা নাই, বাড়ী ভাড়া দেবার টাকা নাই, ঔষধ কেনারও টাকা নাই। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়ে বলতে হয়েছে- “মানুষকে খাবার দিতে হবে, চাকরি হারাদের চাকরি দিতে হবে,অসুস্থদের চিকিৎসা দিতে হবে”। কিন্ত এই সবকিছু করতেই তাঁকে টাকা সাধারণ জনগণের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও খুব সহসাই দেশ থেকে করোনা বিদায় নিচ্ছে বলে কারোরই মনে হচ্ছে না। 

আমার মাঝারী মানের ব্যবসায়ী বন্ধুদের এখন সত্যিই করুন অবস্থা। তাঁরা না পারছেন ব্যবসা বন্ধ করতে, না পারছেন লোকসানের বোঝা টানতে। বেসরকারী চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও খারাপ; অনেকেরই চাকরিই নেই। এই করোনার মধ্যে এমন অনেকের কাছেই সামান্য খাদ্য সহায়তা নিয়ে গেছি যাদের অটোগ্রাফ বা সাথে সেলফি নিতে পারলে অল্প কিছুদিন আগেও ধন্য হয়ে যেতাম। সময় এতোটাই খারাপ যে আমার অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর বন্ধু চিন্তা করছেন সুযোগের রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার। রেডিও টিভিতে আসর মাতানো কণ্ঠ শিল্পী বন্ধু ঢাকা ছেড়েছেন আরও মাস খানেক আগেই। এই তালিকাটা এখন অনেক বড়,ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে ছাত্র, শিক্ষক; রিক্সা চালক থেকে প্রকৌশলী। পরিচিতজনদের মধ্যে মহামারী আতংকের সাথে সাথে পারিবারিক ভায়োলেন্সও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অভাব আর ক্ষুধা মানুষের ভেতর থেকে অমানুষটাকে বের করে আনছে প্রবল বেগে। এখানে এখন বড়লোকের জীবন আর সম্পদও নিরাপদ না। ক্ষুধা নিবারণের টাকার জন্য দিনে দুপুরে খুন ছিনতাই ডাকাতি রাহাজানির আতঙ্ক এই মুহূর্তে করোনার আতঙ্কের চেয়ে তাই কম নয়।

যারা নতুন করে লক ডাউন আর কার্ফু কার্ফু করে চিল্লায়ে মাথা খারাপ করে ফেলছেন তাঁদের সাথে আমি সে কারনেই একমত না। এর মানে এই না যে আমার কাছে মানুষের জীবনের মূল্য নাই। এরমানে এই না যে আমি দেশের অর্থনীতি নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত। এর মানে এই না যে আমি টাকার কুমির। বরঞ্চ এর মানে এই যে আমি অন‍্য মানুষের জুতা নিজের পায়ে দিয়ে তাঁদের কষ্টটা বুঝতে চাই; অন‍্যের যায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবতে চাই। আমাদের চিকিৎসা নাই, অক্সিজেন নাই, আইসিইউ নাই, ভেন্টিলেটর নাই; তারপরও যতটুকু আছে সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই অফিস আদালত পুরোদমে খোলার কথা বলি। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমন প্রতিরোধে জীবানুর বিরুদ্ধে গণ সচেতনতা, মাস্ক, সব ধরনের সুরক্ষা যন্ত্রপাতির ব্যবহার সহ জানা সব উপায়ই ব্যবহার করতে বলি। সবটুকু সদিচ্ছা দিয়েই জীবন স্বাভাবিক করার কথা বলি। ঐসব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা মনে করেই বলি- যারা এই দমবন্ধ অবস্থায় করোনা আক্রান্ত না হয়েও, টাকা নামের পানির অভাবে তিলে তিলে মরা যাচ্ছেন। কাজ করা ছাড়া সাধারণ জনগণের হাতে টাকা পৌঁছানোর কোন সঠিক উপায় সত্যিই জানা নেই বলেই বলি। নিজের এবং ঘনিস্ট আত্মীয় বন্ধুদের ঝুঁকি আছে জেনেও বলি। নিজের জীবনের বিনিময়েও মানুষ কে অমানুষ হিসেবে দেখতে ঘোর আপত্তি আছে বলেই সবাইকে নিয়ম মেনে কাজে নেমে পড়তে বলি। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে শুধু মানুষের কর্তব্যটা করতে বলি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত