অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা ত্রাণ- প্রণোদনা কবে পাবে?

প্রকাশ : ০৫ মে ২০২০, ০৬:৩৫

সুদীপ্ত শাহিন

গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি তথা লকডাউন পরিস্থিতি শুরু হওয়ায় সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কর্মহীন হয়ে পড়েছে  দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত প্রায় ৫ থেকে সাড়ে ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ । এ খাতের সরকার নির্ধারিত যতগুলি সেক্টরে নূন্যতম মজুরি কাঠামো নির্ধারিত হয়েছে তাতে কোনটারই নূন্যতমমজুরি ১০ হাজার টাকার উপরে নয়।

আর সরকার কর্তৃক মজুরি নির্ধারিত হয় নি যেসব সেক্টরে, সেসব সেক্টরের শ্রমিকদেরও মাসিক গড় মজুরি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার নিচে। ফলে দেড়-দুই মাস ধরে ঘরে বসে থেকে জমানো টাকা খরচ করে সংসার চালাবে- এরকম আর্থিক সক্ষমতা এসব শ্রমিকদের কতটুকু আছে তা সহজেই অনুমেয়।  বাস্তবে একদিন রুটি-রুজি না হলে পরদিনই তাদের অধিকাংশের চুলায় আগুন জ্বলে না। ফলে এতদিন ধরে কাজকর্মহীন হয়ে কিভাবে সংসার চলছে এসব কোটি কোটি শ্রমিক পরিবারের-  তা প্রতিদিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের দিকে চোখ রাখলেই দেখা যায়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সাভার ব্যাংক কলোনী এলাকায় এক নারী ও তার দিনমজুর স্বামী কর্মহীন হয়ে যাওয়ায় এবং কোন প্রকার ত্রাণ না পাওয়ায় মাত্র ১৮০ টাকায় এলাকার এক নারীর কাছে মাথার চুল বিক্রি করে সন্তানের খাবার কেনেন। সংসারের অভাব অনটনের কারণে যশোরের কেশবপুরের এক কৃষি শ্রমিক ও তার স্ত্রী নিজ ঘরের আড়ার সাথে একই দড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একইভাবে করোনা ভাইরাসের কারণে কাজ না থাকায় এবং কোন ত্রাণ না পাওয়ায় পারিবারিক কলহের জেরে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় একই গৃহবধূ গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। পোশাক কারখানায় কর্মরত স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ায় এবং লকডাউন পরিস্থিতিতে কোথাও থেকে ত্রাণ সহযোগিতা না পেয়ে অভাব-অনটনের থাকতে-থাকতে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ঢাকার ধামরাইয়ের গাংগুটিয়া ইউনিয়নের দুই সন্তানের জননী লাইজু আক্তার। প্রকৃতপক্ষে এরকমভাবেই অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে চলছে এই মানুষগুলোর জীবন।  গত দেড় মাসে সরকারি ত্রাণের নামে কেউ কেউ  ৫-৭ কেজি চাল পেলেও অধিকাংশের সেই সৌভাগ্য জোটে নি। 

সরকার অর্থনীতির পরিকাঠামো স্থিতিশীল ও টেকসই রাখতে শিল্পের মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রদান করেছে। সরকারি ভাষণে এসব প্রণোদনা শিল্প শ্রমিকদের  বেতন- বোনাসের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হলেও আদতে শ্রমিকরা কি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তা দেশবাসী সরাসরি প্রত্যক্ষ করছে। এর  সাথে তাল মিলিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য ৭৬০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়।  এই ঘোষণার সাথে  শ্রমিকদের তালিকা সংগ্রহ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করারও তাগিদ প্রদান করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল দুই একদিনের মধ্যেই হয়তো প্রণোদনার টাকা শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যাংক/ মোবাইল একাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে। ফলে কোন কোন জায়গায় প্রতিষ্ঠানপুঞ্জ  সেক্টরের মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শ্রমিকদের কিছু কিছু সহযোগীতার আশ্বাস দিলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর তাও বন্ধ হয়ে যায়।  সরকার-ই  সকল শ্রমিকদের দায়িত্ব গ্রহণ করছে, এমন প্রচার তৈরি করে মালিকসহ অনেকেই তখন তাদের দায়িত্ব থেকে পাড় পেয়ে যায়। ঘোষণার পরপরই তখন ভ্যানচালক, হকার, দর্জি, হোটেল, মেকানিক্স নির্মাণসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সকল শ্রমিকদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় তালিকা তৈরি করার হিড়িক। কিন্তু প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষের জন্য উল্লেখিত বরাদ্দকৃত এই প্রণোদনা হিসেব করলে দেখা যায় জনপ্রতি ১৪০ টাকাও পড়ে না। ফলে এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের কি প্রয়োজন মেটানো যাবে- তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়।   তারপরও একেবারেই অপ্রতুল এই বরাদ্দ শ্রমিকরা কিভাবে পাবে, তালিকা তৈরি করে শ্রমিকরা কার কাছে কিভাবে জমা দিবে সে প্রেক্ষিতেও সুনির্দিষ্ট কোন  দিকনির্দেশনা  দেয়া হয় নি।  শ্রমিকরা ছুটে যায় ইউএনও এবং জেলা প্রশাসকের কাছে। তারা পাঠিয়ে দেন স্থানীয়  জনপ্রতিনিধিদের কাছে। আর ক্যামেরার সামনে জনপ্রতিনিধিরা যতটা দৃশ্যমান আছেন, বাস্তবিকে তাদের নাগাল পাওয়া শ্রমিকদের জন্য এখন দুস্কর হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে গত ২২ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত জনাব মহিউদ্দিন আহমদ লিখিত " এমপি সাহেবরা কি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন" শীর্ষক কলামটি প্রাসংগিকতায় বেশ গুরুত্ববহন করে। তারপরও কঠিন সাধনার পর কখনো কেউ এমপি সাহেব ছাড়াও  মেয়র/ চেয়ারম্যান সাহেবদের নাগাল পেলেও সামান্য কিছু চাল ধরায়ে দিয়ে কোনরকমে বিদায় করে দেন। অভাবগ্রস্থ অনেকেই আবার হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরে।  অথচ প্রধানমন্ত্রীর  প্রণোদনা ঘোষণার প্রায় এক মাস গত হয়ে গেলেও এই ঘোষণার টাকা কোথায় কিভাবে শ্রমিকদের দেয়া হবে সে সম্পর্কে এখনও কোন স্পষ্ট নির্দেশনা কেউ দেয়নি। 

গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের ২৯ টি কমিটি কাজ করছে বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়া ত্রি-পক্ষিয় বৈঠকে জানান।  অথচ গার্মেন্ট শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র সারাদেশের মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষ করছে।  কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের মন্ত্রী থেকে দপ্তরের কর্মকর্তা পর্যন্ত কেউই এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কথা বলছেন না। এমনকি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কাছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট তালিকাও নেই। গত ১২ এপ্রিল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমনের প্রভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শ্রম পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং চলমান শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবংসংশ্লিষ্ট এলাকার মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে সারাদেশে ক্রাইসিস  মানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির কর্ম-পরিধিতে দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক সহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক বাঁচাতে সরকারের আর্থিক সহায়তায় যেনো আওতাভুক্ত হয়, সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ডাটাবেজ তৈরীর কথা বলা হয়। কোথাও কোথাও এইসব কমিটির মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রমিকদের ডাটাবেজ তৈরি করে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু জেলা বা উপজেলার দুর্যোগ মোকাবেলার কোন কমিটি বা তৎপরতায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উল্লেখিত নির্দেশনাকে কোথাও সমন্বয় করা বা হিসেবেই আনা হয় নি। ফলে ইউএনও ও জেলা প্রশাসকগণ শ্রমিকদের তালিকার প্রেক্ষিতে কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করে সরাসরি তা সিটি করপোরেশন/ পৌরসভা /চেয়ারম্যান বরাবরে প্রেরণ করে দেন। আবার অনেক জায়গায় ইউএনও ও জেলা প্রশাসকগণ এসব তালিকা গ্রহণই করেননি। অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও নাগাল না পেয়ে শ্রমিকরা দিশেহারা হয়ে উঠছে । উপরন্তু বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে স্থানীয় কাউঞ্চিলর এবং আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পার্টির কর্মিদের দিয়ে কিছু তালিকা করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের দলীয় ও নিজস্ব লোকরাই মূলত এসব তালিকাতে নাম উঠাতে পারছে। ভুক্তভোগীরা কোথাও ঠাঁই পাচ্ছে না। এসব ত্রাণ কার্য মনিটরিং করার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলার জন্য একজন করে সচিবকে দায়িত্ব প্রদান করলেও মূলত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরঞ্চ জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ নিজেদের বলয়ের বা দলীয় কর্মিদের অংশগ্রহণে চিহ্নিত লোকদেখানো কিছু ত্রাণপরতা টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে সরকারের ত্রাণকার্যের ব্যাপক ঢাকঢোল পিটাচ্ছে। 

ফলে উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ হতাশায় জর্জরিত হয়ে আজ দিন কাটাচ্ছে। কোথাও কোথাও বিক্ষুব্ধ হয়ে সকল নিয়ম- বিধি উপেক্ষা করে রাস্তায় এসে অবস্থান করছে। কোথাও কোথাও দুর্নীতিগ্রস্থ জনপ্রতিনিধিদের লাঞ্চিত করাসহ বিভিন্ন অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। করোনা মোকাবেলার জন্য পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত করণীয় "সংগনিরোধ কর্মসুচি" বাস্তবায়নের অপরিহার্য শর্ত হলো সকলের খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা। ফলে বাংলাদেশের সরকার সেই শর্ত পূরণ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আরো কি কি রুপের অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিবে তা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারবে। 

লেখকঃ কেন্দ্রীয় সদস্য, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত