এনআরসি নিয়ে আবারো ঢাকাকে আস্বস্ত করলো দিল্লী!

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২০, ১৯:৪৫

হাসান ইবনে হামিদ

মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হয়েছে করোনা ভাইরাসের কারণে। ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠেয় মূল অনুষ্ঠানটি ওই দিন হচ্ছে না। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে ও জনকল্যাণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুজিব বর্ষে মোদীর আগমন উপলক্ষ্যে দু’দেশের মাঝে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছিলো। দুই দেশের অমিমাংসীত বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছিলো। গত ২ মার্চ সোনারগাঁ হোটেলে আয়োজিত BIISS ইভেন্টে ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সূত্রধরে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যতোটুকু চেনে তার চাইতে বেশি চেনে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে! কেননা একটা দীর্ঘ সময় তিনি হাইকমিশনার হিসেবে বাংলাদেশে থেকেছেন। তাই বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা ও তার সমাধানের ক্ষেত্রে সবেচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন তিনি, অন্তত তার পূর্ব অভিজ্ঞতা ও কাজের ধরণটা তাই বলে। গত ২ মার্চ তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে প্রথম আসেন বাংলাদেশে এবং তিনি তার বক্তব্যে বেশ কিছু বিষয়কে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। কিছু বিষয় মীমাংসিত আর কিছু অমীমাংসিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ের এনআরসি ও দিল্লীর সহিংসতা নিয়ে কি বক্তব্য দেন সে ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি ছিলো। 

গত ৩১ আগস্ট ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের প্রকৃত নাগরিকদের নামের তালিকা (এনআরসি) প্রকাশিত হয়েছে। ওই তালিকায় চূড়ান্তভাবে ঠাঁই হয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ লোকের। তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ। আসামের পর গোটা দেশেই এই এনআরসি চালু করতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী সরকার। এদিকে আসামে এই বিপুল সংখ্যক লোক বাদ যাওয়াতে বিজেপি শাসিত ঐ রাজ্যেই ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়েছে মোদী সরকারকে। দেশের বড় বড় সব শহরে হচ্ছে আন্দোলন। এর মাঝেই দিল্লীতে হয়ে গেলো দাঙ্গা। সবকিছু মিলিয়ে খুব একটা সুখকর পরিস্থিতি নেই। এই নাগরিকত্ব নিবন্ধন হালনাগাদ নিয়ে নানা জনের নানা প্রশ্ন এবং এর ঢেউ ইতিমধ্যে  এসে উপচে পরেছে বঙ্গোপসাগরের উত্তর পাড়েও! ফলে বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও এক চাপা আতংক বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা যখন নাকের ডগায় তখন নতুন কোন সমস্যায় কি জড়িয়ে পরছে বাংলাদেশ? অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে থাকা ভারত বিরোধী একটি চক্রের ক্রমাগত অপপ্রচার এ সমস্ত উদ্বেগকে আরো রসালো করে তুলছে। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই বুঝি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব গত ২ তারিখে তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বার বার বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করেছে যে, এনআরসি এমন এক প্রক্রিয়া যা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণের উপর এর কোন প্রভাব পড়বে না। আমি নিশ্চিত করে আবারো এটা বলে যাচ্ছি।‘

আসামের এনআরসি নিয়ে বহু কথা হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে অনেকেই আসামের অবৈধ অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, আবার বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিরাও বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটি পরিষ্কার করেছে যে, বাংলাদেশ মনে করে আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি নয়। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যাপারে কোন রাজ্যের মন্ত্রীবা রাজনৈতিক নেতারা কি বলেছে তা মুখ্য না। বরং গুরুত্ব দেয়া উচিত আজ নাগাদ এই এনআরসি’র ব্যাপারে কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে কিছু বলেছে কিনা সে ব্যাপারে! অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সরকার কখনো বাংলাদেশের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেনি এবং কোনো কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এ বিষয়টি কখনো উঠে আসেনি। যেহেতু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ জানায়নি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারেনা।  বাংলাদেশের অনেক কলামিস্টের লেখা দেখে মনে হয়, অনিবন্ধিত মানুষরা বুঝি আজই বাংলাদেশে এসে উঠছে! কেউ কেউ আবার বলেছেন যে, দিল্লির উচিত ঢাকাকে আশ্বস্ত করা। আশা রাখি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এবার তাদের আশ্বস্ত করে যেতে পেরেছেন। 

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতের নতুন পররাষ্ট্রসচিব প্রতিবেশীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট মিত্রের বেলায় ‘বাংলাদেশে ফার্স্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যে নতুন বেশ কিছু চুক্তি সইয়ের জন্য যে প্রস্তুত এই ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। তবে প্রথম বারের সফরে যেমন স্থলসীমা চুক্তি সই হয়েছিলো সেই  মাপের কোনো চুক্তি সামনের সফরে যে হবেনা এটা নিশ্চিত। তিস্তা এবারো আলোচনার টেবিলে অধরা কিন্তু তিস্তাকে বাদ রেখে অন্য কয়েকটি নদীর জলের ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতা হবে বলে পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন। তবে আশার কথা হলো, দীর্ঘ সময় যাবত দুই দেশের অভিন্ন নদীর জলবন্টন নিয়ে যে আলোচনা চলছিলো তার একটি সুরাহা হতে যাচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে দুই দেশই যেনো পানি পায় তা অভিন্ন নদীর মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হবে। ইতোমধ্যে নৌপথের নাব্যতা বাড়ানোর ব্যাপারে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। কুশিয়ারা ও যমুনা নদীর ফেয়ারওয়েগুলি আশুগঞ্জ ও জকিগঞ্জের মধ্যে এবং সিরাজগঞ্জ ও দাইখোয়ার মধ্যে যথাক্রমে ৮০:২০ ব্যয় ভাগের সূত্রে ড্রেজিং করা হবে। এটি অভ্যন্তরীণ জল পরিবহন ও ট্রানজিট প্রোটোকলের অবিচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ এবং আশুগঞ্জের প্রধান নদী জংশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর সুবিধা উন্নয়নের যৌথ প্রয়াস।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পুরনো শিলিগুড়ি-শিয়ালদা রেল রুট পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ভারতের রেলওয়ে। প্রায় ৫৫ বছর আগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এই রেল লাইনটি বন্ধ হয়ে যাত।  এ রেললাইনটি পণ্য পরিবহনে ব্যবহার করা হবে। তবে এই পথে যাত্রী পরিবহনের সম্ভাবনার বিষয়টিও পররাষ্ট্র সচিব এবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এতে বাংলাদেশের লাভ কি? রেলপথটি বাংলাদেশ ও ভারতউভয় দেশের রেলই ব্যবহার করবে। ভারতের রেল যেমন এই পথ ব্যবহার করে শিলিগুড়ি যাবে, তেমনি বাংলাদেশের রেলও পথটি ব্যবহার করে শিলিগুড়ি থেকে পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবে। নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের মংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে মালামাল পরিবহন করতে চায়। এখন সেটা সড়ক পথে করতে হচ্ছে, যার খরচও বেশি। কিন্তু এই রেলপথটি চালু হয়ে শিলিগুড়ির সঙ্গে যুক্ত হলে, আমাদের রেল পথটি ব্যবহার করে শিলিগুড়ি যেতে পারবে। ফলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও এই পথে আমদানি রপ্তানি করা যাবে। তাছাড়া সার্কের দেশগুলো এই রেলপথ ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানিতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে, যার ফলে আর্থিক লাভ হবে বাংলাদেশের। পায়রা বন্দরের সঙ্গেও রেল যোগাযোগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। পদ্মা ব্রিজ হয়ে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রেলে সংযোগ তৈরি হবে। ভবিষ্যতে এই রেলের সঙ্গে পায়রা বন্দর সংযুক্ত করার আশা রয়েছে বাংলাদেশের। 

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোদির পরবর্তী সফর নিয়ে আরো বেশ কিছু বিষয়ের দিকে আলোকপাত করেছেন।এবারের সফরের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে চলেছে দু’দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সংযোগের নতুন দিক খোঁজা।বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে নদীপথে যাতায়াত বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু প্রকল্প ঘোষণা হতে পারে শীঘ্রই। বাংলাদেশের বন্দরগুলোকে ব্যবহার করে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এলপিজি গ্যাস পাঠানোর নতুন উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হবে মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে বৈঠকে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ ব্যবসায়ীক অংশিদারিত্বের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। 

 সার্বিক পরিস্থিতিতে একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছু অস্বস্তির উপাদান তৈরি হয়েছে। যেহেতু নরেন্দ্র মোদীর সফর করোনা ভাইরাসের কারণে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে আমরা আশা রাখছি নরেন্দ্র মোদী যখন পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফরে আসবেন তখন সকল অস্বস্তি দূর করবেন।  কেননা দুই দেশই চায়, সব সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা স্ট্রং আর পারপাসফুল থাকুক। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এটাও বুঝতে হবেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও একটা ডোমেস্টিক কনস্টিটিউয়েন্সি আছে - যেখানে তাঁরও ব্যাখ্যা করার দায় আছে ভারতের মতো বন্ধুপ্রতিম দেশ এই ধরনের নীতিগুলো কেন নিচ্ছে! তাই আমরা আশা রাখবো, ভারতের নিজস্ব কোনও নীতি নিয়ে প্রতিবেশী কোনও দেশের বিচলিত হওয়ার কারণ নেই, এটা তাদের নিশানা করে নয় - ঢাকায় এসে এই জোরালো বার্তাটা নরেন্দ্র মোদী নিজে দেবেন। 

 

-হাসান ইবনে হামিদ, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত