পুলিশ কি অপরাধে বেপরোয়া?

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৯, ১৩:২৯

ডয়চে ভেলে'র প্রতিবেদন

বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেয়ার নজির বিরল৷ আর আদালতে মামলা হলেও তার তদন্ত করে ওই পুলিশই৷ ফলে অপরাধের কারণে পুলিশের প্রচলিত আইনে শাস্তি পাওয়ার নজির কম৷এই পরিস্থিতি কেন?

ঢাকায় একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জমি দখলে সন্ত্রাসীদের সহায়তার অভিযোগে ওয়ারীর ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানকে বরখাস্ত করা হয়েছে ২৬ আগস্ট৷বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমান কারাগারে৷কারাগারে আছেন সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন৷শুনে মনে হতে পারে বাহ! পুলিশ কোনো অপরাধ করলেতো ব্যবস্থা নেয়া হয়৷কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷অনেক সমালোচনা আর চাপের কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেয় হয়েছে৷শাস্তি হবে কিনা সেটা এখনো বলার সময় আসেনি৷

খুলনার জিআরপি থানায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় থানা মামলা নেয়নি৷আদালতে মামলা করার পর ওসি এবং এসআইসহ ৫ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছে মাত্র৷ চট্টগ্রামে মাহমুদা খাতুন মিতুকে হত্যার ঘটনায় তার স্বামী এসপি বাবুল আক্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷যদি তিনি স্ত্রী হত্যায় জড়িতই থাকেন তাহলে পদত্যাগের সুযোগ কেন? 

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ও বহু ঘটনায় বিতর্কিত এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে এবারও ঢাকা রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ পুলিশ সুপারের পুরস্কার দেয়া হয়েছে৷এ নিয়ে ষষ্ঠবার তিনি এই পুরস্কার পেলেন৷

১৯৯৮ সালে ডিবি হেফাজতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবেল হত্যায় ডিবির তখনকার সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আকরাম হোসেনকেও আইনের আওতায় আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে৷বিচারিক আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান৷

পুলিশের সাবেক এআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, "এখন পুলিশে কেউ কেউ মনে করেন তার গডফাদার আছে৷ কারুর পলিটিক্যাল ব্যাকিং আছে৷ ফলে সবার ক্ষেত্রে একই ট্রিটমেন্ট হয়না৷ উর্ধতন কর্মকর্তাদের একটি অংশ সন্ধ্যার পরতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে বসে থাকেন৷ তারাতো নিজেদের পলিটিক্যাল ভাবেন৷ তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে ব্যবস্থা নেয়া সহজ নয়৷''

তার মতে, "পুলিশের লিডারশিপে সমস্যা হচ্ছে৷ চেইন অব কমান্ডে সমস্যা আছে৷ তাই পুলিশ বেপরোয়াভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷''
প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক লাখ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে পুলিশ সদর দপ্তরে৷ ২০১৮ সালে অভিযোগের ভিত্তিতে ১২ হাজার ৭৩৩ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ তবে এই শাস্তি যারা পেয়েছেন তারা কনেস্টবল থেকে সর্বোচ্চ ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেয়া হয়েছে লঘুদণ্ড - বদলি, প্রত্যাহার ইত্যাদি৷ চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অবসরে পাঠানোর শাস্তি খুব কম সদস্যকেই দেয়া হয়েছে৷

২০১৭ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ওই বছর ১৪ হাজার ৩৯৫ জনকে লঘুদন্ড দেয়া হয়েছে৷ চাকরিচ্যুত হয়েছেন মাত্র ২৫জন৷ যারা শাস্তি পেয়েছেন তাদের অপরাধের মধ্যে আছে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, জমি দখল, ছিনতাই, ঘুস ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার মত অপরাধ৷ তবে আদালত বা থানায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর৷

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, "এই যেটুকু শাস্তি দেয়া হয় তাতেও পক্ষপাতিত্ব আছে৷ পুলিশ কর্মকর্তা মোল্লা নজরুলের ঘুস নেয়ার ঘটনা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পরও তার শাস্তি হয়নি৷ এসপি হারুনকে নিয়ে বিতর্ক থাকার পরও তিনি বার বার পুরস্কৃত হন৷''
তার মতে, "রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্যই পুলিশে অপরাধ বাড়ছে৷ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়না৷ আদালতে মামলা হলেও সাক্ষী পাওয়া যায়না৷ কারণ পুলিশের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়৷''

পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, "পুলিশ ফোর্সের শতকরা ৮০ ভাগই কনেস্টবল থেকে ইন্সপেক্টর পদ মর্যাদার৷ তাই শাস্তিও তারই বেশি পান৷ ইন্সপেক্টরের উপরের কর্মর্তাদের শান্তি দিতে পারে মন্ত্রণালয়৷ পুলিশ সদর দপ্তর নয়৷ তারা শাস্তি পেলে তার তালিকাও পুলিশ সদর দপ্তরের তা প্রকাশ করা উচিত৷''
তার মতে, "একই ধরনের অপরাধে তদন্ত ও শাস্তি দুই রকম হওয়া উচিত না৷ তবে তদন্ত ও শাস্তির দায়িত্ব একই ব্যক্তি বা কমিটির ওপর থাকেনা৷ ফলে কখনো তদন্ত ঠিক হলেও শাস্তির ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকতে পারে৷'' তবে এসব নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে চাননি৷''

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত