কৃষককে আরও ভর্তুকি দিন

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০১৯, ১৭:১৩

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

কৃষকের গুরুত্ব কেবল সংখ্যা দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না, যদিও সংখ্যায় তারা অনেক, তারাই সর্বাধিক; মানতে হবে এই সত্য যে কৃষক না থাকলে কৃষিও নেই এবং কৃষি না থাকলে বাংলাদেশও নেই। সোনার বাংলা আর সোনার বাংলা থাকবে না, দোজখ হয়ে যাবে। সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে কৃষককে আরও বেশি ভর্তুকি দেওয়া। বহু ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। পোশাক খাতে শিল্প মালিকরা হরদম ভর্তুকি চাচ্ছেন ও পাচ্ছেন। এই লেখাটি লিখতে লিখতেই দেখছি পোশাক কারখানার মালিকরা ৬০ হাজার কোটি টাকার নতুন ভর্তুকি চেয়েছেন। (বণিক বার্তা, ২৮ মে) সেটা হয়তো পাবেনও। গত ১০ বছরে ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। এসব চলছে। চলুক। তবে সবচেয়ে জরুরি যে খাত, কৃষি খাত, সেখানে অবশ্যই ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। ভর্তুকি দিয়ে ডিজেল, সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক, ধান কাটা-মাড়াই- এক কথায় উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যাতে দরিদ্র কৃষকের কাছে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য হয়, সেটা দেখা চাই। উৎপাদন খরচ কমানো চাই। সরকারের দ্বিতীয় কর্তব্য, বেশি করে ও সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা। সরকার ধান কেনা ক্রমাগত কমিয়ে এনেছে। করা দরকার ঠিক উল্টোটা। এ বছর সরকার কিনেছে উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ (ডেইলি স্টার, ২৮ মে)। এই ক্রয়ের মধ্যে শুধু ধান নয়; চালও আছে। ধানই কেনা দরকার; চাল নয়। সরকার চাল কেনে মিল মালিকদের কাছ থেকে, তাতে কৃষকের কোনো সুবিধা হয় না। সবটা সুবিধাই মিল মালিকদের। জানা গেছে, মিল মালিকরা যে শুধু নিজেদের মিলের জন্য ধান কেনে, তা নয়; সস্তায় ধান কিনে সরকারের কাছে সরকার-নির্ধারিত দরে বিক্রিও করে। ধান কেনাতে লাভ, ধান বেচাতে লাভ, আবার ধান থেকে চাল ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করেও লাভ। ত্রিফলা। ওই যে গান আছে, 'ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে'- এ সত্যের এ বড় সঠিক প্রমাণ। 

কৃষিমন্ত্রী দেখলাম বলেছেন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে রাজনৈতিক বাধা রয়েছে। এটা হচ্ছে সার কথা, লাখ কথার এক কথা। রাজনৈতিক বাধা মানে দলীয় বাধা। আর দল মানেই সরকারি দল। ধান কিনতে হয় মধ্যবর্তী ফড়িয়া-দালালদের মারফত, যাদের ভেতর সবাই হচ্ছে সরকারি দলের নেতা কিংবা কর্মী। কোনো কিছু না করে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে এরা কৃষকের প্রাপ্য দু'হাতে হাতিয়ে নিচ্ছে। কৃষকের হায় হায়টা বাড়ছে। ওদিকে খাদ্যমন্ত্রী, পেশায় তিনি ধান ব্যবসায়ী, দেখলাম বলেছেন অন্য কথা। সেটি চমৎকার। তিনি বলেছেন, আমরা অর্থাৎ সরকারের লোকেরা পাশে না থাকলে উৎপাদন এত বাড়ল কী করে? তাই তো! মন্ত্রী মহোদয় নিজেকে নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধি মনে করেন; কিন্তু তিনি অনেক কিছুই জানেন তবে এটুকু জানেন না, উৎপাদন যে বেড়েছে, সেটা সরকারি লোকের উপস্থিতির কারণে নয়।

বলা হচ্ছে, সরকারি গুদাম পর্যাপ্ত নয়। পর্যাপ্ত না হলে পর্যাপ্ত করা দরকার ছিল। পর্যাপ্ত করতে হবে। অনুৎপাদন খাতে ব্যয় করার সময়ে তো কই, সরকারের অর্থ ও উদ্যোগ কোনোটারই সামান্যতম অভাব দেখা যায় না। তাহলে অত্যাবশ্যকীয় এই দায়িত্ব পালনে অনীহা কেন? এমনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যাতে ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি চলে যাবে সরকারি গুদামে এবং মিল মালিকরা ধান কিনবে সেখান থেকেই এবং সরকারি দরে। ধান দ্রুত আসবে সরকারি গুদামে এবং সেখান থেকে দ্রুত চলে যাবে ধানের কলে। বাইরের কায়কারবার সব বন্ধ। বলা হয়েছিল, চাল রফতানি করা হবে। পরে শুনলাম, আপাতত তা স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি আমদানিও কিন্তু চলছে এবং এমন সরকারি বক্তব্য শোনা গিয়েছিল যে, আমদানি চালু থাকবে। একই সরকারের এমন দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান বর্তমান বিশ্বে বিরল হতে পারে; কিন্তু আমাদের দেশে তা মোটেই নয়। এক হাতে রফতানি, অন্য হাতে আমদানি- ওই দ্বৈতনীতির পরস্পর-বিরোধিতাটা কিন্তু আপাত মাত্র। ভেতরের বস্তু অভিন্ন, সেটা হলো মুনাফা। রফতানিতেও মুনাফা, আমদানিতেও মুনাফা। কেবল যে বাণিজ্যিক মুনাফা, তা নয়; কারসাজি করে, কাগজে-কলমে এক ক্ষেত্রে দাম কম, অন্য ক্ষেত্রে দাম বেশি দেখিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা চলে। সমানে চলছে। টাকা পাচারের এ এক ভালো রাস্তা। 'বৈধ' রাস্তাও বটে। আবার আমদানি-রফতানির ক্রীড়াকৌতুকে বাণিজ্যিকভাবে যে মুনাফাটা আসছে, সেটাও যে দেশে থাকবে, শিল্প-কারখানা গড়তে খরচ হবে- এটাও নিতান্তই দুরাশা। মুনাফার একটা বড় অংশের নিশ্চিত গন্তব্য ওই বিদেশই। পুঁজিবাদী দুনিয়ার এটি আরেক বৈশিষ্ট্য। যে চীন মহাদেশ একসময় বিপ্লবী ছিল, সে যে এখন পুঁজিবাদী হয়ে গেছে, তার অনেক নিশ্চিত প্রমাণের একটি হলো, সেখানে ধনীরা অতি দ্রুত ধনী হচ্ছে এবং অধিক-ধনীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। গত বছরেই নাকি দেশ ছেড়েছে ১০ হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তি। নিশ্চয়ই তারা খালি হাতে যায়নি, বোঁচকা-বুঁচকি সঙ্গে নিয়েই গেছে। বাংলাদেশে শুনছি ধনীদের ধনবান হওয়ার গতি চীনের ধনীদের গতিকেও হার মানিয়েছে এবং এই মহামান্য ধনীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, অন্যরা যাওয়ার এন্তেজাম করছেন। প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে সব সরকারি নীতিরই মূলকথাটা এখন মুনাফা। আর সে মুনাফা জনপ্রিয়তার নয়, অর্থবিত্তের বটে। সমষ্টিগত নয়, ব্যক্তিগত। উন্নতি ঘটছে। উন্নতির মনোহর দৃশ্য ও মোহন বাদ্য যে দেখে না শোনে না, তার দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু ভেতরে কান্নাও আছে। আর ওই যে কৃষক, তার পাকা ধানে আগুন দিচ্ছে, ওই ধান কৃষকের নীরব অশ্রুতে সিক্ত। হাঁড়ির ওই একটি চালেই বাকি চালের দশাটা জানা যাচ্ছে। তা তো বোঝা গেল। প্রশ্ন হলো, এমনটাই কি চলবে, নাকি বদলাবে? একশ' বছর আগের গফুর আর আজকের গফুর এক ব্যক্তি নয়। পৃথিবী বদলেছে, দেশ ভাগ হয়েছে, ভগ্নদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে মেহনতিদের লড়াইয়ের কারণেই। কিন্তু গত একশ' বছরে মেহনতিদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তনটা ঘটেছে কি? হ্যাঁ, রাস্তাঘাট ভালো হয়েছে, যোগাযোগ উন্নত, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, হাতে হাতে মোবাইল, টেলিভিশনে ভারতীয় সিরিয়াল- এসব আছে। পায়ে জুতা ছিল না, জুতা এসেছে। জামাকাপড়েও উন্নতির চিহ্ন। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গেছে; কেবল যে শ্রমিক হিসেবে গেছে, তা নয়। গেছে পেশাজীবী হিসেবেও। তবু কৃষক তো তার পাকা ধানে আগুন দিচ্ছে। সোনার বাংলা তাহলে কোথায়? কার জন্য?

না, মেহনতিদের ভাগ্য বদলায়নি। কারণ যতই উন্নতি হয়েছে তত বেড়েছে বৈষম্য। আমাদের উন্নতির ইতিহাস আসলে বৈষম্য বৃদ্ধিরই ইতিহাস। উন্নতির কারণ হচ্ছে মেহনতিদের শ্রম। কিন্তু উন্নতির কঠোর বোঝা চেপে বসেছে ওই মেহনতিদের পিঠের ওপরেই। 

ঊনসত্তরে আমাদের এই বাংলাদেশে একটি জনঅভ্যুত্থান ঘটেছিল। কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছিল ওই অভ্যুত্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও চালিকাশক্তি। তার আওয়াজটা ছিল 'কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধরো, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন করো।' আওয়াজ কিন্তু আরও একটা ছিল। অভ্যুত্থানের অনুঘটকগুলোর সর্বপ্রথমটি ছিল বামপন্থি ছাত্রনেতা আসাদের প্রাণদান, আর আসাদের আত্মদানের সেই ঘটনার ভেতর থেকেই স্বতঃস্টম্ফূর্ত আওয়াজটা বেরিয়ে এসেছিল- 'আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র'। জনগণতন্ত্র অর্থাৎ সমাজতন্ত্র। পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়েছে, কৃষক-শ্রমিকই স্বাধীন করেছে; কিন্তু সমাজতন্ত্র আসেনি। আর আসেনি বলেই মেহনতিদের ভাগ্য বদলায়নি। দেশ একবার স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭-এ, আরেকবার স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১-এ। রাষ্ট্র ছোট হয়েছে আয়তনে, কিন্তু তার ভেতরের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রের চালকদের মনোভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পুরনো রাষ্ট্রযন্ত্রটিকেই মেরামত করে চালানো হচ্ছে। কিন্তু যন্ত্র যেহেতু পুরনো এবং রাষ্ট্রচালকদের মুনাফালিপ্সা যেহেতু লেলিহান। তাই ফল দাঁড়িয়েছে মেহনতিদের নির্মম বঞ্চনা, তাদের ওপর দুঃসহ নিপীড়ন। বঞ্চনা ও নিপীড়নের দরুন ক্ষোভের আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি; মাঝেমধ্যে সেটা দপ্‌ করে দৃশ্যমানও হয়। আশঙ্কা ব্যাপক নৈরাজ্যের। 

ঊনসত্তরে 'জ্বালো জ্বালো/ আগুন জ্বালো' আওয়াজটাও শোনা গিয়েছিল। আগুন জ্বলেও উঠেছিল। কেবল মশাল মিছিলের নয়, আগুন জ্বেলেছিল গণআদালতে এবং কল-কারখানা ও তহসিল অফিস ঘেরাওয়ের মধ্যে। একাত্তরে ভিন্ন ধরনের এক আগুন জ্বালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। তাদের লাগানো আগুনের বিপরীতে ছিল জনগণের প্রতিরোধের আগুন। প্রতিরোধের বহ্নিশিখার তাড়া খেয়েই হানাদাররা পালিয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধের সেই আগুন পুরাতন ব্যবস্থাটাকে যে পুড়িয়ে ছাড়বে, তা ঘটেনি। সামাজিক বিপ্লব হয়নি। মানুষে মানুষে অর্থাৎ শ্রেণিতে শ্রেণিতে সম্পর্কটা সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। দেখতে দেখতে একশ' বছর নয়, দুইশ' বছরই পার হয়ে গেল। ইংরেজ শাসন পুরনো সামন্তবাদী সমাজ সম্পর্ককে যে নতুনভাবে শক্ত করে দিয়েছিল, কায়েম করেছিল 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত', সেটা এখন নেই। পুঁজিবাদ এ দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের চরম শত্রু পুঁজিবাদকে বিদায় করা চাই, তার অন্তর্গত ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা চাই সামাজিক মালিকানাকে। সেটা সম্ভব হবে না সামাজিক বিপ্লব ছাড়া।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক

(প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৮ জুন ২০১৯)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত