রিফাত হত্যাকাণ্ড কী বার্তা দেয়

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০১৯, ১৬:৫৬

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

মৃত্যু আর হত্যার পার্থক্য হচ্ছে: মৃত্যু কষ্টদায়ক, কিন্তু হত্যা বীভৎস; মৃত্যু বেদনাবিধুর, কিন্তু হত্যা মর্মান্তিক; মৃত্যু আবেগাক্রান্ত, কিন্তু হত্যা ক্ষোভ-উত্তেজক; মৃত্যু নিয়তির প্রশ্ন, কিন্তু হত্যা ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন; মৃত্যু মেনে নেওয়ার বিষয়, কিন্তু হত্যা বিচারের দাবিদার। কাজেই বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে একটি বীভৎস, মর্মান্তিক ও ক্ষোভ-উত্তেজক ঘটনা। আবার ন্যায্যতার প্রশ্নে রিফাত হত্যাকাণ্ড যথাযথ, উদাহরণযোগ্য এবং দ্রুত ন্যায়বিচারের দাবিদার। হোমার তার বিখ্যাত 'অডিসি'তে বলেছেন, 'হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকবে, যদি তার যথাযথভাবে বিচার না নয়।' সমাজে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে; কিন্তু তার যথাযথ বিচার হচ্ছে কি-না সে প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি। হত্যাকারীকে দ্রুত গ্রেফতারের অক্ষমতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা সীমাবদ্ধতা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং বহুমাত্রিক আইনি মারপ্যাঁচের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার না হওয়া। হোমারের ভাষায়, সমাজের হত্যাকাণ্ড প্রবলভাবে জারি থাকার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি এ কথাও স্বীকার্য যে, কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়; কিন্তু সেটা সমাজে হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য যুগান্তকারী এবং উদাহরণযোগ্য হয়ে ওঠে না বলেই হোমারের আশঙ্কা অনুযায়ী সমাজে এখনও বীভৎস হত্যাকাণ্ড জারি আছে। বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তার একটি নগদ নজির। 

এটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে- মানুষ, মনুষ্যত্ব ও সামাজিক অনুভূতি সমাজে ক্রম লোপমান। তাই এ রকম একটি বীভৎস ঘটনায় মানুষ ও সমাজ কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েকজন মানুষ (!) মিলে আরেকজন মানুষকে দা, রামদা ও চাপাতি দিয়ে প্রবল উগ্রতায় কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছে। আর একটি মেয়ে মানুষটাকে (তার স্বামী) বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হত্যাকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। আহাজারি করছে, কান্নাকাটি করছে, চিল্লাচ্ছে এবং নিজের স্বামীকে বাঁচানোর আকুতি-মিনতি করছে। অথচ আশপাশে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছে। কেউ ছবি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে এবং কেউ কেউ লাইভ হত্যাকাণ্ড দেখছে। এ পুরো ঘটনার যবনিকা হচ্ছে রিফাত শরীফের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ও মর্মান্তিক মৃত্যু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনা আমাদের কী বার্তা দেয়?

যখনই চাঞ্চল্যকর কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, পুরো সমাজ হঠাৎ করে চঞ্চল হয়ে ওঠে। মিডিয়া অধিকতর সরব হয়ে ওঠে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর টক শোতে বিস্তর বিশেষজ্ঞ বিশ্নেষণ চলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুদিন আহাজারি এবং সরকারের মুণ্ডুপাত চলে। তারপর চাঞ্চল্যকর ঘটনার চঞ্চলতার মৌসুম শেষ হয়ে যায়! নতুন মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে সবাই ও সবকিছু। এভাবেই আমাদের অনুভূতিগুলো ক্রমান্বয়ে ভোঁতা হয়ে উঠছে। আমরা আমাদের সব 'বিকার' ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে চালান দিয়ে 'নির্বিকার' হয়ে বসে থাকি। আর কারণে-অকারণে সরকার ও রাষ্ট্রকে গালাগালি করি। অবশ্যই সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্যের প্রশ্ন উত্থাপন করা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু কেবল সরকার ও রাষ্ট্রের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে নিজেরা নিজেদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছি, সেটার ক্রিটিক্যাল বিবেচনাও সমান জরুরি। আমাদের সমাজে যত ফেসবুক বিপ্লবী এবং কলাম বিপ্লবী আছেন, সে পরিমাণ যদি সত্যিকার সমাজ বিপ্লবী থাকতেন, তাহলে রিফাতকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হতে হতো না। রিফাতের স্ত্রী যখন রিফাতকে রক্ষা করার জন্য রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করেন, আহাজারি করেন, সবার কাছে আকুতি-মিনতি করছেন, তখন আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতাম না বা মজা দেখতে পারতাম না। ঝাঁপিয়ে পড়ে রিফাতকে উদ্ধার করতাম বা উদ্ধারের চেষ্টা করতাম। 

রিফাতের স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দিয়ে খুনিদের নিবৃত্ত করার যুদ্ধে লিপ্ত হতাম কিংবা দূর থেকে দেখে ঘরে বসে ভিডিও করতাম না। বরঞ্চ ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতাম। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রিফাতকে রক্ষা করার চেষ্টা করতাম; কিন্তু আমরা সেটা করিনি। বরঞ্চ এ রকম একটি জঘন্য, বীভৎস ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সম্মিলিত দর্শক হয়েছি। আর সরকার ও রাষ্ট্রের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ফেসবুক বিপ্লবী হয়ে উঠেছি। আবার কেউ কেউ এ বীভৎস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা না করে রিফাতের স্ত্রীর 'পরকীয়া' এবং 'ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী' প্রচার করে বিকৃত মজা নিচ্ছি। আমরা মজা দেখতে এবং মজা নিতে যতটা ওস্তাদ, নিজের নাগরিক, মানবিক, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব নিতে ততটা কাবিল নই। 

এ কথা সত্য যে, রিফাতের হত্যাকাণ্ড সারা বাংলাদেশে একটি তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। জনপরিসরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ হচ্ছে। সংবাদপত্রে মূল সংবাদ (কাভার স্টোরি) হচ্ছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে নেতৃস্থানীয় খবরের (লিড নিউজের) পাশাপাশি নানা কথা-প্রদর্শনী (টক শো) হচ্ছে। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতেও এ বিষয়ে নানা পর্যবেক্ষণ এবং বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু কেবল গ্রেফতার করাই এ সমস্যার সমাধান বা আসামিদের গ্রেফতার করে হাজতে প্রেরণ করাই কি এ সমস্যার সমাধান? 

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কেবল গ্রেফতার করাই সমাধান নয়। সমাজে বিদ্যমান সহিংসতার মনোভাব, ক্রমবর্ধমান অসহিষুষ্ণতার অনুশীলন, বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় বহুমাত্রিক ক্ষমতার সম্পৃক্ততা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সমাজে বিদ্যমান বীভৎস হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা হ্রাস করার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়। তাই গ্রেফতার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এ রকম ভাবনা বাস্তবসম্মত নয়। হত্যা-উত্তর গ্রেফতারমুখী তৎপরতার চেয়ে হত্যা-পূর্ব প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক জরুরি। কেননা, ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই ঘটনা কেন ঘটে, কীভাবে ঘটে, কোন প্রেক্ষিত বা প্রেক্ষাপটে ঘটে, সেটার অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ জরুরি। বিশ্বজিৎ হত্যা, সাগর-রুনি হত্যা, অসংখ্য ব্লগার হত্যাকাণ্ড, ত্বকী হত্যা, মিতু হত্য, তনু হত্যা এবং সম্প্রতি নুসরাত হত্যাসহ গত এক-দুই দশকের প্রধান হত্যাকাণ্ডগুলোকে বিশ্নেষণের আওতায় আনলে সমাজের ক্রমবর্ধমান বীভৎস হত্যাকাণ্ডের একটা সাধারণ সূত্র উপলব্ধি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কেননা হত্যাকাণ্ডের বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। ব্যক্তিগত শত্রুতা, রাজনৈতিক দ্বৈরথ, অর্থনৈতিক স্বার্থ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রবণতা, ধর্মীয় চরমপন্থা, ভিন্নমতাবলম্বিতা, প্রেমঘটিত বিরোধ, পেশাগত দ্বন্দ্ব কিংবা সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবেও হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। কিন্তু হত্যার প্রবণতা, হত্যার পরিকল্পনা, হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়া, বীভৎসতার মাত্রা এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটনের স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিয়ে একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। 

সমাজের বিদ্যমান স্কুলিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে হত্যাকাণ্ডবিরোধী চিন্তা-ভাবনা, দর্শন, মনোজগৎ, মানসিকতা ও সামাজিক সচেতনতাবোধ জাগ্রত করা না গেলে কেবল হত্যা-উত্তর আসামি গ্রেফতার করে সমাজের বিদ্যমান এবং বর্ধমান সহিংস ও বীভৎস ঘটনা রোধ করা খানিকটা কঠিন। এখানে স্কুলিং প্রতিষ্ঠান বলতে পরিবার, নানা সংঘ, স্কুল, সমবায়, ক্লাব, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ সেসব পরিসর প্রজন্মের মনোজগৎ তৈরি করে, জীবন-সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র সম্পর্কিত বোধ তৈরি করে, নীতি-নৈতিকতা-উচিত-অনুচিতের ধারণা নির্মাণ করে, সর্বোপরি সেসব পরিসর যেখানে প্রজন্মের মনে এবং মননে মানবতাবোধ ও দেশপ্রেম জন্ম দেয়, তাকে বোঝানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক-রাষ্ট্রীয় নীতি। তাই কেবল আইন ও আইনের প্রয়োগ দিয়ে সমাজে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস এবং রোধ করা সম্ভব নয়, যদি না সমাজ নিজেই একটি অপরাধবিমুখ মনস্তত্ত্ব সমাজের মানুষের মনে জাগাতে না পারে। তাই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব শক্তি দিয়ে আসামি গ্রেফতার করে জনগণের মনের তীব্র ক্ষোভ হয়তো সাময়িকভাবে লাঘব করা সম্ভব; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদের সমাজে জারি থাকা বিদ্যমান সহিংসতার প্রবণতা এবং বীভৎসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব নয়। ফলে সমাজের একটা ইতিবাচক ও গুণগত রূপান্তর অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে; কিন্তু সেদিকে কারও খুব একটা মনোযোগ আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। আমার 'কান নিয়েছে চিলে' বলে চিলের পেছনে কেবলই ছুটছি; কিন্তু কানে হাত দিয়ে খুব একটা দেখি না যে, কানটা আদতে কানের জায়গায় আছে কি-না। জালালুদ্দিন রুমি বলেছিলেন, আমরা আয়নায় চেহারা দেখি এবং ময়লা পরিস্কার করার নামে কেবল আয়না পরিস্কার করি। ফলে নিজের চেহারার ময়লা আর পরিস্কার হয় না! 

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(প্রথম প্রকাশ: সমকাল, ২৯ জুন ২০১৯)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত