সেই অবিনাশী উচ্চারণ

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৯, ১৮:৩৩

সাইদুর রহমান হৃদয়

এখন ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্চ মাস! বাঙালি জাতির কাছে এক ভিন্ন আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে এই মার্চ মাস ধরা দেয়। সেই আবেগ থেকেই আজ কিবোর্ড চেপে কিছুলেখার চেষ্টা। ছোট্ট বেলায় টিভিতে নাটক সিনেমায় কিংবা গল্পে আমরা অনেক কাল্পনিক বীর পুরুষের গল্প দেখেছি ও শুনেছি! কিন্তু আমরা নতুন প্রজন্ম কি জানি আমাদের প্রিয় জন্মভূমিতে এক সত্যিকারের বীর ছিলেন, ছিলেন এক মহানায়ক, শত্রুর মসনদ কেঁপে উঠতো তাঁর চাহনিতেই, তাঁকে দেখলে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ বাঁচার সাহস পেতো। যার কথায় ভরসা আর বিশ্বাস খুঁজে পেতো বাংলার কোটি মানুষ।

আজ মার্চের ৭ তারিখ। বাংলার মানুষ যখন নিজেদের আকাশে মুক্ত হয়ে উড়তে পারছিল না, রক্তদিয়ে পাওয়া নিজের ভাষায় যখন নিজের মা মাটি নিয়ে জোর গলায় কিছু বলতে পারতো না তখন তাদের মাঝে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন তরুণ শেখ মুজিব। পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি শিকল ভাঙার গান গেয়েছিলেন। আত্মযন্ত্রনায় ছটফট করা জাতিকে সাহস দিয়েছিলেন। কিভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে, কীভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে সেই পথ দেখিয়েছিলেন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত হতাশা, শোষণ আর বঞ্চনায় যখন তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল একটি জাতি তখন তিনি হাতে আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ত্রাণকর্তা রুপে আবির্ভূত হয়েছিলেন গোটা জাতির কাছে। বাংলার মানুষকে শুনিয়েছিলেন অভয়বাণী।

একাত্তর সালের সাত মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলার লাখো কোটি জনতা যেন কন্ঠে বল ফিরে পেয়েছিলো। হাতের মুঠোয় মৃত্যু আর চোখে স্বপ্ন নিয়ে বাংলার শ্রমিক, কৃষক-কৃষানী, যুবক-যুবতী, ছাত্র-শিক্ষক, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, কেরানী, নারী, বিত্ত, বেশ্যা, সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুকে বুকে জড়িয়ে এসেছিল মা, বয়সের ভাঁড়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও এসেছিলেন সেই অবিনাশী উচ্চারণ শুনতে। সেই মহানায়কের অপেক্ষায় থাকা লাখ লাখ মানুষের গগণবিদারী স্লোগানের উদ্দামতায় সেদিন মুখরিত হচ্ছিল বাংলার আকাশ-বাতাশ। জনতার চোখে আশার আলো জ্বালিয়ে আসলেন সবার প্রিয় মুজিব ভাই। দাঁড়ালেন মঞ্চে, ঘড়িতে তখন বিকেল ৩টা ২০ মিনিট। মহাকালের শ্রেষ্ঠ কাব্য বুঝি সেদিন রচিত হয়েছিলো রেসকোর্স ময়দানে। কবি বলতে শুরু করলেন বাংলার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা, স্বাধীনতার কথা, মুক্তির কথা, অধিকার আদায়ের কথা। তিনি পথ দেখালেন সংগ্রামের, মুক্তির, স্বাধীনতার।বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। একটু পর পর লাখো লাখো জনতা মুক্ত গলায় জোরে জোরে চিৎকার করে সমর্থন দিচ্ছিল সে কথায়। দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করে গেলেন বাঙালির হাজার হাজার বছরের চাওয়া পাওয়া, দুঃখকষ্টের কথা। তিনি বললেন কিভাবে মাথানত না করে অবিচল থাকতে হয়, কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়। তার বলা প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য একেকটি স্বতন্ত্র অর্থ বহন করছিল, নতুন বার্তা দিচ্ছিল, নতুন স্বপ্ন দেখচ্ছিল, যুদ্ধের যাবার সাহস যুগাচ্ছিল। বিকেল ৩টা ৩৮  মিনিটে শেষ হল বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস কাঁপানো মহান দীপ্ত ভাষণ। রচিত হয় এক মহাকাব্য।

মাত্র ১৮ মিনিটে তিনি বাঙ্গালি জাতিকে একটি নতুন ভাবনা তৈরি করে দিয়ে গেলেন। তর্জনীর এক ইশারায় তিনি একটি জাতিকে, একটি দেশকে একত্রিত করে একই দাবিতে সোচ্চার করে শোনালেন তার অমর বাণী ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটাই ছিল বাঙালির ঐক্যের মূলমন্ত্র, স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।

তিনি সেদিন বলেছিলেন আর যদি বাংলার কোন মানুষের বুকের উপর গুলি চলে, তাহলে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে। লক্ষ শপথের বজ্রমুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে। সেই সূত্র ধরেই ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর করে। বাংলাদেশকে একটি স্বশাসিত ভূখণ্ড হিসেবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে সাহায্য করেছে। ওই সময় দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তার পূর্ণাঙ্গ একটি চিত্র বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি উল্লেখ করেছেন। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও ৭ মার্চ হচ্ছে পাকিস্তানীদের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মহান মুক্তি সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ। এই ভাষণ বাঙালির মুক্তির সনদ।

বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের ইতিহাসে একজন অনন্য সংবেদনশীল নেতা যিনি জাতির প্রাণের স্পন্দন টের পেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও পরাজিত শক্তি ও তাঁদের এদেশীয় দোসরদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এরপরে এদেশে চরমভাবে ইতিহাস বিকৃতি হতে থাকে। এই নারকীয় খেলা থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।

যে ভাষণ শুনে গায়ের প্রত্যেকটি লোমকুপ দাঁড়িয়ে যায়, যে ভাষণ শুনে বাঙালিরা নতুন করে বাঁচতে শিখে, যে ভাষণ শুনে বাঙালিরা স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আজকের এই দিনে সেই ভাষণের মহানায়কের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর উত্তর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত