বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল আলম এবং রাফিয়া হাসিনার ‘ড্রিম টিম’ স্বপ্নকথা

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৪১

রাফিয়া হাসিনা এর সাথে লেখক

১.
রাফিয়া হাসিনা আমার প্রিয় আপা, এসেছেন আমেরিকা থেকে, স্বল্প সময়ের আকস্মিক সফরে স্বদেশের টানে, অসম্ভব বড় একটা স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। আপার প্রয়াত স্বামী ছিলেন সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ, নিবিষ্ট বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল আলম, বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ, পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। বিকেলটা কাটলো সেই মহান বিজ্ঞানীর ‘অর্ধেক আকাশ’ আমার প্রিয় আপার সাথে- তাদের স্বপ্নময় দেশপ্রেমের উজ্জ্বল ভাব-অনুভবের অনালোচিত নানা বিষয়ে। আমি কৃতজ্ঞ, মুগ্ধ আপার পরম সান্নিধ্যে, তার অকৃত্রিম দেশপ্রেমের আবেগি উচ্চারণে অনুরণনে উজ্জ্বীবিত। 

২.
স্বপ্ন বাস্তবায়নের জাদুকর বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বড় অবদান রেখেছেন। ক্ষতিকর ছত্রাকের ‘জীবনরহস্য’ উন্মোচনকারী কৃতী এই বিজ্ঞানী শস্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের হয়ে পাট ছাড়াও পেঁপে, রাবার এবং এক ধরণের ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন ড. আলম। ড. মাকসুদুল আলমের আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখানো সেই বাঙালি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন ছিলো তাঁর ‘ড্রিম টিম’ প্রকল্পটি বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে, বাঙালির মধ্য থেকে মেধাবিরা বিজ্ঞান গবেষণায় সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বকে তাক লাগাবে, বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করবে। আগ্রহী গবেষকদের জন্য বিশ্ব মানের বিজ্ঞান গবেষণাগার বাংলার বুকেই প্রতিষ্ঠা করার আজন্মের স্বপ্ন নিয়ে পাটের দুটি জাত ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী এই বিজ্ঞানী ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তিনি স্ত্রী রাফিয়া হাসিনা, কন্যাসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে যান। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সন্তান ড. মাকসুদুল আলম সবসময় নবীন গবেষকদের উৎসাহ জাগিয়ে বলতেন, ‘স্বপ্ন দেখো, তুমিও পারবে’।

৩.
বাঙালি এই মহান জিন বিজ্ঞানীর জন্মদিনে কিংবা প্রয়াণদিনে কোন আয়োজন চোখে পড়েনি, পড়ে না আমার। অথচ তিনিই সরকার থেকে গবেষণা প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মাসে ২৮ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হলেও নেননি। তিনি ওই টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে তার প্রতিষ্ঠিত জৈব প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রে দিয়ে দিলেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তাই মনে প্রশ্ন জাগে একজন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক মাকসুদুল আলম কী করে তৈরি হলেন? যিনি মোট প্রায় ৬ কোটি টাকা পারিশ্রমিক না নিয়ে দেশের জন্য দিয়ে দিলেন? 

৪.
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যার সুদূর হাওয়াই থেকে বাংলাদেশে তার যাতায়াত ছিল দেশের কৃষকের হাতে উন্নত মানের পাটের জাত তুলে দেয়ার স্বপ্ন থেকে। পাট নিয়ে মাকসুদুল আলমের এই স্বপ্নের সূতিকাগার অবশ্য হাওয়াই শহরে না। এর শুরু ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে কামরাঙ্গীরচরে। তাই তিনি এই শহরেই চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নময় বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠা এবং আগ্রহী নবীনদের জন্য ড্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে। রাফিয়া হাসিনা আপার মতোন প্রশ্ন আমারও- মহান এই দেশপ্রেমিক মানুষটির স্বপ্ন সফল করতে, বাস্তবায়ন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন কী? 

৫.
নতুন প্রজন্মের সামনে অনুপ্রেরণার অসীম উৎস হিসেবে বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের জীবন ও সংগ্রাম অবশ্যই উল্লেখ করবার মতোন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ মাকসুদুল আলম শুধু নিজেই গবেষণা কাজ নিয়ে এগিয়ে যাননি। দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জিন বিজ্ঞানী তৈরির কাজেও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় একটি বায়োটেকনোলজি সেন্টার স্থাপন হয়েছে তাঁর উদ্যোগে। সেখানে বিশ্ব মানের গবেষণার সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। এক ঝাঁক তরুণ জিন বা জেনোম বিজ্ঞানীও তৈরি করে গেছেন তিনি। ড. মাকসুদুল আলম, বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং করে যিনি স্থান নিয়েছেন সেরা সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায়! ফলে ‘ড্রিম টিম’-এর জন্ম দিয়ে তিনি কাংখিত গবেষণাগারের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর স্বপ্নবীজকে মহীরুহ করার দায়িত্ব এখন রাষ্ট্র-সরকারের, আমাদেরও। পাটের জিন-নকশার উদঘাটক বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলমের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে গভীর আস্থা নিয়ে আমরাও জোর গলায় বলি, ‘স্বপ্ন দেখো, তুমি পারবে’।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত