বাংলাদেশে বিনিয়োগ: কি ভাবছে ভারত?

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:১৪

হাসান ইবনে হামিদ

আর মাত্র কয়েকদিন, বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তাপ ছড়িয়েছে সর্বত্র।  নির্বাচনের সময় যতোই ঘনিয়ে আসছে দেশে বিদেশে এই নির্বাচন নিয়ে আলাপ আলোচনা ততোই বাড়ছে। অনেক ভয় শঙ্কা দূর করে দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই সকল দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে শেষ মুহুর্তে এসে বিভিন্ন জায়গায় কিছু বিচ্ছিন্ন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, দু’দলের নেতাকর্মীরাই এই ভয়াবহ অবস্থার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না থাকায় আগে থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে এক নীরব অস্থিরতা বিরাজ করছিলো। এই অস্থিরতার ফাঁদে দেশ আটকা পড়লে ক্ষতি শুধু যে কোন রাজনৈতিক দলের হতো তা না বরং এটা গোটা রাষ্ট্রের ক্ষতি। তাই নির্বাচন নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত বা বাংলাদেশের সহায়তায় এগিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে ভারত সরকারের মনোভাব নিয়ে এর আগে বেশ কয়েকটা লেখা লিখলেও বিদেশী বিনিয়োগ ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই লেখা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের মনোভাব কি? কি ভাবছেন সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে। 
বিদেশি বিনিয়োগকারী ও নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখন কেমন আছে, আগের চেয়ে অনেক ভালো ও শিল্পবান্ধব কিনা এসব বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে মতামত দিয়েছে ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। বিশেষত, ভারতের যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে, দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের কি বার্তা দেয়া হয়েছে! ভারত সরকার কি আশ্বস্ত করেছে বিনিয়োগকারীদের নাকি ভিন্ন কোন বার্তা দিয়েছে! ভারতের এনটিপিসি,  রেল  কিংবা ওএনজিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং টিসিএস, এমএন দস্তুরের  মতো বিভিন্ন সফটওয়্যার ও প্রকৌশলী সংস্থা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পে যুক্ত। এসব প্রকল্পে তাদের কারও কারও বিপুল অঙ্কের লগ্নিও রয়েছে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় এই সংস্থাগুলোকে ‘ব্রিফ’ করতে গিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, ভোটের কারণে তাদের শিল্পগুলো ঝুঁকির মুখে পড়বে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বরং কোনও নির্বাচনি সহিংসতার আঁচ এই প্রকল্পগুলোকে স্পর্শ করবে না বলেই ভারত সরকার মনে করে। এই বক্তব্যগুলো নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য ভালো, বাংলাদেশে বিনিয়োগ যারা করছেন তাদের জন্য আলাদা আগ্রহের জায়গাও তৈরি করবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ভারতের সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি)। ওই সংস্থার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এই ব্যাপারে পজেটিভ বক্তব্য দিয়েছেন। এনটিপিসি বলছে, ‘ভারত সরকার আমাদের পরিষ্কার বলেছে, বাংলাদেশে লগ্নি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিস্থিতি যে আগের চেয়ে অনেক ভালো, সেটাও উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’

নির্বাচনের আগ মুহুর্তে এই বিবৃতিগুলো আমাদের জন্য ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বেশ কিছু জঙ্গি হামলার সাক্ষী হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের ওপর আক্রমণের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে,  ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালানো হয়, এই বিষয়গুলো নিয়ে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু হলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশ সরকারের কঠোর জঙ্গীবিরোধী অবস্থানের কারণে আর কোনও বড় ধরনের হামলা ঘটতেই পারেনি। বিএনপি আমলে যেখানে ভারতের টাটা বা সাহারা শিল্পগোষ্ঠীর মতো বৃহৎ সংস্থাও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিল, সেই জায়গায় এখন শতাধিক ভারতীয় সংস্থা বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় প্রকল্পে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, বিএনপি-জামাত শাসনামলে তারেক জিয়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেছিল বলে ভারতের কাছে প্রমাণ রয়েছে। সেই সময়টাতে তা অত্যন্ত আলোচিত ঘটনা ছিলো।

উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রদূত মি. চৌধুরী যখন সিলেটে শাহ জালালের মাজার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখন জঙ্গিরা তাকে হত্যার চেষ্টা করে। পরে গত বছরের এপ্রিলে ওই হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। শুধু এই হামলাই নয় বরং একের পর এক জঙ্গি হামলায় তখন দেশ ছিলো বিপর্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার প্রশ্রয়েই সন্ত্রাসীরা একের পর এক জঙ্গি হামলা চালায় বাংলাদেশে যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও দশ ট্রাক অস্ত্র চালানের চেষ্টার মধ্য দিয়ে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের তথ্যসূত্রমতে জানা যায়, ওই ঘটনার দৃষ্টান্ত টেনে ভারত সরকার কয়েকদিন আগে তাদের দেশের শিল্প সংস্থাগুলোকে বলেছে, ‘খোদ রাষ্ট্রদূতের জীবনের ওপর হামলার পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগও ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সরকার ও সে দেশের লগ্নিকারীরাও আবার বাংলাদেশে ফিরে আসছেন।’

আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশে ভারতের ছোট বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। যেমন ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস কোম্পানি ও এনজিসি-র সহযোগী সংস্থা ‘ওএনজিসি বিদেশ’-ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশের দু’টি ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে ‘স্টেক’ আছে, এমন ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য দিল্লিতে গত সপ্তাহে এক সম্মেলন আয়োজন করা হয় যেখানে  ওই বিশেষ সরকারি ‘ব্রিফিং’য়ে উপস্থিত ছিলেন ওএনজিসি বিদেশের কর্তারাও। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি রীতিমতো সন্তোষজনক বলে মনে করলেও জামায়াতের মতো সংগঠনগুলো যে নাশকতা চালানোর চেষ্টা করতে পারে, সেটাও অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছে।’ অর্থাৎ গণহত্যাকারী মৌলবাদী সংগঠন জামাতে ইসলাম নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারতও। ভারত সরকারের এ আলোচনায় প্রসঙ্গতই উঠে এসেছে মার্কিন কংগ্রেসে ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি ও রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ জিম ব্যাঙ্কসের পেশ করা সাম্প্রতিক প্রস্তাবের প্রসঙ্গও। যেখানে জামাতে ইসলাম, হেফাজতে ইসলামের মতো জঙ্গি মনোভাবাপন্ন দলগুলোকে নিয়ে ভয় ও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ২০শে নভেম্বর কংগ্রেসে পেশ করা ওই প্রস্তাবে (হাউস রেজলিউশন ১১৫৬) জিম ব্যাংকস সোজাসুজি বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত ও সমমনা  চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোই বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রর জন্য প্রধান বিপদ।’বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন হামলার ঘটনাতেও তিনি সরাসরি দায়ী করেছেন জামাতকেই। তার ওই প্রস্তাবটি এখন মার্কিন কংগ্রেসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক কমিটির বিবেচনার জন্য রেফার করা হয়েছে।  পরে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসি-তে স্ট্র্যাটেজিক থিংকট্যাংক হাডসন ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ বিষয়ক এক আলোচনাসভাতেও তিনি অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। সেখানেও জিম ব্যাংকস বলেন, ‘‘দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি ‘বুমিং ডেমোক্র্যাসি’, সারা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তাদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোই সে দেশের সমৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা!

এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্য শুধু চাহিদার ওপর নির্ভর করে হয় না। এর জন্য সরকারের 'রাজনৈতিক সদিচ্ছা' খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে এক আন্তরিকতা দেখা গেছে, যা আমাদের আশাবাদী করে তুলে। তাছাড়া ভারতে রফতানিতে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলো দূর হচ্ছে। আবার ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরা ভুলে যাই, ব্যবসা বা বিনিয়োগের বিষয়গুলো রাতারাতি হয় না।

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু দাবী ছিলো যেমন ভারতের কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির (সিআইআই) কাছে বিএসটিআইর সনদ গ্রহণ, স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, অ্যান্টি ডাম্পিং ট্যাক্স আরোপ বন্ধ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নসহ ছয় দফা দাবি, যা এখন  বাস্তবায়নের পথে। এগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য টাস্কফোর্স করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, দ্রুত বাংলাদেশ আরো কিছু সুবিধা পাবে। যদিও এরই মধ্যে কিছু পণ্যে তারা বিএসটিআইর সনদ নিয়ে থাকে কিন্তু আরও কিছু পণ্যে সে সুবিধা হলে আমাদের পণ্য রফতানি বেড়ে যাবে। অনেক অশুল্ক বাধা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। ভৌগোলিক কারণে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের অনেক পণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ইট, সিমেন্ট, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও প্রসাধন পণ্যের চাহিদা বেশি। ইতোমধ্যে অনেক জিনিস রফতানি হচ্ছে এবং  আশা করা যায়, রফতানি আরো দ্রুত বাড়বে। 

আঞ্চলিক বাণিজ্যের জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগ খুব জরুরি। উন্নত দেশগুলো একজোট হয়ে অনেক আগেই তা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটা দেশ থেকে ট্রাকে পণ্য নিয়ে চার-পাঁচটি দেশ পার করে অন্য দেশে যাচ্ছে। একইভাবে আসিয়ানে একটা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। এ রকম একটা যোগাযোগ এ অঞ্চলেও দরকার ছিলো। অবশেষে বিবিআইএন নামে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারত বিবিআইন কার্যকর করার বিষয়ে উদ্যোগী। আমাদের চট্টগ্রাম, মংলা ও পানগাঁও বন্দর আধুনিক হয়েছে। নেপালের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। তারা কলকাতার বন্দর ব্যবহার করে। নেপাল যদি আমাদের বন্দর ব্যবহার করে, তাহলে আমরা উপকৃত হতে পারি। একইভাবে ভারত আমাদের বন্দর ও সড়ক ব্যবহার করতে চায়। এর মাশুল কী হবে, তা উভয় দেশের সরকার ঠিক করবে। তবে এ ধরনের মাশুল নির্ধারণে বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি রয়েছে, সরকার নিশ্চয় সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। আর উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা চাই এটা হোক। কেননা এতে বাণিজ্যে লাভবান হবে দু’দেশ। শুধু যে বাণিজ্যের দ্বার এক্ষেত্রে উন্মুক্ত হবে তা কিন্তু নয় বরং এতে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের জায়গা সুসংহত হবে। আমরা আশা রাখি সকল বাধা কাটিয়ে লাল সবুজ তেরঙ্গা এক পথে হাঁটবে। গণভবন থেকে জনপথ রোডের দূরত্বও যাবে কমে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অমর হোক।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক  বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত