লিবার্টি নিশ্চিত করছে সুপ্রিম কোর্ট

প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:১২

ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের রায়টা সারা দুনিয়ার লিবারেল প্রোগ্রেসিভ মানুষদের মধ্যে একটা আনন্দের সুবাতাস বয়ে নিয়ে এসেছে। ভারত একটা বড় দেশ। সারা দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশ বাস করে ভারতে। সেই বিচারে ভারতে যখন ওদের সার্বোচ্চ আদালত ঘোষণ করে দিচ্ছে ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক, সমপ্রেমি সম্পর্ক প্রকৃতি বিরোধী কিছু না, সকল নাগরিকের অধিকার আছে ওদের নিজের ঘরে নিজের পছন্দ মতো জীবন যাপন করা ইত্যাদি, তার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ মানুষ আজ যুক্ত হয়েছে লিবার্টির পক্ষে, প্রেমের স্বাধীনতার পক্ষে।

রায়টা কি? মুল রায়টা হচ্ছে যে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা অবৈধ। এর মানে কি? ৩৭৭ ধারায় কি বলা ছিল? ৩৭৭ ধারায় বলা ছিল যে প্রকৃতির ধারার বিপক্ষে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা একটি অপরাধ। তাতে দোষের কি আছে? দোষের ব্যপারটা হচ্ছে যে এই আইনে ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে কেবল নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কই প্রাকৃতিক এবং বাকি সব অপ্রাকৃতিক। মানে হচ্ছে দুইজন পুরুষ বা দুইজন নারী যদি পরস্পরে সাথে মিলিত হয় সেটা হবে একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিজের বেডরুমে পরস্পরের সম্মতিতে মিলিত হলে সেটাও নাকি অপরাধ। এই বিধানটা এখন থেকে ভারতে বাতিল হয়ে গেল। সমপ্রেম এখন আর ভারতে অপরাধ নয়।এই রায়ের ভিত্তিটা কি? কোন যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্ট বললো যে সমপ্রেম কোন অপরাধ নয়?

সুপ্রিম কোর্ট বলছে দুইজন সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রকৃতিবিরুদ্ধ কোন ব্যাপার না। তার চেয়েও বড় ব্যাপার যেটা, মানুষের অধিকার আছে নিজের একান্ত জীবনটি নিজের মতো করে যাপন করার। এটি হচ্ছে মানুষের জীবনের অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার ও সমতার অধিকারের অংশ। অন্য ভাষায় বললে, লিবার্টি, লিবার্টি নিশ্চিত করছে সুপ্রিম কোর্ট। আমি কাকে ভালবাসবো কার সাথে প্রেম করবো সে আমার লিবার্টি অংশ। এখানে রাষ্ট্র বা সমাজ বা আইন বা আদালতে হস্তক্ষেপ করার কিছু নাই।

আমার রক্ষণশীল বন্ধুরা যারা আছেন, ওদের অনেকেই আছেন, আমি জানি, যারা প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠবেন আর সমপ্রেম ভালো কি মন্দ সে নিয়ে তর্ক জমানোর চেষ্টা করবেন। ওদেরকে বলি, ধীরে বন্ধু ধীরে। এই রায়টার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিই রয়েছে যেটা আপনার এই বাজে তর্কটাকে বাতিল করে দেয়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে যে, সংখ্যাগুরু মানুষের পছন্দ বা অপছন্দ দিয়ে মানুষের লিবার্টি বা স্বাধীনতার পরিধি নির্ধারিত হয় না। যতক্ষণ না আপনি আরেকজনের ক্ষতি করছেন, আপনার অধিকার রয়েছে যা ইচ্ছা তাই করার।

সুতরাং আপনারা যারা সমপ্রেম ভালো কি মন্দ সে নিয়ে তর্ক করতে চান, ভাই সাহেব, তর্কটা তুলে রাখেন নিজের জন্যে। আপনার কাছে যদি ব্যাপারটা মন্দও মনে হয় এবং আপনারা যদি সংখ্যাগুরু হয়ে থাকেন তাতে কিছু যায় আসে না। একজন মানুষ তার নিজের বেডরুমে কি করবে না করবে সেটা তার নিজের ইচ্ছা। দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কি করবে না করবে সেটা ওদের ইচ্ছা। আপনার ভাল লাগুক কি না লাগুক তাতে কিছু যায় আসে না।

শোনেন, এই রায়টা আসলে মানুষের যৌনতা বা যৌনতার স্বাধীনতার পক্ষের রায়ই কেবল না, এটা হচ্ছে লিবার্টির পক্ষে রায়, মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষে ও স্বাধীনতার পক্ষে রায়। সমপ্রেমের প্রেক্ষাপটেই রায়টা দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু এটা হচ্ছে লিবার্টির পক্ষে রায়। আদালত আপনাকে বলছে না যে সমপ্রেম একটা চমৎকার ব্যাপার, সকলে সমপ্রেমি হয়ে যান। আদালত যেটা বলছে সেটা হচ্ছে যে, সমপ্রেম একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার, এটা কোন মানসিক অসুস্থতা নয়। সকলেরই অধিকার আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সে কার সাথে প্রেম করবে। আপনার পছন্দ আপনি অপরের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। ব্যাস।

আজকে আমাদের জুলহাস মান্নানের কথা মনে পড়ছে। এই লোকটা বাংলাদেশে সমপ্রেমিদের অধিকারের পক্ষে একটা লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন। শয়তানগুলি লোকটাকে হত্যা করেছে। জুলহাস মান্নানের পক্ষে যুক্তি ছিল, ফান্ডামেন্টালিস্টদের পক্ষে যুক্তি ছিল না- সেজন্যে ওরা জুলহাসকে হত্যা করে ওর লড়াইটা থামাতে চেয়েছে। কিন্তু লড়াইটা কি থেমেছে? না। থামেনি। এটা তো কেবল ঢাকা শহরের একটা ইস্যু না, বা কেবল বাংলাদেশের ইস্যু না। এটা গোটা মানবজাতির স্বাধীনতা ও লিবার্টির প্রশ্ন।

বিশ্বজনীন এই লড়াইয়ে ভারত সেক্টরে আজকে একটা জয় এসেছে মাত্র। কিন্তু পথ অনেক বাকি- এমনকি ভারতেও। কেবল একটা রায় হয়েছে, এটা একটা সূচনা বটে, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় নয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত