প্রসঙ্গ ভারত

আগে সাম্রাজ্য, তার পর তো রামরাজ্য

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০১৮, ১৫:২৯

সৈকত বন্দোপাধ্যায়

আমাদের প্রথম শত্রু, বিধর্মীরা। টিভির দ্রৌপদী পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, এ দেশ হল হিন্দুদের। বাবর এসে দেহলির নাম করে দিয়েছেন দিল্লি, শাজাহান তেজঃমহলের নাম বদলে করেছেন, তাজমহল, সে অনাচার আর সহ্য করা হবেনা। সব বিধর্মী নাম বদলে দেওয়া হবে। মুঘলসরাই এর নাম হবে দীনদয়াল উপাধ্যায়, মোগলাই পরোটার নাম হবে শ্যামাপ্রসাদ । লালকেল্লা ইতিমধ্যেই ডালমিয়া কোম্পানির হাতে চলে এসেছে। যদিও বিশুদ্ধ হিন্দু সংস্থা, কিন্তু নামের শেষে 'মিয়া' থাকায় এখনও নাম বদলনো যায়নি, তবে চিন্তার কিছু নেই, শেষ দুটো অক্ষর বাদ দেবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। জটিলতা কাটিয়ে শীঘ্রই লালকেল্লা স্রেফ ডালকেল্লায় পরিণত হবে। দেশে বিধর্মীদের নো-এন্ট্রি হবে। গরু খেলেই জবাই হবে। সবার জন্য ঘর ওয়াপসির ব্যবস্থা ও অন্যথায় গরম দাওয়াই এর সুবন্দোবস্তো থাকবে।

এর পরের শত্রু হল দলিতরা। সবাই নয়। যারা মনুর বৈজ্ঞানিক বর্ণভেদ প্রথা মনেপ্রাণে মেনে চলে, তারা গুড বয় দলিত। ব্যাডবয় দলিতরা হল তারা, যারা আমবেদকার পন্থী। আম-বেদ-কার এর পুরো কথা হল আম (জনতার) বেদ (পাঠে) অধিকার। সে এক অনাসৃষ্টি কান্ড। জবাবে আমরা নিয়ে এসেছি নতুন স্কিম রাম-বেদ-কার। অর্থাৎ কিনা রামের মতানুসারে বেদ পড়ুন। স্রেফ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরাই পড়বেন। শূদ্ররা বেদ পড়লেই রাম তাদের কানে সিসে ঢেলে দিতে বলেছিলেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরাও তাই করব।

তিন নম্বরে আছে মেয়েরা। আবারও, সবাই নয়, নিশ্চিন্ত থাকুন, ঘরের লক্ষীরা ঘরে নিরাপদেই থাকবেন। সনাতন ঐতিহ্য ভুলে বাইরে বেরিয়ে জিনস আর টি-শার্ট পরে যারা ফরফরাচ্ছে, স্রেফ তাদেরই বাম্বু দেওয়া হবে। যোগিজী বলেছেন, স্বাধীনতা দিয়ে কী হবে, মেয়েদের চাই সম্মান আর নিরাপত্তা। নিরাপত্তার জন্য আমরা দুটো সুযোগ দিচ্ছি। হয় অ্যারেস্ট, নয় হাউস অ্যারেস্ট। হয় বন্দী নয় গৃহবন্দী। গ্রেপ্তার এড়াতে হলে বিয়ের আগে বাপের ঘরে গৃহকর্ম প্র‌্যাকটিস করুন, বিয়ের পরে কর্মক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করুন। ব্যস। লঙ্কায় গিয়ে উড়ে বেড়ানোর অপরাধে রাম সীতাকে জনকের কাছে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পরিণতি থেকে ঘরের মেয়েদের বাঁচানোর জন্যই এই প্রকল্প, তাই এর নাম বেটি বাঁচাও।

চার নম্বরে সহজ টার্গেট বুদ্ধিজীবিরা। ব্যায়াম ফ্যায়াম করেনা, ব্যাটাদের এমনিই মেরুদন্ডে জোর কম, শুধু মুখে ফটর ফটর আর বিদেশীদের দালালি। যেগুলো আমাদের পকেটে ঢুকে গেছে, তাদের কোনো সমস্যা নেই। ইহকালে পুরষ্কার আছে, পরকালে ঊর্বশী-রম্ভা। বাকি গুলোকে একটা একটা করে টিপে মারব। কালবুর্গি আর গৌরী লঙ্কেশকে এর মধ্যেই নিকেশ করা হয়েছে, উমর খলিদটা এ যাত্রায় টিকে গেছে, পরের বার টিকবেনা। আরও কটাকে মাওবাদী কানেকশন আছে বলে রাউন্ড আপ করে জেলে ভরে দিয়েছি। দুচারটে এখনও বাইরে থেকে গেছে, পায়ে পড়ে গেলে ছেড়ে দেব, নইলে এক এক করে নিকেশ।

কিন্তু এতেই কী আর শত্তুরের শেষ হয়? চারদিকে বিদেশী এজেন্ট থিকথিক করছে। বিধর্মীরা এই হিন্দুরাষ্ট্রকে গ্রাস করবে বলে সর্বদা হাঁ করে আছে। ডানদিকে সবুজ পাকিস্তান, বাঁদিকে লাল চিন। চতুর্দিকে আইএসআই গিজগিজ করছে। সমস্যা হল আলাদা করে চেনার উপায় নেই, সব ব্যাটারই দুটো হাত দুটো পা। এই চক্রান্ত ঠেকাতে দাওয়াই একটাই। বিদেশী মনে হলেই বলব অনুপ্রবেশ, আর অনুপ্রবেশ সন্দেহ হলেই হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাব, নইলে লাথি মেরে বার করে দেব। বিদেশী মনে হবে কীকরে? সিম্পল, এই বাজারে যারা যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে চায়, যারা এনারসির বিরোধিতা করে, ডিমাইনিটাইজেশনের সমালোচনা করে, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে খচরামি করে, সব ব্যাটা বিভীষণ। মোটমাট, কালো টাকা উদ্ধার হোক না হোক, প্রতিশ্রুত পনেরো লাখ ব্যাংকে জমা পড়ুক না পড়ুক, মেক-ইন-ইন্ডিয়া একটি বিশুদ্ধ গুলবাজি হলে হোক, প্রধানমন্ত্রী দশ লাখ টাকার সুট পরলে পরুন, সরকার আম্বানি-আদানির মুঠোয় এসে গেলে যাক, যা খুশি হোক, তা নিয়ে খিল্লি করবেননা। কোনো রকম বিরোধিতা করলেই আপনি শত্রুপক্ষ। দরকার হলে একশ কোটি লোককেই জেলে পুরে দেওয়া হবে। গণতন্ত্র? বাকস্বাধীনতা? গোল্লায় যাক। আগে তো রাজামশাই বাঁচুন। আগে সাম্রাজ্য, তার পর তো রামরাজ্য।

সৈকত বন্দোপাধ্যায়’র ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত