সিনহার শিং কি আবার গজাচ্ছে?

প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০১৮, ১৫:৪৩

এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আবার নতুন করে সংবাদের শিরোনামে পরিণত হয়েছেন। তবে কোন মঙ্গল বার্তা নিয়ে নয় বরং জাতীয় জীবনে চরম অমঙ্গল এবং উৎকণ্ঠার কারণ ঘটিয়ে। প্রথম খবরটি আসে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাহেবের বক্তব্য থেকে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভায় ভাষণ দানকালে মন্ত্রী মহোদয় অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ভাষায় বলেন যে, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সিনহা ড. কামাল হোসেন গংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পাকিস্তানী কায়দায় আমাদের বর্তমান আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

একজন মাননীয় মন্ত্রী যখন কথা বলেন তখন তিনি নিশ্চয়ই তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই তা বলেন। তাদের কাছে এমন সব তথ্য থাকে যা অন্যদের কাছে থাকে না। তারা গোয়েন্দা সূত্রসহ বিবিধ সূত্র থেকে তথ্য পেয়ে থাকেন।

তদুপরি বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের আগের ঘটনাপ্রবাহ থেকেও এটা পরিষ্কার যে, বিচারপতি সিনহা পাকিস্তানী স্টাইলে সাংবিধানিক ধারায় আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর পাকিস্তানী স্টাইলের কথা তো তিনি প্রকাশ্য আদালতেই বলেছিলেন। কিন্তু তার বিধি যে বাম। যথা সময়েই তার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায়। বের হয়ে আসে তার হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি। ধন্যবাদ জানাতে হয় আমাদের নিপুণ এবং একনিষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং অনুসন্ধান সাংবাদিকদের, যারা এসব তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। আপীল বিভাগের অন্য চার বিচারপতি এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে না বসার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তার দুরাশা ভেস্তে যায়, দেশও বেঁচে যায়।

এ তো গেল অতীতের কথা। কিন্তু শঙ্কার কথা হলো এই যে, আইনমন্ত্রীর ভাষণের পরে আরও দুটি খবর এসেছে যা সত্যি ভয়ঙ্কর, যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে ঘিরে। প্রথমটি এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে। তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই যা ব্যক্ত করেছেন তা হলো, সম্প্রতি বিচারপতি সিনহা নিউইয়র্কে গিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ভাই মীর মামুনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করেছেন। জয় অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাষায় এও বলেছেন যে, তার কাছে এ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে।

তৃতীয় সংবাদটির উৎস দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক শ্রী শংকর কুমার দে। শ্রী দে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১৪ আগস্ট সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন তার শিরোনাম ছিল ‘সরকারবিরোধী নতুন ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি এখন সিনহা।’ দীর্ঘ এই লেখাটির মূল কথা হলো, যুদ্ধাপরাধীরা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে প্রচুর অর্থ প্রদান করছে তিনি যেন এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। শ্রী দে আরও উল্লেখ করেছেন বিচারপতি সিনহা এ টাকা দিয়ে একটি বই লিখছেন যাতে বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার থাকবে। শংকর কুমার দে যে বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তার কথা আমি আগেই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এক সূত্র থেকে শুনেছিলাম এবং এও শুনেছিলাম সিনহা লন্ডনপ্রবাসী একজনকে অনুরোধ করেছিলেন তার বইটি লিখে দেয়ার জন্য।

পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত আছেন, মীর কাশেম আলীর রায়ের পূর্বে সিনহা এই মামলা নিয়ে বহু নাটক এবং তালবাহানা করেছেন যার থেকে সংশ্লিষ্ট সকলেই এই মর্মে শঙ্কিত হয়েছিলেন যে, বিচারপতি সিনহা মীর কাশেম আলীর থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করেছেন। এই যৌক্তিক শঙ্কার কারণেই দুজন মন্ত্রীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরব বেশ কয়েকজন একটি গোলটেবিল বৈঠক করে সিনহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এর ফলে সিনহা পরে দুজন মাননীয় মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার জন্য অর্থদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন, যদিও তাদের কাছে নির্ভুল প্রমাণ ছিল যে, সিনহা মীর কাশেম আলীকে বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত।

আজ বিচারপতি সিনহা সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে তা দেখে বার বার আক্ষেপের সঙ্গে একটি কথাই মনে পরছে। সেটি হলো, আজ থেকে তিন বছর পূর্বে যখন আমি, স্বদেশ রায় এবং এ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন বিচারপতি সিনহার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে। তখন অনেকেই আমাদের বিশ্বাস করতে চাননি বরং বলতেন আমরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তার বিরুদ্ধে বলছি। কিন্তু আমি তো তার কথোপকথন থেকে বুঝেই বলতাম যে, তার এজেন্ডা ছিল এ সরকারের পতন ঘটানো। তার দুর্নীতির তথ্য তো আমরা অনেক সূত্র থেকেই জেনেছি এমনকি সিঙ্গাপুর থেকেও। সাকার মামলার রায়ের আগে অনুরুদ্ধ কুমার রায় নামক এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে লন্ডনের গ্লোস্টার মিলেনিয়াম হোটেলে দূতাবাসের মাধ্যমে দুটি ঠওচ ঝঁরঃ বুক করা ইত্যাদি খবর তো আগেই জেনেছি।

এ ব্যাপারে স্বদেশ রায়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগেই লিখেছিলেন, যে লোক ১৯৭১-এ শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি আপীল বিভাগ কেন কোন আদালতেরই বিচারক হতে পারেন না। এ কারণে বিচারপতি সিনহার চিরাচারিত ক্ষোভ ছিল স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভাষ্য প্রমাণ করছে যে, মীর কাশেম আলী পরিবারের সঙ্গে সিনহ্ার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল এবং তিনি মীর কাশেম আলীর রায়ের পূবেই তার থেকে প্রচুর অর্থ পকেটস্থ করেছিলেন বলে যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তাদের বিশ্বাসে যুক্তি ছিল। তবে পরিস্থিতির চাপে সিনহ্া মীর কাশেম আলীকে খালাস দিতে পারেননি। প্রসিকিউশন মামলা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে ইত্যাদি কত কথাই না সিনহ্া বলেছিলেন মীর কাশেম আলীকে খালাস দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য। দুই-দুইবার, বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

যে বিষয়টিতে আমি সবচেয়ে বিসিত এবং শঙ্কিত হয়েছিলাম সেটি ঘটেছিল ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। বিচারপতি সিনহা বঙ্গ ভবনে প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নিয়ে আদালতে ফিরেই আপীল বিভাগের ১নং কোর্টের তালিকা থেকে আমার নাম কর্তন করে দেন। ১নং কোর্টে যুদ্ধাপরাধীদের আপীলের শুনানি হচ্ছিল এবং আমি আপীল বিভাগে পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকে ১নং কোর্টেই ছিলাম এবং যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, সাঈদী এবং কামারুজ্জামানের আপীল শুনেছি তাদের সকলের বিরুদ্ধেই, সাঈদীসহ ফাঁসির রায় দিয়েছি। তদুপরি ১নং কোর্টে ব্যারিস্টার মওদুদের বাড়ির আপীলও ছিল। সে মামলাও আমি আংশিকভাবে শুনেছি। আমাকে ১নং কোর্ট থেকে সরিয়ে দেয়ায় বিসিত হয়ে ২০১৫ সালের ১৭ জুন আমাকে ১নং কোর্ট থেকে ২নং কোর্টে পাঠানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রধান বিচারপতি সিনহা অকপটেই বলে ফেললেন যে, সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী তিনি আমাকে সাকার মামলা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন, সাকার পরিবার কোনভাবেই আপনাকে (মানে আমাকে) এই মামলার জন্য মেনে নিতে পারছিল না। আমি তখন প্রধান বিচারপতি সিনহাকে বললাম, প্রধান বিচারপতি হিসেবে বেঞ্চ গঠনের ক্ষমতা একান্তই আপনার। কিন্তু আপনি কি করে আসামিদের কথায় বেঞ্চ গঠন করেন? আমি আরও বললাম- সবচেয়ে বড় কথা আপনার আদালতে যাদের মামলা বিচারাধীন তাদের সঙ্গে আপনি কি করে দেখা করেন? বিচারপতি সিনহা আমার এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। তিনি আরও বলেছিলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ তার (সিনহার) হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলেন, আর যাকেই তার আপীল শুনানিতে রাখা হোক না কেন বিচারপতি মানিককে যেন না রাখা হয়।

প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে আমার সেদিনের কথোপকথন শুধু রেকর্ডই হয়নি, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। প্রচারিত হয় ৭১ টেলিভিশনে, যার ফলে সিনহা আর সাকার পক্ষে রায় দিতে সাহস করেননি। এরপর বিচারপতি সিনহা এ বিষয়ে লেখার কারণে স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করলে স্বদেশ রায় যখন ওই রেকর্ড প্রকাশ্য আদালতে বাজাতে উদ্যত হন তখন বিচারপতি সিনহা আদালতে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি আসলেই সাকার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আইনত এই স্বীকারোক্তির পরই বিচারপতি সিনহ্ার পদত্যাগ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। পৃথিবীর যে কোন দেশেই তাই হতো। বিচারপতি সিনহা ৭১ চ্যানেলের রূপা এবং মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার মামলা করেছিলেন, যদিও সেটা নিয়ে আর এগুবার সুযোগ পাননি।

এখানে উল্লেখ্য যে, আমার কাছে সেদিন প্রশ্ন ছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য স্বদেশ রায়ের পক্ষে সাক্ষী দেব না সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে চুপ করে থাকব। আমার অন্যতম শুভাকাক্সক্ষী যাকে আমি তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শক্ত অবস্থানের জন্য শ্রদ্ধার চোখে দেখি, সেই বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মনতাসীর মামুনও বলেছিলেন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বহু নিপীড়ন সইতে হবে, তাই ভেবে দেখুন। আমি সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষ নিয়ে স্বদেশ রায়কেই সহায়তা করার এবং বিচারপতি সিনহার আসল রূপ জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য স্বদেশ রায়ের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। যার ফলে বিচারপতি সিনহার তোপের মুখে আমাকে পড়তে হয়। বহু নিপীড়ন এবং লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। নিপীড়নের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সিনহা ঠেলে দেন আমার দিকে। সংবিধান লঙ্ঘন করে সিনহা আমার অবসরের ১০ দিন আগে থেকে আমাকে আর কোর্টে বসতে দেননি যাতে আইজীবীগণ আমাকে বিদায় সংবর্ধনা না দিতে পারে।

সিনহ্ার এ উদ্যোগ অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে কেননা বিভিন্ন স্তরের শত শত আইনজীবী আমার খাস কামরায় এসে আমাকে বিদায় জানান এবং অবশেষে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কয়েকজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং আমিসহ আপীল বিভাগের কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে বিদায়ী সংবর্ধনা ও সম্মাননা এবং ক্রেস্ট প্রদান করেন। এরপর সিনহা আমার খাস কামরাও তালা দিয়ে বন্ধ করে দেন, স্টাফদের তুলে নেন। আমার কম্পিউটার তুলে নেন যাতে আমি অসম্পূর্ণ রায়গুলো শেষ করতে না পারি। তদুপরি শত বছরের ঐতিহ্য ভঙ্গ করে এ মর্মে ফরমান জারি করলেন যে, অবসরের পর রায় লেখা যাবে না। (সিনহার বিদায়ের পর নতুন মাননীয় প্রধান বিচারপতি অবশ্য সে ফরমান আর মানছেন না) আমি তখন বাধ্য হয়েছিলাম মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে লিখতে। সিনহা আমার পেনশনও বন্ধ করে দিয়ে জিঘাংসার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন।

সিনহা সরকার পতনের উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছে এ কথা বললেও ৭১ চ্যানালসহ দু’একটি টেলিভিশনই শুধু এটি প্রচার করেছে। অন্যেরা আমার এবং স্বদেশ রায়ের কথাকে মোটেও গুরুত্ব দেননি ভেবেছেন আমরা জিঘাংসা বশত এগুলো বলছি। আজ আমাদের গর্ব এই যে সিনহার দুর্নীতি এবং সরকার উৎখাতের এবং সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির যে কথা আমরা তিন বছর আগে বলেছিলাম আজ তা কাগজে-কলমে প্রমাণিত হয়েছে। সেদিন লন্ডনপ্রবাসী স্বনামধন্য কলামিস্ট গাফ্ফার চৌধুরী সাহেবও, যার সঙ্গে আমার বহু দশকের নিবিড় সখ্য রয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলার ডাক পত্রিকায় যার সঙ্গে সামান্য হলেও কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, যিনি আমাকে বিচারপতি কাইয়ানির সঙ্গে তুলনা করে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যাকে অমি সবসময়ই শ্রদ্ধাভরে দেখি, তিনিও সিনহার পক্ষ হয়ে আমার বিরুদ্ধে বেশ ক’টি প্রবন্ধ লিখেছেন। আশা করি এখন তার ভুল ভেঙ্গেছে। তিনি নিশ্চয়ই পুরো বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি, সিনহাকে চিনতে পারেননি।

সিনহা দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দেশান্তরে চলে গেছেন। ৭১ চ্যানেলের এক টকশোতে আমি বলেছিলাম বিচারপতি সিনহাকে ১/১১ এর সময় দুর্নীতির জন্য পদত্যাগ করতে বলেছিলেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি। আমার এই কথা শুনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক, যার নাম আজ মনে নেই, আমার বক্তব্যকে ইমরাল বা অনৈতিক বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই অধ্যাপক আজ সব কিছু জানার পর নিশ্চয়ই লজ্জিত হয়েছেন বলে আমি আশা করছি।

প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগেই সিনহা ১/১১-এর অন্যতম কুশীলব একজন ক্ষমতাধর আইনজ্ঞের প্রভাবে চলে আসেন। ১/১১-এর সময় সিনহাসহ হাইকোর্ট বিভাগের মোট তিনজন বিচারপতিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে তলব করে তাদের দুর্নীতির সকল প্রামাণ্য দলিল দেখান এবং তাদের পদত্যাগ করতে বললে শুধু একজন পদত্যাগ করেন। সিনহা মায়ের অজুহাত দেখিয়ে দুদিন পরে আসবেন বলে পদত্যাগ না করেই চলে আসেন এবং সেই ১/১১-এর কুশীলব প্রভাবশালী আইনজ্ঞের শরণাপন্ন হন, যিনি তখন সিনহ্াকে রক্ষা করেন। সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এই কুশীলব তার ঘাড়ে চেপে বসেন এবং এই সরকারকে উৎখাত করার জন্য পরামর্শ দেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ওই কুশীলব আইনজ্ঞ প্রকাশ্যেই বলেছিলেন তিনি প্রধান বিচারপতি সিনহাকে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেবেন, যে কথাটি জাতীয় দৈনিকসমূহে ছাপা হয়েছে। সেই কুশীলব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকের সাহায্যে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। সেই কুশীলব সিনহাকে পাকিস্তানের তুলনা এনে বলতেন পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট যদি তিন তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারে তাহলে আপনি কেন পারবেন না। এর মধ্যে একটি সুযোগও সেই কুশীলবরা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার যে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি বিফল রিট করিয়েছিলেন এই কুশীলব। যদিও তিনি নিজেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

হাইকোর্টে রিটটি বিফল হওয়ায় ওই কুশীলবের প্ররোচনায় আপীল বিভাগে আপীল করা হয় এবং সিনহার পদত্যাগের পূর্বে যে কোন সময় এটি শুনানি করে ওই ১৫৩ জনকে অবৈধ ঘোষণা করে সংসদ তথা সরকার অবৈধ এ ধরনের রায় দেয়ার সমস্ত প্রস্তুতিই শেষ করেছিলেন বিচারপতি সিনহা। আর মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার ছিল। আর ক’দিন ক্ষমতায় থাকতে পারলেই তিনি এটি করতেন বলে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। সিনহা তাকিয়ে থাকতেন পাকিস্তানের দিকে। এর কারণও রয়েছে। তিনি প্রকাশ্য আদালতেই বলেছিলেন, ’৭১ এ তিনি শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে কাজ করেছেন। পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ভয়ও তিনি এ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখিয়েছিলেন প্রকাশ্যে আদালতে। কিন্তু বাংলাদেশ তো পাকিস্তান নয়। মিয়ানমারের মতো পাকিস্তান তো পর্দার আড়াল থেকে শাসন করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। সেদেশে গণতন্ত্র কখনও খুঁটি গাড়তে পারেনি। আর আমাদের দেশে রয়েছে গভীর গণতন্ত্রের ভীত্তি, আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা গণতন্ত্রের ঐতিহ্যে লালিত এই বাহিনীর দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত।

পাঠকগণ সকলেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র বিচার বিভাগ এবং আইনের শাসনের অবস্থা জানেন। সেখানে গণতন্ত্র কখনও প্রসার লাভ করেনি। সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইমরান খানকে নির্বাচিত করার জন্য পাকিস্তানী সুপ্রীমকোর্টসহ অন্য আদালতসমূহ যে নওয়াজ শরীফকে এবং তার দলের অন্য সদস্যদের বেছে বেছে জেলে পাঠিয়েছেন তা আজ সারা পৃথিবীর গণমাধ্যম প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করছেন। এমনকি রাওয়ালপিন্ডি হাইকোর্টের এক বিচারপতি সম্প্রতি পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের অপকীর্তির কথা প্রকাশ্যেই বর্ণনা করেছেন।

ইদানীং না হয় একটি বিচারিক ফোরাম নওয়াজ শরিফকে বিচারের পর (অনুপস্থিতিতে, অবশ্য ১০ বছরের সাজা দিয়েছে। কিন্তু অতীতে কোন বিচারিক আদালতে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগের ওপর শুনানি না হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট অর্থাৎ, দেশের সর্বোচ্চ আদালত নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করে শুধু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এ কারণে। উল্লেখযোগ্য যে, সুপ্রীমকোর্ট এ বিষয়ে বিচারিক আদালত নয়, বিচারিক আদালত হয় নিম্ন আদালত। সুপ্রীমকোর্টের এই কর্মকা-ই হচ্ছে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানের নজির। আর আমাদের পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সিনহাও ১/১১-এর কুশীলবদের, যাদের মূল ব্যক্তি হচ্ছেন একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ, প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র এবং প্রত্যক্ষ মদদে বলিয়ান হয়ে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট স্টাইলে আমাদের দেশেও বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন।

১/১১-এর কুশীলবরা তাকে রাষ্ট্রপতি পদে পদায়নের লোভ দেখিয়েছিলেন। তদুপরি ভারতের প্রখ্যাত এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শ্রী মানস ঘোষ কলকাতার দ্য স্টেটসমেন পত্রিকায় লিখেছিলেন- বিচারপতি সিনহা লন্ডন ভ্রমণকালে খালেদা জিয়ার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিচারপতি সিনহাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে বিচারপতি সিনহাকে রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হবে।

এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই সমস্ত পুরনো ঐতিহ্য ভঙ্গ করে প্রায় প্রতিদিনই বিচারপতি সিনহা কোথাও না কোথাও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে থাকেন এই বলে যে, দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, সংসদ সদস্য অযোগ্য, অশিক্ষিত, নির্বাচন কমিশন অযোগ্য ইত্যাদি। তার অতীত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায়ও সিনহা দমেননি। নতুন করে শিং বাঁকাতে চেষ্টা করছেন। তিনি ভাবতে পারছেন না অতীতের মতো এখনও তার সব ষড়যন্ত্রই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে, বুঝতে পারছেন না বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়।

১৬ সংশোধনী মামলায় সিনহা নিজে মামলার বিষয়বস্তু থেকে শত শত মাইল দূরে সরে যেয়ে এমন সব কথা বলেন যার সঙ্গে মামলার বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্কই ছিল না যদিও আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিগণ তাদের নিজেদের লেখা আলাদা অবজারভেশনে মামলার ইস্যুর বাইরে কিছুই লেখেন নি। বিচারপতি সিনহা তার অবজারভেশনে এসব কথা লিপিবদ্ধ করে জনমনে এ সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

জাতির সৌভাগ্য সিনহার দুর্নীতির প্রমাণগুলো জনসমক্ষে এসে গেলে আপীল বিভাগের বাকি চারজন বিচারপতি এই দুর্নীতিবাজ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে অস্বীকার করলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেই সঙ্গে দেশও বেঁচে যায়। আমি মনে করি, সিনহাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো চালু করা হলে তার বিষদাঁত ভেঙ্গে যাবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আপিল বিভাগ
প্রথম প্রকাশ: জনকন্ঠ, ১৯ আগস্ট ২০১৮

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত