টোকাইন্যা মাংসের ঈদ

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০১৮, ১৫:৪৯

৮০’র দশকে এক কোরবানি ঈদের সন্ধ্যেবেলা টিএসসিতে দাঁড়িয়ে আছি। এক বড়ভাই এসে বললেন রিক্সায় উঠ। ধরে নিলাম আমাদের একমাত্র বিলাস ঈদের দিন ঘন্টাপ্রতি রিক্সা ভাড়া করে ঘোরা, তাই হয়ত করবেন। নীলক্ষেত পার হয়ে রিক্সা নিঊমার্কেটের উল্টোদিকে পোস্ট অফিসের সামনে বড়ভাই রিক্সাওয়ালাকে থামতে বললেন। বড়ভাই রিক্সা থেকে নেমে দান করা কোরবানির মাংস যাঁরা বিক্রয়ের জন্য বসেছেন, তাঁদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বুঝলাম বড়ভাই কোরবানির মাংস কিনবেন, বেশ মনোযোগ দিয়ে মাংস দেখছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এগুলো বেশী ভালনা চল ভেতরের দিকে যাই।

আমি ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলাম। রিক্সা ঘুরিয়ে আজিমপুর এতিমখানার সামনে রিক্সা থামিয়ে দেখলাম অনেকগুলো দোকান বসেছে। নানান জায়গার দানের মাংস জমিয়ে বিক্রেতাদের সামনে বেশ বড় মাংসের স্তুপ।

বড়ভাই নেড়েচেড়ে দেখছেন এ দোকান ও দোকান, কুপির আলোয় না পোষালে রাস্তার টিউবলাইটের আলোর নীচে যাচ্ছেন মাংস পরীক্ষার জন্য। আমায় একবার ডেকে বললেন এ মাংসগুলো দেখতো, বেশ চর্বি আছে কেমন সাদা সাদা মনে হয় মীর কাদিমের গাভীর হবে।

আমি তাঁর মুখের আভা দেখছি। এ দোকান ও দোকান ঘুরে আমরা, নানান সাইজের নানান কালারের পাঁচ কেজির মত মাংস কিনে, বড়ভাই তার এক বন্ধুর বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। সে ভাইটি সদ্য বিয়ে করেছেন একটি কলেজে পড়ান। ভাবি ভাল আবৃত্তি করেন, সংবাদ পড়েন রেডিও টেলিভিশনে, একটি স্কুলে মাস্টারিও করেন।

তিনতলায় বড়ভাইটি বন্ধুর বাসায় ঢুকেই ভাবিকে বললেন, পরাটা বানাও আমি মাংস রেডি করে দিচ্ছি কাজের মেয়েটাকে নিয়ে, আকরামকে বল মশলা না থাকলে নিয়ে আসতে। ইতোমধ্যে বড়ভাই রান্নাঘর এর মেঝেতে মাংস ঢেলে দিয়েছেন, ভাবি চোখ বড় বড় করে তা দেখছেন।

আমি একটু পর রান্নাঘর এর সামনে গিয়ে ভাবিকে বললাম কিছু আনতে হবে? ভাবি আলগোছে বেলুনটা হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে, আমায় ইশারায় ডেকে তাঁর স্বামীর সামনে নিয়ে গেলেন। সেখানে সেই বড় ভাইও ছিলো। এরপর ভাবি আমায় জেরা শুরু করলেন এবং বললেন যা বলবি সত্যি বলবি কিন্তু।

আমি মাথা নাড়তেই তাঁর প্রশ্ন তোরা কি কোরবানির টোকাইন্যা মাংস কিনে আনলি? আমি আমতা আমতা করতেই, তিনি বলে উঠলেন সত্য না বললে বেলুন তোর পিঠে ভাঙবো, পরোটা খাইতে হবেনা।

আমি বড় ভাইয়ের বন্ধু আমার ঐ ভাইটির দিকে তাকিয়ে আছি তাঁর অভিব্যক্তি বোঝার জন্য, যিনিও এর আগের ঈদে এরকম টোকাইন্যা মাংস কেনার অভিযানে শরিক হয়েছিলেন। ভাবির ধমকে বাস্তবে ফিরলাম, তোকে এত পছন্দ করি তুই টোকাইন্যা মাংস কিনে আনলি! তাঁর গলার স্বর ধরে আসছে তিনি আমায় চার্জ করারও শক্তি হারিয়েছেন। তাঁর চোখের কোণায় জল চিক চিক করছে। ভাইটি বৌ’এর কথা কানে না তুলে উদাস মনে সিগারেট টানছেন বাইরের দিকে তাকিয়ে। আমি ভাবিকে ব্যাখ্যা দেয়ারও চেষ্টা করছি না, তিনি টিএসসিতে দেখা হলে এমনিতে ডেকে ৫০/ ১০০ টাকা হাতে দেন। তাঁর বেদনা উপশম করার ভাষা খুঁজছি।

কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, ভাইটি বলে উঠলেন, কাজের মেয়েটির কাছ থেকে জেনে কিছু লাগলে নিয়ে আয়। আমি সরে পড়লাম। নীচ থেকে কেনাকাটা করে আসার পরে দেখলাম ভাবি এখনও গম্ভীর, তাঁর জড়তা কাটেনি। রাত দশটার দিকে টোকাইন্যা মাংস রান্না শেষ হলে, পরোটা সহযোগে তা ধ্বংস করে, চাঁদের আলোয় টিএসসিতে ফেরার সময় বড়ভাইকে বললাম আর ও বাসায় যাওয়া যাবে না। ভাবি খুবই শকড হয়েছে। বড়ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, হুম। গতকাল কোরবানি সামলিয়ে আড্ডা মারার জন্য যখন আসছি তখন চোখে পড়লো, ঘুন্টিঘর, জুরাইন রেলগেট, কাঁঠাল বাগান ঢালে টোকাইন্যা মাংসের দোকান জমজমাট।

ক্রেতা বিক্রেতায় সরগরম। দানকরা মাংস একদল বেচছেন টাকার আশায়, আবার জমিয়ে রাখাও বেশ কষ্টসাধ্য তাই বিক্রয় না করেও উপায় নাই। অন্যরা কিনতে এসেছেন এ নগরীতে কোরবানির মাংস তাঁদের হাতে পৌঁছেনি বলে, কমদামে কেনে সাধ মেটাবেন।

আজ কোরবানির দিনটি ভেসে গিয়েছে রাজপথ থেকে গলি পর্যন্ত পশুর উপচে পড়া রক্ত ও বর্জ্যে। এ রক্ত ও বর্জ্যে জলমগ্ন শহরে নিজেদের জীবনের লড়াই ঠিকই জারি রেখেছেন টোকাইন্যা মাংসের ক্রেতা ও বিক্রেতা, জীবনের প্রয়োজনে।

অনিরাপদ এই শহরের কোনা খামচিতে জীবনের জয়গান টেনে নিয়ে যাবার জন্য, যাঁরা লড়াই করছেন, আপনাদেরকে অভিনন্দন। জীবনের লড়াই থেমে থাকেনা, ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন এবং আনন্দে থাকুন।

ঈদ মোবারক!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত