সত্যের চেয়েও গুজব শক্তিশালী?

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০১৮, ২০:৪৯

প্রভাষ আমিন

ঘোলা পানিতে মাছ শিকার–এই প্রবাদটি শুনলেই আমার ছেলেবেলার কথা মনে হয়। ছেলেবেলায় আমার মাছ ধরার নেশা ছিল। বড়শি দিয়ে, জাল দিয়ে, টেঁটা দিয়ে অনেক মাছ ধরেছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ঘোলা পানিতেও অনেক মাছ শিকার করেছি। চৈত্র মাসে যখন খাল-বিলের পানি কমে আসতো, তখন একসঙ্গে কয়েকজন মাছ ধরতে নামলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ঘোলা হয়ে যেতো। কখনও কখনও ঘোলা পানি আসলে কাদা পানি হয়ে যেতো। আমরাও অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে মাছ ধরতাম। এই যে অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে মাছ ধরা লিখলাম, এটাও কিন্তু বইয়ে পড়া নয়। আমার বাবা অন্ধ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেই সুবাদে আমার ছেলেবেলার অনেক বন্ধুই অন্ধ। তাদের দেখতাম পুকুরে হাতড়ে হাতড়ে মাঝ ধরে নিয়ে আসতো। তো ঘোলা পানিতে হাতড়ে হাতড়ে মাছ ধরার কথা মনে হলো সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনা দেখে। ছেলেবেলার সেই সত্যিকারের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার নয়, পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তাতে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করার অসংখ্য চেষ্টা দেখি চারপাশে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অসাধারণ আন্দোলন নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, আরো হবে। তবে আজ  শুধু গুজব রটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টার কথাই লিখবো।

২৯ জুলাই রবিবার কুর্মিটোলায় বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই বন্ধুকে হারানোর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এই অসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুধু আমাকে নয়, মুগ্ধ করেছে বাংলাদেশের প্রায় সবাইকে। প্রায় বললাম, কারণ শাজাহান খানের মতো অল্পকিছু মানুষের হয়তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পছন্দ হয়নি। রবিবার শুরু হওয়া আন্দোলন অভাবনীয় জনসমর্থন নিয়ে বৃহস্পতিবার পিকে ওঠে। ততদিনে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে আগ্রহীরা মাঠে নেমে গেছেন। বাজারে বেড়ে যায় স্কুল ড্রেসের বিক্রি। রাস্তায় নেমে শার্ট বদলে স্কুল ড্রেস পরে অনেকে মিশে যায় আন্দোলনে। বৃহস্পতিবার মিরপুরে শিক্ষার্থীরা পুলিশ আর সরকার সমর্থকদের হাতে মারও খেলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্যাবোটাজের আশঙ্কা সত্যি মনে হয় অন্তর্জাল জগতে ভেসে বেড়ানো নানান অডিও বার্তা আর নানান ষড়যন্ত্রের গল্প শুনে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই আমার মনে কুডাক ডাকছিল। খালি ভয় হচ্ছিল, না জানি কখন কী ঘটে যায় কে জানে। যারা মাঠে নেমেছিল, তারা সবাই আমার সন্তানের বয়সী। আমার খালি ভয়, আমাদের এই সন্তানদের নিরাপদে বাসায় ফিরিয়ে নিতে পারবো তো। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আমি ফেসবুকে, অনলাইনে লিখতে থাকি, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ফিরে যাও। আমি লিখেছি, থামতে জানাটাও আন্দোলনের সাফল্যেরই অংশ। অনেকেই তাতে আমাকে ‘সরকারের দালাল’ বলে তুলাধুনা করে বলেছেন, আন্দোলন থামবে না, চলবে। আমি তাদের বলেছি, কোনও অঘটন ঘটে গেলে তো আপনি বা আপনারা তাদের বাঁচাতে পারবেন না। ঘরে বসে ফেসবুকে ‘তীব্র নিন্দা জানাই’ লিখেই তো দায়িত্ব শেষ করবেন। আমার আশঙ্কা সত্য মাত্র একদিন লাগলো। শনিবারেই সংঘর্ষে উত্তাল ধানমন্ডি-ঝিগাতলা। সরকার সমর্থকদের অমানবিক হামলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। অনেকেই আহত হন। কীভাবে সংঘর্ষ শুরু হলো? শিক্ষার্থীরা কেন রাজপথ ছেড়ে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা করতে গেলো? সরকারের টানা ছয়দিনের অপরিসীম ধৈর্যের ফসল ঘরে তোলার আগেই কারা ছিনিয়ে নিলো? সরকার গায়ের জোরই যদি খাটাবে তাহলে পুলিশ দিলেই তো পারতো। কিন্তু এই ‘হেলমেট বাহিনী’ কারা? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আলাদা লেখা লিখছি। আজ শুধু গুজব প্রসঙ্গ।

শনিবারের শুরুটা সাধারণ আর দশটা সংঘর্ষের মতোই ছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে গুজব গ্রাস করে নেয় ঢাকা। একের পর এক ফোন আসতে থাকে। চেনা-অচেনা অনেক লোক, ভাই এটা কী সাংবাদিকের নাম্বার? সিটি কলেজে মেয়েদের আটকে রেখে রেপ করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ অফিসের ভেতরে নিয়ে দুইজনকে মেরে ফেলো হয়েছে। চারজনকে রেপ করা হয়েছে। একজনের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। আপনারা কিছু করেন প্লিজ। সবারই উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। জানতে চাই তাদের এই তথ্যের উৎস কী? জবাবে সবাই বলেন, শুনেছি। অভিযোগের ধরন অবিশ্বাস্য হলেও আমরা উদ্বিগ্ন হই। বাড়তি টিম পাঠাই খবর নেওয়ার জন্য। ততক্ষণে গুজব ডালপালা মেলে। সারা শহর হয়ে যায় গুজবের শহর। অভিনেত্রী কাজী নওশাবাসহ বেশ কয়েকজন ফেসবুক লাইভে ঘটনার বীভৎস বর্ণনা দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানান। নওশাবার ফেসবুক লাইভ দেখে যে কারো মনে হতে পারে, তার চোখের সামনেই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু তিনি তখন ঝিগাতলা থেকে অনেক দূরে উত্তরায় শুটিং করছিলেন। এভাবে ফেসবুক লাইভ, ফোন, মেসেঞ্জারে গুজব ছড়াতে থাকে। সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলের আশপাশের জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ইবনে সিনা হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল ঘুরে শতাধিক আহত পেয়েছেন, চোখে গুরুতর আঘাত পাওয়া রোগীও পেয়েছেন। কিন্তু কারো নিহত হওয়ার খবর বা ধর্ষিতা হওয়ার খবর বা চোখ তুলে নেওয়ার খবর নিশ্চিত করতে পারেননি। গণমাধ্যম সংঘর্ষ, আহতদের খবর দিয়েছে। কিন্তু নিহত ও ধর্ষণের খবর দেয়নি কেন; তা নিয়ে মানুষের অনেক ক্ষোভ। অনলাইনে, অফলাইনে দালাল গালি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। আমি তাদের বলেছি, আপনারা নিহত বা ধর্ষিতাদের নাম-ঠিকানা দেন; আমরা রিপোর্ট করবো। সেই দায়িত্ব নিতে রাজি নন তারা। বলেন, আপনারা খুঁজে নিন। কিন্তু আমরা তো খুঁজে পাইনি। খুঁজে না পেলে, শুধু গুজবের ওপর ভর করে তো দায়িত্বশীল গণমাধ্যম নিহত বা ধর্ষণের খবর দিতে পারে না। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের তো কোনও সম্পাদক নেই, কিন্তু গণমাধ্যমের তো আছে। গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদলকে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয় পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারো লাশ তো দূরের কথা আহত কাউকেও পাননি। পরিস্থিতি সেখানেই থেমে যেতে পারতো। কিন্তু গুজব উত্তেজনার আগুনে উপর্যুপরি ঘি ঢালতে থাকে, সংঘর্ষও চলে দিনভর। শিক্ষার্থীদের মিছিলে সরকার সমর্থকদের হামলাই বড় খবর। কিন্তু গুজবের আড়ালে হারিয়ে যায় হামলার খবর। চিলে কান নিয়েছে, এটা শুনে চিলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আমরা কানে হাত দেওয়ার সময় পাইনি। কান যে রক্তাক্ত, চিকিৎসা দরকার, সে খেয়াল নেই আমাদের। লাশ খুঁজতে গিয়ে আমরা ভুলে গেছি আহতদের।

কিন্তু এতকিছুর পরও অনেকে এখনও বিশ্বাস করেন, শনিবারের সংঘর্ষে ২ জন মারা গেছেন, ৪ জন ধর্ষিত হয়েছেন। অনেকের ধারণা সরকার লাশ গুম করে ফেলেছে। তাহলে পরিবারের সদস্যরা কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, সরকার নাকি পরিবারকেও জিম্মি করে রেখেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এমনটাও সম্ভব? শনিবারের হামলা খুবই নিন্দনীয়। হামলার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। কিন্তু কোনও লাশ বা ধর্ষিতার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। না ঘটলেও, মানুষের বিশ্বাস ঠেকানো কঠিন। গুজব সত্যের বিপরীতে একটা ধারণা তৈরি করে। ধারণা কখনও কখনও সত্যের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে যায়। তবে ইতিহাসে শুধু সত্যটাই লেখা থাকে। শেখ কামাল গান ভালোবাসতেন, নাটক ভালোবাসতেন, খেলা ভালোবাসতেন। মৃত্যুর পর ২১ বছর ধরে তাকে ব্যাংক ডাকাত বানানোর চেষ্টা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল থেকে বিনা রক্তপাতে হেফাজতকে সরানো হয়। পরে গুজব রটে, সেদিন শাপলা চত্বরে ৩ হাজার লোক মেরে ময়লার ট্রাকে লাশ সরানো হয়েছে। অনেক দিন মানুষ এই গুজব বিশ্বাস করেছে। দেশি-বিদেশি মিডিয়া, মানবাধিকার সংগঠন অনেক খুঁজেও কোনও লাশের হদিস পাননি। কেউ মারা না গেলে লাশ পাবে কোত্থেকে? দিনের পর দিন গুজব রটিয়ে গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছে মাহমুদুর রহমানরা। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এই গুজব রটিয়ে অনেক প্রাণহানি ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশে অনেক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছে গুজবের কারণে। কোটা আন্দোলনেও লাশের গুজব রটিয়ে উত্তপ্ত করা হয়েছে। এমনকি কুর্মিটোলায় দুর্ঘটনায় ২ জন মারা গেলেও ৭ জন মারা যাওয়ার গুজব রটেছে।

কিছু কিছু গুজব অনিচ্ছাকৃত, নির্দোষ। কিছু কিছু গুজব খুব পরিকল্পনা করে ছড়ানো। গুজব সবসময় ভয়ঙ্কর। আর গুজব ছড়ানো হয় এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে, সত্য-মিথ্যা মিশে একাকার হয়ে যায়; আলাদা করা কঠিন।

তবে গুজব ছড়ানো এবং সত্যের চেয়ে শক্তিশালী ধারণা তৈরির পেছনে গণমাধ্যমের একটা দায় আছে। মানুষ যখন গণমাধ্যমে সব খবর পায় না, তথ্য পাওয়ার তৃষ্ণা যখন মেটে না; তখনই মানুষ গুজবের পেছনে ছোটে। তখনই গুজব শক্তিশালী হয়। দরজা বন্ধ থাকলে অন্য ফাঁকফোকরে ময়লা ঢুকে যাবে। কিন্তু তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা গেলে সেই স্রোতে গুজব ভেসে যাবে। তাই মূলধারার সংবাদ মাধ্যমকে দায়িত্বশীলতার সাথে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরতে হবে। গণমাধ্যম যদি পাঠক-দর্শকের তৃষ্ণা মেটাতে পারে, তাহলেই তারা গুজব নামের চিলের পেছনে ছুটবে না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
প্রথম প্রকাশ: বাংলা ট্রিবিউন, ৯ আগস্ট, ২০১৮

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত