গুজব ছড়াচ্ছে যারা, তারা কারা?

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০১৮, ১৯:৩৪

জব্বার হোসেন

হঠাৎ করে এক তরুণী ফোন করে ধর্ষণের খবর দেয়। মেয়েটি নিজেও রীতিমত হাঁপাচ্ছে, কাঁপছে। বলে, আন্দোলনরত চারটি মেয়েকে ওরা ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে। ‘ওরা’ কারা, প্রশ্ন করতেই বলে সরকারি দলের সমর্থক ছেলেরা।

মেয়েটিকে শান্ত করবার চেষ্টা করি। মেয়েটি অশান্ত, কম্পমান, বিপর্যস্ত। প্লিজ একটা কিছু করুন। আপনিতো মেয়েদের জন্য লেখেন, মেয়েদের অধিকারের পক্ষে বলেন। আপনার কি কিছুই করবার নেই? আপনার তো ফেসবুকে অনেক ফলোয়ার। এটলিস্ট মেয়েরা ধর্ষণ হচ্ছে, এটা লিখে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস তো দিতে পারেন। বলে ফোনটি কেটে দেয় মেয়েটি।

মেয়েটি ফোন করবার আগেই আমি জেনে যাই শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ছড়িয়ে পড়েনি, মহামারীর আকার ধারণ করেছে। অসংখ্য গুজব, অশ্লীল সব গুজব। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের গুজব। ফেসবুকে চোখ রাখা দায়। মুহুর্তে মুহুর্তে শেয়ার হচ্ছে। নিচে অশ্লীল সব কমেন্টস। রুয়ান্ডা, আরমেনিয়া, মাদ্রিদ, জালিয়ানওয়ালাবাদের গণহত্যার ছবি- বলা হচ্ছে বাংলাদেশ। উস্কে দিচ্ছে কেউ কেউ। উস্কানিদাতার অভাব নেই।

হঠাৎ চোখে পড়লো মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের জানাজার খবর। ‘গায়েবানা জানাজা’ পড়ানো হয়েছে স্যারের। স্যার ইনশাল্লাহ সুস্থ, জীবিত একজন মানুষ। একজন জীবিত মানুষের গায়েবানা জানাজা! যারা এসব করছে তাদের কোনও ধর্ম নেই, ধর্মের ভয় তো দূরের কথা। ইসলামে একজন জীবিত মানুষকে নিয়ে অমন কাজ কতটা যে অন্যায়, অপরাধ, কঠিন গুনাহের, তা যে কোন মুসলমান মাত্রই জানেন।

আরেকটি মানুষের চরিত্র প্রায়শই হনন করা হয়, তিনি মোহাম্মদ এ আরাফাত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক। দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা, জামায়াতিদের অপ্রপ্রচারের বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যেই সরকারের ইতিবাচক কাজের সমর্থন দিয়ে প্রচার প্রচারণা করেন। তার অবস্থান খুব স্পষ্ট। ভান ভণিতা নেই। ‘নিরপেক্ষ’ কখনোই নন তিনি। নিজেকে নিরপেক্ষ বলেনও না, দাবিও করেন না। তার পক্ষ একটাই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ।

যে আমি ফেসবুকে অনেক বেশি অ্যাক্টিভ নই, সে আমাকে অনেকেই দেখি ইনবক্স করেছে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ। ‘ভাইরাল করেন’। কারো সঙ্গে চেনা নেই, জানা নেই, কথা নেই হঠাৎ করে কাউকে ‘ভাইরাল করেন’ রীতিমত অশোভন আমার কাছে। ভিডিও ক্লিপগুলোর সব দেখা হয়ে উঠেনি। দু’ একটা দেখার পর আমার বোঝা হয়ে যায়, এরা কারা, তারা কী চায়? ডিলিট অপসনে প্রেস চাপি আমি।

শিক্ষার্থীদের যে যৌক্তিক আন্দোলনকে সরকারসহ সবাই সমর্থন দিয়েছে, দাবি পূরণ করেছে সরকার, দাবি পূরণের পর তো আর শিক্ষার্থীরা থাকবার কথা নয়, রাজপথে। তবে কী শিক্ষার্থীদের ছদ্মবেশে অন্যদের, অছাত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে? ঘটেছে। স্কুল-কলেজের পোশাক বানানোর ধুম পড়ে যায়। আইডি কার্ড তৈরির হিড়িক পড়ে যায় নীলক্ষেত, পল্টন, মিরপুরের দোকানগুলোতে। শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যায়। অশিষ্ট বেপরোয়া, নৈরাজ্যবাদী, উগ্র যারা তারা থেকে যায় মাঠে, সঙ্গে অনুপ্রবেশকারীরা বিচরণ করতে থাকে।

আমি বলছি না সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনটি সব সময় শোভন আচরণ করে। ছাত্রলীগ ‘ধোয়া তুলসিপাতা’ সব সময় অমনটিও নয়। অতি উৎসাহীরা সব সময়ই থাকে। উপযাজক হয়ে নিজের মতো অনেক কিছু করে। যা ছাত্র হিসেবে ছাত্র সংগঠন হিসেবে হয়তো ‘অতিরিক্ত’, করবার কথা নয়, অনাকাঙ্খিত। আর সেই দায় এসে পুরো ছাত্র সংগঠনটির উপর পড়ে। বিচ্ছিন্ন, অনভিপ্রেত কোন ঘটনার জন্য দায়ী নিশ্চয়ই সবাই নয়, পুরো প্রতিষ্ঠানও নয়।

শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে এক সময় মাঠ দখল করে নিয়েছিল শিবির-জামায়াতকর্মীরা। অবাক হবার কিছু নেই, শিবিরের স্কুলপর্যায়েও কার্যক্রম রয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রয়েছেই, বহুকাল আগে থেকে। শিবিরকে এখন আর চিনবার উপায় নেই। তারা এখন পোশাক বদলেছে, আদর্শে অটুট থেকে। শিবির এখন জিন্স-টি শার্ট, ক্লিনসেভে আবির্ভূত।

দাড়ি নেই, টুপি নেই, আলখেল্লা নেই, জোববা নেই। শিবিরের মেয়েরা, মাথায় হিজাব থাকলেও শরীরে আটোসাটো পোশাক, উত্তেজক। আর হিজাব তো এখন ইসলামি, নন ইসলামি সবার ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে রীতিমত। সরকারবিরোধী সকল উইং, দুর্বল বামডান সবাই মিলে এই স্বাধীনতাবিরোধী গ্রুপগুলোর গোড়ায় কেউ জল ঢেলেছে, কেউ আগুনে ঢেলেছে ঘি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বা মোহাম্মদ এ আরাফাত গাল খায় কেন? যারা গাল দেয় তারাই বা কে? অধ্যাপক জাফর বা অধ্যাপক আরাফাত কি বাজে লোক, মন্দ লোক, দুষ্টু লোক? তারা কি অজ্ঞ, অশিক্ষিত, মূর্খ, অন্ধকারাচ্ছন্ন? তাদের নিজেদের যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু কি পেয়ে গিয়েছেন, তাদের অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে সরকার, এমনও তো নয়। তবে কেন তাদের প্রায়শই ‘দালাল’ বলে গাল দেয়া হয়? কাদের পক্ষে দালালি করে তারা? সেই পক্ষ কোন পক্ষ? নিজের বোধ বিবেচনা দিয়ে বিচার করলে পাওয়া যাবে, সেই পক্ষ- মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশের পক্ষ, এমনই প্রমাণিত হয়।

আরাফাতরা, জাফর ইকবালরা বাংলাদেশের দালাল। যে দেশের জন্য মানুষ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। তাদের দু’জনের বাবাই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকে মূল জায়গা ধরেই জাফর ইকবাল কথা বলেন, লিখেন, আরাফাতও তাই। কত শত পরিবর্তন আসছে, যাচ্ছে, তারা তাদের আদর্শ থেকে একচুলও সরে দাঁড়াননি। দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।

দ্বন্দ্বটি পরিষ্কার, বোঝা যায়। দর্শন আর আদর্শগত। বাংলাদেশ দর্শন বনাম পাকিস্তান দর্শন। বাংলাদেশের পক্ষ আর বিপরীত পক্ষ। এই বিপরীত পক্ষরাই ঘাপটি মারা, উৎপেতে থাকা, উস্কানিদাতা, বিশৃঙ্খলাকারী। যারা চায় না, বাংলাদেশের অস্থিত্ব থাকুক। বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতো করে বাঁচুক।

তথাকথিত আধুনিক, আপাত উদার, পোশাকে পশ্চিমা, অন্তরে পাকিস্তান দর্শনের সমর্থক গ্রুপটিই এখন ফেসবুক, ইউটিউবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের ভুলও মিথ্যে ব্যাখ্যা দিয়ে, কখনো অন্যের চরিত্র হনন করে, কখনো গুজব ছড়িয়ে দিয়ে। তারা জানে, একই মিথ্যে বারবার বললে, এক সময় তা লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হতেও পারে।

খুব কৌশলে মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে, এই অপপ্রচারে। মেয়েরা মুখ ঢেকে, মাথা ঢেকে ক্যামেরার সামনে এসে নিখুঁত অভিনয় করছে। ধর্ষণের ঘটনা বর্ণনার অভিনয়, যা ঘটেনি কিন্তু ঘটেছে বলে মনে হয়। ইউটিউবজুড়ে এমন ভিডিও’র ছড়াছড়ি। আর পুরুষেরাও এক মেয়ের মুখ থেকে অন্য মেয়ের ধর্ষিত হবার বর্ণনা শুনতে পুলকবোধ করে, সুখ পায়।

যে মেয়েরা মিথ্যে ধর্ষণের খবর ছড়াচ্ছে, গুজব রটাচ্ছে তারা আসলে পুরুষের হাতের পুতুল, পাপেট। রাজনৈতিক অস্ত্র। আইএসএর যৌনদাসীদের সঙ্গে খুব পার্থক্য নেই এদের। এরা পুরুষের চেয়েও পুরুষতান্ত্রিক। এরা বিশ্বাস করে না মেয়েদের স্বাধীনতায়, সমতায়, অধিকারে। এরা মিথ্যে ধর্ষণ নয়, চায় সত্যি সত্যি মেয়েরা ধর্ষিত হোক। নিপীড়িত হোক। নির্যাতিত হোক। যৌন হেনস্তা হোক। তা নয়তো গুজবের আগুনে, এই মেয়েরা ঘি কেন ঢালছে?

আজ রাজনৈতিক স্বার্থে যাদের জন্য মিথ্যে ধর্ষণের গুজব ছড়াচ্ছে, তারাই এই মেয়েদের কাল ধর্ষণ করবে।

লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
প্রথম প্রকাশ: জাগোনিউজ২৪.কম, ০৯ আগস্ট ২০১৮