শহীদুল আলমদের মতলবটা কী?

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০১৮, ১৮:৪৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী

শহীদুল আলম নামের একজন খ্যাতনাম ফটোগ্রাফারকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে একদল লোক ধরে নিয়ে গিয়েছিল গত ৫ আগস্ট রাতে। তার স্ত্রী সংবাদ মাধ্যমে জানানোর আগে এই সংবাদ প্রচার করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিদেশি মিডিয়ায় লেখালেখি করে নজরে আসা ডেভিড বার্গম্যান। যিনি আবার ড. কামাল হোসেনের জামাতা এবং ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী। মিডিয়াতেও খবরটি আসে। যাক, পরদিন সকালে খবরে আশ্বস্ত হই যে তাকে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি আটক করেছে এবং দুপুর নাগাদ জানা যায় তাকে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং গোয়েন্দা পুলিশ ৭ দিনের রিমান্ডের অনুমতি পেয়েছে আদালত থেকে।

ইউএনবি’র সংবাদে বলা হয়, ‘দৃক গ্যালারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যানকে রবিবার রাতে গোয়েন্দারা আটক করেছে। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, ডিবির একটি টিম শহীদুল আলমকে চলমান ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে তার কিছু ফেসবুক পোস্ট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।’

আটকের পর বেরিয়ে আসছে চিত্রসাংবাদিকতার বাইরেও শহীদুল আলমের অনেক কর্মকাণ্ড রয়েছে। কোনোটাই সুখকর না। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক কর্মকর্তা তার ফেসবুকেও শহীদুল আলম সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তিনি (শহীদুল) বহুদিন ধরে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। এরপরও এই সরকারের সময় একচেটিয়া শত কোটি টাকার কাজ করেছেন কিছু উচ্চমার্গীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায়। ওই টাকা দিয়েই ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতেন। সরকারের কাছ থেকে পান্থপথে জায়গা বরাদ্দ নিয়ে নিজে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।’

সেখানে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘শহীদুল আলমকে দেশের মানুষ আরেকটি পরিচয়ে চেনে। বেগম জিয়ার ফটোগ্রাফার এবং মুভি নির্মাতা, যিনি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর জন্য মুভিতে জিয়ার নকল কণ্ঠ ব্যবহার করেছিলেন। এই শহীদুল আলম, মাহমুদুর রহমান ও ফরহাদ মজহার গংরাই গণজাগরণের তরুণ প্রজন্মকে ‘নাস্তিক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। মতিঝিলে হেফাজতের ঘটনায় সাড়ে তিন হাজার আলেম হত্যার গুজবের অন্যতম নায়কও তিনি। যে সংগঠনটি এই গুজবের বৈধতা দিতে চেষ্টা করেছিল সেই সংস্থা ‘অধিকার’-এর অন্যতম একজন তিনি। কুখ্যাত রাজাকার সবুর খানের পরিবারের সদস্য এই শহীদুল আলম।’

আমি শহীদুলকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তবে তার কর্মকাণ্ড জানি। কিন্তু ২০১০ সালে র‌্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর চেষ্টা করে তিনি খবর হয়েছিলেন মনে আছে। পুলিশ আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিস্থ দৃক গ্যালারিতে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিলো। তবে ধানমন্ডি থানার পুলিশ মিডিয়াতে দাবি করেছিল, ‘দৃক গ্যালারি এই প্রদর্শনীর জন্য যথাযথ অনুমতি গ্রহণ করেনি।’ শহীদুল আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায় আসার চেষ্টায় ছিলেন সেটা বুঝা গিয়েছিল এটা নিয়ে বিদেশি মিডিয়ায় হইচই দেখে।

মূলত বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির জীবনযাপন, সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূলে থাকে বিদেশি মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাইমলাইটে আসা, মানবাধিকার নিয়ে গলা ফাটানো। শহীদুলও তাই করেন কারণ তার সংস্থা বিদেশি ডোনেশনে চলে। এরা এই দেশের খারাপ দিক দেশের কল্যাণে নয়, বিদেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য করে। যত খারাপ দেখানো যাবে তত বেশি টাকা সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা এদের। এরা দুই চারদিন পর পর বিদেশি প্রভুদের ধরে এনে দেশে সংবর্ধনা দেয়। আর সেবাদানের বিনিময়ে নিজেরাও বিদেশি দাওয়াত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তথাকথিত কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঝুলিতে ঢুকিয়ে সিভি ভারি করে। এদের কোনও দেশি কার্যক্রম নেই যেখানে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যায় না। শহীদুলের প্রতিষ্ঠানগুলো তাই এবং তার সমস্ত কর্মকাণ্ড এই বৃত্তের।

শহীদুল খবরের লোক না তারপরও তার খবরের এজেন্সি রয়েছে। বিদেশি মিডিয়ায় তার কথাবার্তা যায়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমি তার ফেসবুক ওয়ালে আল জাজিরা টিভিতে তার দেওয়া সাক্ষাৎকার দেখে চমকে উঠেছি। ফটোগ্রাফারের আড়ালে কত বড় একজন ষড়যন্ত্রকারী তিনি তা যে কেউ বুঝতে পারবে এটা দেখলে।

শহীদুলকে ঢাকায় স্কুল ছেলেমেয়েদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে স্কাইপে প্রশ্ন করা হয়েছে। তিনি তার ধারে কাছে না গিয়ে শুরু করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা। শুরুতেই বললেন, এটি অনির্বাচিত অবৈধ সরকার। বললেন, শেখ হাসিনাকে কেউ বিশ্বাস করে না। আর সরকারি চাকরিগুলো কোটার সাহায্যে আওয়ামী লীগ সরকার তার সমর্থকদের দিয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই।

আমার মাথায় আসে না স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী! এই সামাজিক আন্দোলটি কি তাহলে সরকার পতনের জন্য ছিল! নাকি শহীদুল, ফরহাদ মজহার, মাহমুদুর রহমানরা স্বপ্নে দেখছিলেন। ছাত্রদের আন্দোলন দেখলেই তো বিরোধীদলীয় নেতারা কর্মতৎপর হয়ে ওঠেন। গত দশ বছর বিরোধী দল কোনও সুষ্ঠু আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। মাহমুদুর রহমান মান্না-সাদেক হোসেন খোকারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়টা লাশ ফেলার ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলেন, যেন ছাত্র আন্দোলন চাঙ্গা হয় আর ক্ষমতাসীন সরকারকে ফেলে দেওয়া যায়। এবারও সেই মান্না, বিএনপি-জামাত নেতারা তাহলে আন্দোলনে লোক জোগাড় করে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সরকার পতনের যে স্বপ্ন দেখেছেন শহীদুলরা তার ক্রীড়নক হয়েছে। সে কারণে দেশকে অস্থির করতে শহীদুল বারবার ফেসবুকে লাইভে এসে বারবার ছাত্রদের আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছিলেন। সহিংস করতে চেয়েছেন।

অবশ্য এখানেও শহীদুলের বিদেশি ধান্দা কাজ করেছে। তিনি ভাষ্য দিয়েছেন ইংরেজিতে, চোখে মুখে আতঙ্ক রেখে। যাতে তার বিদেশি ‘প্রভু’রা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশ এবং এই সরকারকে হেয় করা যায়। বুঝাই যায় সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মুখপাত্র হিসেবে তিনি হীন প্রোপাগান্ডায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। উনি ছাত্রদের আন্দোলনকে পুঁজি করে সরকার উৎখাতের জন্য নেমেছিলেন। ভদ্রতার মুখোশে তিনি রাজনৈতিক উসকানিদাতার ভূমিকা পালন করেছেন।

চার আগস্ট ২০১৮, যেদিন শিশু কিশোরদের আন্দোলনে জামাত-বিএনপির ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে ধানমন্ডি অফিসের দিকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল বা এর আগে পরে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের হেলমেট পরা ছেলেদের সঙ্গে ঝিগাতলায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছাত্র হত্যা-ছাত্রী ধর্ষণের ব্যাপক গুজবের জন্ম দিয়েছিল, সে রাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়ি আক্রান্ত হয়েছে মোহাম্মদপুরে। তার গাড়িতে হামলার লক্ষণ শুভ নয়। এর সঙ্গেও জড়িত থাকতে পারে এই সরকার বিরোধীচক্রের কোনও ষড়ডন্ত্র। কারণ, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট পরদিন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শেষ করেননি, ছাত্রদের আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন, যেটা স্পষ্ট অনধিকার চর্চা।

অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টেও দেখলাম, এটা যার বাসায় বার্নিকাট দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন সেই বদিউল আলম আর ওই বাড়ির নিচতলায় বসবাসকারী তার শ্যালকের ফ্যাসাদের ফল। গোপন বৈঠক চলছে বলে স্থানীয়দের উসকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধাওয়ার মধ্যে হালকা আক্রমণের শিকার রয়েছে বার্নিকাটের গাড়ি।

শহীদুল একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে যৌক্তিক কথা বলার, সরাসরি এক দফার আন্দোলন করার অধিকার রাখতেই পারেন, কোনও রাজনৈতিক দলেও যোগদান করতে পারেন– কিন্তু ফেসবুকে এসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে শিশুদের বিভ্রান্ত করে, একটি আন্দোলনকে সহিংস করে তাদের জীবনকে হুমকিতে ঠেলে দেওয়ার কী দরকার ছিল। তার স্ত্রী রেহনুমা খান কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী সবুর খানের ভাগ্নি বলে মিডিয়ায় দেখলাম। তিনি তো কোটা আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে সুশীল ভূমিকায় নেমেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার রক্ষাকারীচক্রের সঙ্গেও তিনি কাজ করে আসছেন। কেউ তো বাধা দিচ্ছে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
ইমেইল: [email protected]
প্রথম প্রকাশ: বাংলা ট্রিবিউন, ৯ আগস্ট ২০১৮ 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত