দেখেন ফুটবল খেলা কাকে বলে

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০১৮, ১৮:৩২

ফুটবল বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে রসিকতা ইত্যাদি সহ্য করতে পারেন না কেউ কেউ। তাতে কি আপনি অবাক হয়েছেন? না। আমি অবাক হইনি। এটা আমাদের দেশের মিডল ক্লাসের স্বাভাবিক মজ্জাগত প্রবণতা। আমরা ঠাট্টা সহ্য করতে পারিনা, আমরা সমালোচনা সহ্য করতে পারিনা, আমরা ভিন্নমত সহ্য করতে পারিনা। আমরা কিন্তু আবার গালাগালিটা বেশ পছন্দ করি। নিজেরাও ইচ্ছামতো গালি দিই, আর অন্যরা কেউ গালি দিলেও সেটাকে মন্দ কিছু মনে হয় না।

আপনি যখন বাকস্বাধীনতা লিবার্টি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবেন, তখন এমনিতে দেখবেন অনেক লোক পাবেন যারা আপনার কথা শুনে বেশ হাত তালি দিবে। আপনার প্রশংসা করবে। কিন্তু এইটা ওরা বেশিক্ষণ করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি ওদের পক্ষের বা ওদের নিজের বা ওদের বন্ধুদের কথা বলার স্বাধীনতার কথা বলবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা আপনাকে হাত তালি দিবে। যেই মুহূর্তে আপনি ওদের অপছন্দের কারো বাক স্বাধীনতার কথা বলবেন- ওরে বান্তানাস রে, আপনার উপর ইয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

আমাকে এমনিতে মানুষ খুব একটা গালিগালাজ করে না। এর নানারকম সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। একটা হতে পারে যে আমি যেহেতু মৃদুভাষী এবং সাধারণত কাউকে চট করে আক্রমণ করিনা এজন্যে আমাকে গালি দিতে দ্বিধা করে। সকলে যে এরকম দ্বিধা করে তাও না। মাঝে মাঝে দুই একজন মিলে যারা উচ্চকণ্ঠে বেশ মন্দ মন্দ গালিগালাজ করে। সেইসব গালিগালাজ আমি সাধারণত উপেক্ষা করি। কেননা গালির তো জবাব হয় না। গালি তো তারাই দেয় যারা যুক্তিতে বুদ্ধিতে এবং অন্যান্য মাপে একটু নিচু প্রকৃতির।

আমাকে যারা মাঝে মাঝে গালি দেয় ওদের সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কিরকম জানেন? পথ চলতে গেলে জুতার নিচে যেরকম মাঝে মাঝে ময়লা লাগতে পারে, গালিও হচ্ছে সেরকম। অথবা কুকুর বেড়াল আপনার চলার পথে কেওমেও করতে পারে। এগুলি আপনাকে বিরক্ত করতে পারে, কিন্তু এগুলিতে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নাই। নীচের ময়লা নিচেই থাকবে, থাকুক।

রসিকতা বা ঠাট্টা নিয়ে কথা বলছিলাম। ফ্রান্সের কার্টুন পত্রিকা শারলি এবদু প্রফেটকে নিয়ে রসিকতা করেছিল বলে ওদের অফিসে হামলা হয়েছিল, মনে আছে আপনাদের? সেসময় আমি অনেক বন্ধুকেই দেখেছি, বিশেষ করে নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী বা ধর্মবিরোধী যারা আছেন ওরা, ওরা সকলেই এই হামলার নিন্দা করেছেন, বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। বেশ ভালো কথা। এদেরই দুই একজনকে আবার পরে দেখেছি ওদের প্রিয় কোন মানুষ প্রতিষ্ঠান বা বিষয়কে নিয়ে যখন আপনি রঙ্গ রসিকথা করেন, ওরা ক্ষেপে টেপে একদম ফায়ার।

এইতো কয়েকদিন আগে নাদিয়া ইসলাম গণপিটুনি এবং বিচারের আগে মানুষকে শাস্তি দেওয়া যে অন্যায় সেটা নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছেন। নাদিয়া ইসলাম অবশ্যই মৃদুভাষী নন, তিনি একটু চড়া গলায় কথা বলতে পছন্দ করেন। কিন্তু সে তো হচ্ছে ওর ফর্ম। নাদিয়া ইসলামকে গালাগালি করে আপনারা এমন অবস্থা করলেন, যেন পারলে তাঁকে হাতের কাছে পেলে না জানি কি করতেন। এমন সব গালি দিচ্ছিলেন আপনারা, এবং এমন সব লোকজন এইসব গালি দিচ্ছিলেন যে শেসে আমি নিজেই শরম পেয়ে সেগুলি এড়িয়ে যেতে থাকলাম।

ভাই, আপনার প্রিন্সিপালটা কি সেটা আগে ঠিক করেন। আপনি কি মানুষের বাক স্বাধীনতা চান? যদি চান তাইলে আপনার সবচেয়ে অপছন্দের কথাটাও যেন একজন অকপটে বলতে পারে, সেটা আপনি নিশ্চিত করবেন। আমার অপছন্দের কথাগুলি আমি শুনতে চাইনা- সেটা আমার ইচ্ছা, কিন্তু কেউ তাকে কথা বলতে বাধা দিবে, সেটা আমি সহ্য করবো না। কারো গলা টিপে ধরা তো আমি সমর্থন করতে পারি না, সে যদি আমার শত্রুর কণ্ঠও হয়।

সম্প্রতি আমি যে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল নিয়ে একটু খোঁচাখুঁচি করেছি, তাতে অনেকে আহত হয়েছেন। দুইজন আমাকে জানিয়েছেন এইরকম ট্রল করা নাকি ঠিক হয়নি, এটা নাকি অন্যায় ইত্যাদি। আমি ভাবলাম, আহা এনারা কিরকম ভদ্রলোক! এমনকি খেলাধুলা নিয়েও ট্রল করতে পছন্দ করেন না। এই মাপের সুশীল শোভন সুজন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছে দেখে গর্বিত হলাম। সাথে লজ্জিত হলাম যে এনাদের দিকে আগে বিশেষ মনোযোগ দিইনি কেন, কেন এনাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আরেকটু বেশী হলোনা ইত্যাদি।

তো সেইসব ভেবে আমি এইসব বন্ধুদের ওয়ালে গিয়ে কিছুক্ষণ উনাদের পোস্ট দেখলাম। ওরে ইসরাফিল রে, এইসব তো মনে হয় না দেখলেই ভালো হতো। তাইলে উনাদের সম্পর্কে আমার সম্মানটা থেকে যেত। ব্রাজিলকে নিয়ে কিঞ্চিৎ ট্রল উনারাও করেছেন এবং মাত্রার দিক দিয়ে সেগুলি আমার নিরীহ কথ্য ঠাট্টা তামাশার চেয়ে তীব্র বৈ মৃদু না। ও ভাই, ব্রাজিল নিয়ে কটু কথা বলেন তখন সেটা ঠিক আছে? আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন তাইলে বলবো যে, হ্যাঁ , সেটাও ঠিক আছে।

খেলাধুলা ইত্যাদি নিয়ে নির্দোষ ঠাট্টা তামাশা, এমনকি একটু কড়ারসাত্মক ঠাট্টা তামাশাও ঠিক আছে। এইটা এইসব প্রতিযোগিতা সমর্থন দলাদলি ইত্যাদিরই একটা অংশ বটে। তবে শোভন হওয়া উচিৎ- আর কোনটা শোভন কোনটা অশোভন আর কোনটা সুক্ষ আর কোনটা স্থূল সে তো আপনার সাংস্কৃতিক মানের ব্যাপার। কিন্তু ফুটবল খেলার ঠাট্টা তামাশা নিয়ে অধিক উত্তেজিত হবেন না।

ঘণ্টা দুয়েক পর ব্রাজিলের খেলা, খেলা দেখেন, দেখেন ফুটবল খেলা কাকে বলে। তাতে যদি আপনার মধ্যেও খানিকটা শিল্পবোধ জাগ্রত হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত