বাঙালির সাফল্য দেখলেই বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে

প্রকাশ : ১১ মে ২০১৮, ১২:২৭

(১) 
বাঙালির সাফল্য দেখলেই আমার শুধু বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। হোক সেটা খেলাধুলায় সাফল্য বা শিল্প সাহিত্যে বা অন্য যে কোন কিছু। এমনি শিল্প বাণিজ্য এইসবেও যখন দেখি বাংলাদেশের কেউ না কেউ কোন না কোনোভাবে আন্তর্জাতিকমানের কোন একটা সাফল্য অর্জন করে, তখনই আমার মনে হয়, হায়, বঙ্গবন্ধু যদি দেখতেন আজ ওর বাঙালি আজ দুনিয়াকে দেখিয়ে দিচ্ছে, ওরাও পারে। আহা। এই লোকটা সব সময়ই চেয়েছিলেন ওঁর বাঙালি সারা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিবে, ওরাও পারে। রবি ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, কবিগুরু, দেখে যাও আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।

আজকে এইরকম একটা সাফল্যের গল্প বলি। এটা সার্বিক বিচারে বাংলাদেশেরই সাফল্য বটে, তবে বিশেষভাবে এই সাফল্যটি একটি ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানের সাফল্য। কেবল নয় মাস সময়ের মধ্যে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করে গত চারদিন ধরে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে গাজীপুরের কড্ডায় সামিটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। নয় মাসের মধ্যে এতো বড় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা (সম্ভবত) একটি বিশ্ব রেকর্ড। সম্ভবত কথাটা ব্র্যাকেটের মধ্যে ঝুলিয়ে রেখেছি সতর্কতা হিসেবে- খোঁজ খবর নিয়ে যতটুকু জেনেছি এটাই বিশ্ব রেকর্ড।

(২) 
বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কাজটি ঠিক সহজ কাজ না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাবসাও খুব সহজ ব্যাবসা না। বলতে পারেন যে মেশিন কিনে এনে বসিয়ে দিয়ে তেল ভরে ইগনিশন চাবি ঘুরিয়ে দিলেই তো হয়ে গেল, এখানে আবার সোজা আর জটিলএর কি আছে। এইটা একটু ব্যাখ্যা করে বলি।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় বিশাল আকারের। এমনিতে একটা সাধারণ থোক হিসাবে বলতে পারেন যে প্রতি এক মেগাওয়াট ক্ষমতার জন্যে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় এক মিলিওন বা দশ লক্ষ মার্কিন ডলার। তাইলে ৩০০ মেগাওয়াটের জন্যে কি পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার হতে পারে একটা অনুমান করতে পারেন। এই যে এক মিলিওন প্রতি মেগাওয়াটের কথা বলছি, সেটা নিতান্তই একটা থোক হিসাব, প্রকৃত ব্যায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কারণে কম বা বেশী হয়।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগাড় করা একটা কঠিন কাজ। এর একটা অংশ উদ্যোক্তারা নিজেদের গাঁট থেকে দেয়, বাকিটা ঋণ। ঋণ আর নিজের টাকার এই অনুপাতটা (ইংরেজিতে আমরা বলি Debt-Equity Ratio) নির্ধারণ করা থাকে। আমাদের এখানে এটা ৭০:৩০, মানে উদ্যোক্তারা নিজেদের গাঁট থেকে ৩০% পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। বাকি ৭০% হবে ঋণ। আমাদের যে বাজার, সেই বাজারে ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট মিলিয়ে যদি আপনি এই পরিমাণ অর্থ তুলতে যান, পারবেন কি পারবেন না সেটা পরের কথা, কিন্তু তাতে যে পরিমাণ সময় যাবে তাতে সময় মতো বিদ্যুৎ প্রকল্প করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে।

তাইলে উপায় কি? উপায় হচ্ছে বিদেশ থেকে বা বিদেশী সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া। বিদেশী ঋণের আরেকটা সুবিধা আছে, কম সুদের হার। কিন্তু বিদেশী ঋণ তো চট করে চাইলাম আর লোকে দিয়ে যাবে সেরকম না। আর এই ধরনের প্রকল্পে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বিনিয়োগ করে ওদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া সেটাও যে চট করে কম সময়ে হয়ে যাবে তাও কিন্তু না। এই পুরো ব্যাপারটা সামলে সময় মতো ঋণের টাকা কাজে লাগানো এটাও একটা বিশাল দক্ষতার ব্যাপার।

(৩) 
এরপর আসে প্রযুক্তির ব্যাপারটা। একেকটা মাঝারী আকৃতির বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশ কয়েকটা ইঞ্জিন নিয়ে বানানো হয়। মনে করেন ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টা ইঞ্জিন মিলিয়ে ৩০০ মেগাওয়াটের একটা প্লান্ট হবে। এই ৫০ মেগাওয়াটের ছয়টা ইঞ্জিন জোগাড় করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এইসব ইঞ্জিন আপনি চাইলেই বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসতে পারবেন না। এইসব ইঞ্জিন খুব বেশী তৈরি করা অবস্থায় থাকে না। এইসব ইঞ্জিন যারা বানায়, অল্প কয়েকটা কোম্পানি আছে সারা দুনিয়ায়, ওদের সাথে ঠিকঠাক মতো যোগাযোগ করে, প্রয়োজনে আগেভাগে অর্ডার দিয়ে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি ঠিকমত এই ইঞ্জিনগুলি পাবেন।

একেকটা ইঞ্জিনের আবার বিশাল আকৃতি আর বিপুল ওদের ওজন। এইসব দানবাকৃতি মেশিন সেই প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে যাওয়াও একটা কঠিন কাজ। সড়ক পথে নিতে পারবেন না। একসাথে এতো বিপুল পরিমাণ ওজন বহন করার বাহন কই? আর আমাদের সড়কগুলিরও এতো ওজন বহনের ক্ষমতা নাই। নদীপথে নিয়ে যেতে হবে। নদীপথে যে নেবেন তার জন্যে বার্জ চাই। এরকম বার্জ আছে দেশে হাতে গোনা কয়েকটা। আবার আপনি যেখানে ইঞ্জিন নিতে চাচ্ছেন সেই পর্যন্ত নদীটির ঐরকম গভীর নাব্যতা আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দ্বারস্থ হবেন আপনি- ওরা আপনাকে নদী খনন করে দিবে। সময়ের ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে?

এরপর আসেন স্থাপনার কাজ। জমি লাগবে মনে করেন পনের একর। বাংলাদেশে একসাথে পনের একর নিষ্কণ্টক জমি কিনে সেটার উন্নয়ন করতে কতদিন লাগতে পারে? অনুমান করেন। সরকারকে বলবেন একোয়ার করে দিতে? তাইলে তো হয়েছে আরকি। ভুমিদস্যুতা করবেন? করতে পারেন। কিন্তু কাগজপত্র যদি ঠিক না থাকে আপনি তো ঋণের টাকা পাবেন না। এটা তো আর দিশী ব্যাংক না যে আপনি রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে বা ঘুষ দিয়ে কোনওরকমে একটা কিছু বুঝিয়ে দিয়ে টাকা বের করে নিয়ে আসবেন। তাইলে? জমি কিনতে হবে পুরো যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায়, আর ঠিক সময়ের মধ্যেই।

জমি পেলেন তো এরপর শুরু হবে নির্মাণ আর স্থাপনার বিশাল বিপুল কর্মযজ্ঞ। মনে রাখবেন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইঞ্জিন কয়েকটা এনে বসিয়ে দেওয়াটা এটাও একটা জটিল কাজ। কিন্তু এটা তো একটা অংশ মাত্র। এঞ্জিন বসানে থেকে শুরু করে তার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা, কন্ট্রোল সিস্টেম, মিটারিং সিস্টেম, তেল সরবরাহ এইসব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইঞ্জিনের চাকা ঘুরা থেকে শুরু করে ন্যাশনাল গ্রিডে বিদ্যুৎ যাওয়া পর্যন্ত এই পুরো প্রক্রিয়াটা সমন্বিত করা কি পরিমাণ কাজ অনুমান করতে চেষ্টা করুন।

(৪) 
তো এতোই যদি কঠিন হবে তাইলে সামিট এর মতো একটা দিশী কোম্পানি এইটা ঠিকঠাক নয় মাসের মধ্যে কিভাবে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো?

ব্যাবস্থাপনা আর সমন্বয়। কিসের সমন্বয়? দক্ষ ব্যাবস্থাপনা, অভিজ্ঞতা, অতি উঁচু মানের পেশাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ এদের সমন্বয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যার যার দায়িত্বটা ঠিকঠাকমতো পালন করেছে। একে অপরের সাথে সমন্বিতভাবে কাজগুলি করেছে। একদম প্রতিটা মানুষ- তুরাগ নদীর পারে নতুন বানানো ঘাটে যে পাহারাদারটা বসে থাকে সেই লোকটি থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুরের অফিসে বসে বিদেশী বড় বড় কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সাথে নেগোশিয়েট করছে কোম্পানির যেসব পরিচালকরা সবাই।

এই যে এতোসব লোকজন, এদের মধ্যে যে কোন একজন যদি নিজের কাজটিতে একটু ফাঁকি দেয় তাইলেই হয়তো পুরো প্রকল্প পিছিয়ে যাবে এক সপ্তাহ বা এক মাস সময়। একদম আক্ষরিকভাবেই- প্রতিটা মানুষের কাজই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সকলেই একসাথে যার যার কাজটা করছে বটে, কিন্তু একজনে সাথে আবার আরেকজনের কাজ সম্পৃক্ত। একজনের ঢিলেমি অপরের কাজটাও ঝুলিয়ে দিতে পারে। অনেকটা এসেম্বলি লাইন প্রডাকশনের মতো।

আর এই যে এতসব মানুষ, শুধু মানুষই তো নয়- একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে একসাথে। দিশী আছে বিদেশী আছে। কেউ পরিবহন করছে, কেউ সিভিল ওয়ার্ক করছে, কেউ বা ছোট একটা অংশ। মুল এঞ্জিন যারা দিয়েছে সেই কোম্পানি আছে, কিছু কোম্পানি আছে যারা নানারকম এক্সেসরিজ দিয়েছে, নির্মাণসামগ্রী বা অন্যান্য উপকরণ দিয়েছে যেসব কোম্পানি আছে- এদের লোকেরা আছে। সাদা কাল হলুদ বাদামী নানা রঙের লোক। এতো মানুষের কাজ নিখুঁতভাবে সমন্বয় করতে হয়েছে।

এদের সকলেরই অবদান আছে। কেউ প্রকল্পে কাজ করেছে দিনরাত, আর কেউ হেড অফিসে বসে কাজ করেছে, সকলেরই অবদান আছে। এমনকি যে উকিল সাহেবটা জিন্সের সাথে খাদি পাঞ্জাবী আর সবুজ জুতা পরে কাওরান বাজারে ভাইস চেয়ারম্যানের রুমে বসে বসে বাদাম চিবুতে চিবুতে আড্ডার স্টাইলে টুকটাক কথাবার্তা বলতো প্রকল্প নিয়ে তারও খানিকটা অবদান আছে বৈকি।

(৫) 
কাজটা সহজ ছিল না। গত বছরের জুলাই আগস্ট মাসে যখন এই প্রজেক্টটা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল আমার মনে হয়েছে যে, এরা এইসব কি বলে! তখন কোথা হচ্ছিল দুই হাজার আঠারোর এপ্রিলের মধ্যে ৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু করবে। আমি প্রকাশ্যেই বলেছি, বলেন কি ভাই, পারবেন? ৩০০ মেগাওয়াট? এটা কি হাসি তামাশার কথা? আমার মনে আছে কোম্পানির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক, ছোটখাটো আকৃতির একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী, মৃদু হেসে আমাকে বলেছিলেন, করে ফেলবো ইমতিয়াজ ভাই, ইনশাল্লাহ।

প্রকল্পের কাজ চলার সময় আমি গিয়েছি সেখানে- ব্যাবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে প্রজেক্টের ইঞ্জিনিয়াররা দিনরাত কাজ করছেন, একেকজনের চেহারা টেহারা রোডে পুড়ে ঝলসে গেছে, কারো কারো কাপড় ঢিলে হয়ে গেছে- মাথায় একটা সেফটি হেলমেট আর তার চোখে দৃঢ়তা।

আজকে ওদের সকলের সেই কঠিন যাত্রা সাফল্যের মুখ দেখেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে গত পাঁচ তারিখে। বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগে ১০০ ঘণ্টা পূর্ণ ক্ষমতায় সবকয়টা এঞ্জিন নিরবিচ্ছিন্ন চালিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। নির্ভরযোগ্যতার এই পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে আজ।

(৬) 
এইটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হচ্ছি কেন? এটা তো নিছকই একটা ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠানের একটা ব্যাবসায়িক সাফল্য। এটা নিয়ে আমার এতো উচ্ছ্বসিত হওয়ার কি আছে? আছে। শুধু উচ্ছ্বসিত হওয়া না। আবেগাপ্লুত হওয়ারও দিন আজকে।

আমরা বড় হয়েছি এমন একটা সময়ে যখন এইদেশের কমবেশি সব মানুষই কোন না কোনোভাবে নিজেদেরকে একটু ছোট মনে করতো। আমরা বিদেশীদের কাছে ভিক্ষা করে বাজেট তৈরি করতাম। আমাদের এই দেশে বিদেশ থেকে কোন লোক এলেই আমরা ওদেরকে মনে করতাম আমাদের চেয়ে বড়। সেইরকম সময়ে বড় হওয়া আমরা যখন দেখি বিদেশীদের সাথে পাল্লা দিয়ে দক্ষতায় যোগ্যতায় সাফল্যে আমাদের একটা দিশী কোম্পানি এগিয়ে যাচ্ছে, একটু আবেগাপ্লুত তো হতেই পারি।

আবেগের কথাটা আরেকদিন বলি। আজ শুধু সামিটের সকলকে অভিনন্দন জানাই। অভিনন্দন সবাইকে এই অভাবনীয় সাফল্যে। নাম নিলাম না কারো- সবাইকে অভিনন্দন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত