দায়টা আপনার

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০১৮, ১১:০০

মুহম্মদ জাফর ইকবালে আমি বেশ পছন্দ করি। পছন্দ করি সেটা আজকে থেকে না- যেদিন 'হাকারবিন' পড়েছি সেদিন থেকেই। আমার নিজের শৈশব কৈশোর যেভাবে কেটেছে তার সাথে জাফর ইকবালের শৈশব কৈশোরের মিল পাই- ওঁর গল্পের ক্যারেক্টারগুলির মধ্যে ওদের জীবনযাপনের মধ্যে নিজের, নিজের ভাই বোনদের আর বন্ধু বান্ধবদের অনেকের ছায়া দেখি। তিনি অনেক লেখেন, বইয়ের দোকানে গেলে দেখি অজস্র বই আর সেগুলি বিক্রিও হয় খুব, এর বেশিরভাগই আমি পড়িনি। তিনি ছেলেমেয়েদেরকে পড়াশুনা করতে, বিজ্ঞান গণিত এইসবে আগ্রহী হতে উৎসাহী করেন- চমৎকার কাজ। তিনি আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে দেশপ্রেম স্বাধীনতা এইসব নিয়েও বলেন। না, ওঁর সাথে অনেক ভিন্নমত আছে- অনেক সরিয়াস ভিন্নমত- কিন্তু সেগুলি তো আলাদা ব্যাপার আরকি। সব মিলিয়ে তিনি যে চমৎকার একজন মানুষ সেকথা মোটামুটি কেউই অস্বীকার করে না।

আমার বড় মেয়েটি গেল বছর নাকি তার আগের বছর পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্যে পুরস্কার নিতে গিয়ে জাফর ইকবালের বক্তৃতা শুনেছে। বাড়ী ফিরে এসে জানিয়েছে সেও জাফর ইকবালের কথা শুনে মুগ্ধ। ওঁর কাছেও মনে হয়েছে জাফর ইকবাল একজন চমৎকার মানুষ। একথা কেন বলছি তার কারণ হচ্ছে আমার কন্যার ভালো লাগা এটা হচ্ছে জাফর ইকবালের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সকলকে স্পর্শ করতে পারার ক্ষমতার ইন্ডিকেশন।

এই লোকটিকে এক যুবক আক্রমণ করেছিল। কেবল আক্রমণ বলাটা ঠিক হচ্ছে না, বলতে হয় হত্যার চেষ্টা করেছিল। খবরের কাগজে যেটুকু দেখেছি তাতে দেখা যাচ্ছে ছেলেটি অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডা মাথায় মওকা বুঝে জাফর ইকবালকে আঘাত করেছিল- আঘাত করেছিল স্পষ্টতই হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে। আপনারা সকলেই এই হামলার নিন্দা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। আমি নিজেও গণজাগরণ মঞ্চের একটা সভায় গেছি। আমার ফেসবুক সেসময় অবরুদ্ধ ছিল বলে ফেসবুকে এই বিষয়ে কোন পোস্ট আপনারা দেখতে পাননি।

আমাদের সৌভাগ্য যে ঐ যুবকটির আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে, মুহম্মদ জাফর ইকবাল সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। কিন্তু জাফর ইকবালের উপর যে আবার আক্রমণ হবে না বা অন্য কারো উপর অন্য কোথাও যে হামলা হবে না বা অন্য কেউ যে অভিজিৎ দীপন অনন্ত নিলয় এদের তালিকায় নাম লেখাবে না সেই সম্ভাবনা কি আমরা কমাতে পেরেছি? নিজেই নিজেকে উত্তরটা দেন।আমরা এই দেশটা আমাদের নিজেদের জন্যে নিরাপদ রাখিনি আর আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে নিরাপদ রেখে যেতে পারছি না।

দায়টা কার? কার আবার! দায়টা আপনার। এই যে আপনি আমার পোস্টটা পড়ছেন, আপনি কি কখনো বলেছেন যে না, ভিন্নমতের জন্যে কারো উপর শারীরিক হামলা করা অন্যায়? আপনি কি কখনো বলেছেন যে বিনাবিচারে মানুষকে মেরে ফেলা অন্যায়- হোক সেটা ক্রস ফায়ারে কিংবা হাজতে নিয়ে পিটিয়ে মারা? কখনো কি বলেছেন যে গুলি করে বা বোমা ফাটিয়ে যে সন্ত্রাসীরা মানুষ মারে সেটা অন্যায়? না, স্পষ্ট করে কখনো বলেননি। যদি কখনো বলেও থাকেন তাইলে নানাপ্রকার শর্ত ইত্যাদি যুক্ত করে বলেছেন।

অভিজিতের মৃত্যুর পর আপনারা একদল উল্লাস করেছেন, আরেকদল বলেছেন যে না, খুন করাটা ঠিক হয়নি কিন্তু অভিজিতেরও উচিৎ হয়নি ঐরকম লেখা। প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে আপনারা দলাদলি করেছেন। নিহত ব্যক্তি যদি আপনার দল বা আপনার গোত্র না হয় তাইলে প্রতিবাদ করেন না। ঘাতক যদি আপনার দল বা গোত্রের হয় তাইলে প্রতিবাদ করেন না। পুলিশ বা আর্মির লোকেরা যদি মানুষ মারে সরকারী দলের লোকেরা প্রতিবাদ করেন না। তাইলে কি দাঁড়ালো জিনিসটা?

আপনারা হত্যাকাণ্ডকে একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বানিয়ে ফেলেছেন। যেমন একদল হরতাল করলে আরেকদলের লোক নিন্দা করে বলে হরতাল কোট খারাপ এইরকম। আপনারা হত্যাকাণ্ডকে একসাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নিন্দা করতে পারেন না। কেন পারেন না? কারণ আপনি আসলেই মানুষের চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা মানেন না। আপনি চান না আপনার বিপক্ষে কটু কথা বলার কেউ বেচে থাকুক। আপনি চান না আপনার পছন্দের নেতাকে বা গুরুকে গালি দেওয়ার মতো কেউ বেঁচে থাকুক। আপনি চাননা আপনার দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার মত কেউ বেঁচে থাকুক। আপনি চান না যে আপনার ধর্মের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা বলার মতো কেউ বেঁচে থাকুক। তার মানে আপনিও কোন না কোন সময় হত্যাকাণ্ডকে কোন না কোনভাবে সমর্থন করেছেন।

একজন মানুষকে মেরে ফেলা যেন কোন দোকানের কাঁচে ঢিল মারা চেয়ে মোড় কোন অপরাধ না। পুলিশের কাস্টডিতে একজন মারা গেল- মনে হয় যেন পুলিশ লাঠি চার্জের চেয়ে একটু বেশী কিছু করেছে আরকি- ও কিছু না। ও ভাই, এইভাবে কি একটা সভ্য দেশ চলতে পারে নাকি?

ছেলেমেয়েদেরকে শেখান, যে ভিন্নমতের জন্যে মানুষকে মেরে ফেলা অন্যায়- ঘোরতর অন্যায়। মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা যাবে না- এমনকি যে লোকটির কথা আপনি সবচেয়ে অপছন্দ করেন, তার কণ্ঠও না। ভুল বললাম- বলতে হবে বিশেষ করে সেই কণ্ঠটিকেই রক্ষা করতে হবে যার কথা আপনার পছন্দ না।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত