কিউলেক্স মশাই ৯৯ শতাংশ রাজধানীতে চার মাসেই মশার ঘনত্ব বেড়ে দ্বিগুণ
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ২০:৫৯
মশা মারতে কামান দাগা প্রবাদটি রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। মশা মারতে ড্রোন, রোড শো, পরিচ্ছন্নতা ও মশককর্মীদের শরীরে অত্যাধুনিক বডি ক্যামেরার সংযোজন এবং হাঁস, পাখি, গাছ ও মাছের ব্যবহার করেছে তারা। তবে মশা বাগে আসেনি। বরং গত চার মাসে রাজধানী ও আশপাশে ঘনত্ব দিগুণ হয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির যাত্রাবাড়ী, উত্তর সিটির দক্ষিণখান, উত্তরার দুটি স্থান, মিরপুর এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এলাকায় মশার বিস্তার পর্যবেক্ষণ করছে একটি গবেষক দল।
জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এ গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব মিলেছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। মশার ফাঁদ পেতে এ গবেষণা চালানো হচ্ছে। এতে ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা ধরা পড়ছে। বাকি ১ শতাংশ এডিস, এনোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া।
কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি এবং ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোগ ছডায়। ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে। একে স্থানীয়ভাবে গোদ রোগো বলা হয়।
গবেষণায় ১২টি স্পটে ফাঁদের মাধ্যমে মশা সংগ্রহ করা হয়েছে। নভেম্বরে গড়ে প্রতিটি ফাঁদে ২০০টি করে মশা ধরা পড়েছে। ডিসেম্বরেও গড় সংখ্যা মোটামুটি একই ছিল। তবে জানুয়ারি থেকে এ সংখ্যা ৩০০ হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারিতে ৩৮৮ ও চলতি মার্চে এই সংখ্যা ৪২০টিতে ঠেকেছে। ঘরের ভেতর ও বাইরে আলাদা দুটি ফাঁদে সপ্তাহে একবার করে মাসে চারবার মশা সংগ্রহ করে হিসাব করে গড় বের করা হয়।
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি সমকালকে বলেন, মশার ঘনত্ব জানতে মূলত এ গবেষণা। এর আগে পূর্বাভাসে আমরা বলেছিলাম, মার্চে চরমে পৌঁছতে পারে। সেই পূর্বাভাস সত্যি হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে প্রতি ফাঁদে মিলছে ৪২০টি মশা। সবচেয়ে বেশি মশা পাওয়া যাচ্ছে উত্তরা ও দক্ষিণখান এলাকায়। গড়ে ৫০০ মশা ধরা পড়েছে।
কবিরুল বাশার বলেন, আমাদের আশপাশের ড্রেন ও নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার না করার ফলে মশা বেড়েছে। উত্তরার ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর সেক্টরে উত্তরা খালে প্রচুর কচুরিপানা। এসব কচুরিপানায় মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। একই রকম অবস্থা ঢাকা শহরজুড়ে। সিটি করপোরেশনের উচিত এখনই ড্রেন ও খালের লার্ভা ধ্বংস করে গাপ্পি মাছ ছেড়ে দেয়া।
এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রস্তুতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ে অত্যন্ত সজাগ আছি। ইতোমধ্যে একটি মিটিংয়ের আহ্বান জানিয়েছি, যেখানে শহরের দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সবাই থাকবে।
দুই সিটি করপোরেশন গত বছরে শতকোটি টাকার বেশি খরচ করলেও নগরবাসী মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় মশা মারার জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, পরে সেটা বেড়ে ৫৮ কোটিতে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে মশা নিধনের খরচ অনেক বাড়লেও এ কাজে সফলতা দেখাতে পারেনি ডিএনসিসি। একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেও। সেখানে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
নগরবাসীর অভিযোগ, এর কারণ সিটি করপোরেশনের গাফিলতি, কার্যকরী ওষুধ ব্যবহার না করা, ঠিকমতো ওষুধ না ছিটানো ও মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে না পারা। মানুষের সচেতনতার অভাবও একটি কারণ।
কীটতত্ত্ববিদ ড. ইন্দ্রানি ধর সমকালকে বলেন, এখন থেকেই গত বছরের ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে লার্ভিসাইডিং আর ফগিং করতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন করে একটি সার্ভে করতে হবে। যে ওয়ার্ডগুলোতে মশার সংখ্যা বেশি আর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাবে, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকাল ক্যাম্প স্থাপন করে সকাল-বিকেল লার্ভিসাইডিং ও ফগিং করতে হবে।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে আলাদা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। তবে তা তেমন কার্যকরী নয়। ফলে নগরীর মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকে। আবার ডেঙ্গু মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। গত বছরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার। গত বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন, যার মধ্যে ৯৮০ জনই ঢাকার।
রাজধানীর উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের শামীম পারভেজ বলেন, গরম মৌসুম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মশার উপদ্রব বেড়েছে। আশপাশের উত্তরা লেকসহ নর্দমা এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। সেখানে প্রচুর মশা জন্ম নিচ্ছে। সিটি করপোরেশনের মশককর্মীদের ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো ফজলে শামসুল কবির বলেন, এখন কিউলেক্স মশা বেশি হয়ে থাকে। মশার বিস্তার কমাতে আমাদের মশা নিধনকর্মীরা কাজ করছেন। আমাদের ৭৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং ও দুপুর আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অ্যাডাল্টসাইডিং ওষুধ ছিটানো হয়। মশার বংশ বিস্তার কমাতে খাল, ডোবা, নালা, ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদের কাজের কারণে এ বছর মশা অনেক কম। তিনি বলেন, সামনে ডেঙ্গুর মৌসুম। আমরা সতর্ক আছি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল রুবাইয়াত ইসমত অভীক বলেন, এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম চলছে। এ জন্য বিভিন্ন এলাকায় কিউলেক্স মশা বেড়েছে। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।
মশা নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কীটতত্ত্ববিদরা। শহরের কোথায় মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়েছে এবং সেখানে মশা নিধনে কী কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার, তা নিয়মিত ইনস্পেকশন করে প্রতিবেদন দেন করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদরা। তার ওপর ভিত্তি করেই করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা থাকলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এরকম কেউ নেই। ফলে মশার প্রজননক্ষেত্র বা উৎপত্তিস্থল অজানা থেকে যায়।