আজ আফ্রিকার সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে'র জন্মদিন

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৪৪

সাহস ডেস্ক

"চিনুয়া আচেবে'র উপন্যাস পড়লে মনে হতো জেলের দেয়ালগুলো যেন ভেঙে পড়োছে"
চিনুয়া আচেবের লেখা নিয়ে এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন ২৭ বছর জেলেবন্দী থাকা আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ন্যালসন ম্যান্ডেলা। ন্যালসন ম্যান্ডেলা আরও বলেছিলেন, আচেবে আফ্রিকাকে গোটা বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেছেন।


১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস থিঙ্গস ফল অ্যাপার্ট প্রকাশিত হওয়ার পরই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন আচেবে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ইগবো যোদ্ধা ওকোঙ্কোর লড়াইয়ের গল্পো সারা বিশ্বে ৫০টি ভাষায় ১ কোটির ওপর বিক্রি হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে ইগবো গ্রামে প্রথম সাদা চামড়ার মানুষের আবির্ভাব ও গ্রামবাসীদের জীবনের অনিশ্চয়তার গল্পো তুলে ধরেছিল আফ্রিকার ইতিহাস। আফ্রিকান সাহিত্যের পিতামহ বলে আচেবেকে উল্লেখ করেছেন কবি জ্যাকি কে।

আজ ১৬ নভেম্বর অন্ধকার মহাদেশ আফ্রিকার কণ্ঠস্বর'খ্যাত প্রখ্যাত উপন্যাসিক চিনুয়া আচেবের নব্বইতম জন্মদিন।
চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালে নাইজেরিয়ার এক বৃহদাকার গ্রাম ওগিডিতে। নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের এঙ্গলিকান মিশনারিদের গোড়ার দিককার স্থাপিত গীর্জাসমূহের একটি ছিল এই গ্রামে। তাঁর বাবার চাচা ছিলের প্রভাবশালী এবং গোত্রপ্রধান। এখানেই আচেবের শৈশব কাটে এবং তিনি ইবাদানের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময়কার শিক্ষায় পশ্চাৎপদ আফ্রিকায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেই একজন মানুষ সমাজের উচস্তরের বাসিন্দা বলে গণ্য হতেন, তাকে ভাবা হতো আলোকিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল ভেঙে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রিকার দেশগুলোতে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বড়ই অভাব। প্রথম জীবনে রেডিও ঘিরে গড়ে ওঠা পেশাটির পরিসমাপ্তি ঘটে যখন ১৯৬৬ সালে জাতীয় জাগরণের উত্তাল দিনগুলোতে, যা পরিশেষে বায়াফ্রান যুদ্ধে গিয়ে গড়ায়, তিনি সহসাই চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বায়াফ্রার তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক ও তহবিল সংগ্রহের উদযোগে বায়াফ্রার প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সময়ে তাকে নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ দেওয়া হয় এবং তিনি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পনের বছরেরও অধিক সময় ধরে তিনি বার্ড কলেজে চার্লন পি. স্টিভেনসন অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন। পরবর্তীতে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন আফ্রিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতি।

কোয়ামে এন্থনি আপাইয়া আচেবেকে ইংরেজী ভাষায় আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে সম্বোধন করেছেন। আরেক নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক নদিন গর্ডিমার বলেন, তিনি এমন একজন লেখক যার কোনো বিভ্রান্তি নেই এবং তিনি নিজে বিভ্রান্ত নন, নিজেকে অনুকম্পা না করেই যিনি তার জনগণকে ভালোবাসেন, যিনি এক মহৎ, উদার প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। আলিস্টার নিভেন-এর মতে, আচেবে তাঁর লেখায় এতখানি মিতবাক আর ঘনসন্নিবদ্ধ বলেই জীবিত যে কোনো লেখকের চেয়ে আধুনিক আফ্রিকার কাহিনী অধিকতর, অধিক পারঙ্গমতায় বলতে পেরেছেন।

লেখক হিসাবে চিনুয়া আচেবে আফ্রিকা এবং পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করেছিলেন। তাঁর কাজকে মানদণ্ড ধরেই প্রজন্মান্তরে আফ্রিকান লেখকদের কাজের মূল্যায়ন হয়ে আসছে।
১৯৯০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন চিনুয়া। এরপর তিনি প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় কোনো বই লেখেননি।দীর্ঘজীবনে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র পঁচিশ। এতেই বোঝা যায় জনপ্রিয় ধারার ঠিক বিপরীতে আচেবের অবস্থান, বহুলপ্রজ নন তিনি, সস্তা কিছু কখনোই লেখেননি, দায়বদ্ধতা ছিল মহৎ সাহিত্যের প্রতি। এদের মাঝে যে কেবল উপন্যাস রয়েছে তা নয়, তিনি ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেছেন। অন্যান্য আলোচিত গ্রন্থের মাঝে রয়েছে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত কাব্য Beware, Soul Brother and Other Poems, যা কমনওয়েলথ কবিতা পুরস্কার জিতে নেয়; ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন হোপস এন্ড ইমপেডিমেন্টস (আশা ও প্রতিবন্ধকতা)। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহ হচ্ছে  ম্যান অব দ্য পিপল (১৯৬৬), সিভিল পিস (১৯৭১), এ্যান্টহিলস অব দ্য সাভানা (১৯৮৭),
অ্যানাদার আফ্রিকা (১৯৯৮), হোম এন্ড এক্সাইল (২০০০)। এর মাঝে এ্যান্টহিলস অব দ্য সাভানা বুকার প্রাইজের সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠেছিল।

অসামান্য সাহিত্যসৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ চিনুয়া আচেবে তার জীবনে অসংখ্য সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মাঝে রয়েছে আমেরিকান একাডেমী অব আর্টস এন্ড লেটারসের সম্মানিত ফেলো, বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্যের জন্য নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা। তবে ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ম্যানবুকার পুরস্কার তার সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। ২০১০ সালে তিনি জরোথি আ্যান্ড লিলিয়ান গ্রিস পুরস্কার পান। সামরিক সরকার দু’বার তাকে নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক জাতীয় সম্মাননা ‘কমান্ডার অব দ্য ফেডারেল রিপাবলিক’ প্রদান করতে চাইলেও আজীবন ম্বৈরাচারী শাসকদের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আচেবে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। বিশ্বের ত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে গৌরবান্বিত করেছে। এ সবই অসামান্য প্রতিভাবান এক সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি।

২০১৩ সালের ২১ মার্চ ৮২ বছর বয়সে বস্টনের এক হাসপাতালে জীবনাবসান ঘটে আজন্মযোদ্ধা সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবের।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত