আলেকজান্দ্রিয়া: একটি গ্রন্থাগার এবং তার ধ্বংসের ইতিহাস

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৩:১৫

হিউম্যান রেইসের সবচেয়ে যুগান্তকারী প্রারম্ভিক ঘটনা যদি কিছু ধরা যায় তবে সেটা আগুনের আবিষ্কার। মানুষের আদি উৎস থেকে ধীরে ধীরে উত্তরনে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে এই আগুনের যেমন ভূমিকা ঠিক তেমনি শিকারসহ ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক বা পশুপালনেও এই আগুনের ভুমিকা ছিল সবচে প্রভাবশালী। কৃষি অথবা পশুপালনে অথবা দুই বিষয়ের সাংঘর্ষিক জায়গায় আপনি যদি আদম পূত্র ‘হাবিল-কাবিল’ অথবা প্রাচ্যের ‘আর্য-অনার্য’ সংঘর্ষকে সামনে নিয়ে আসেন সেখানেও দেখা যাবে মানুষ ধীরে ধীরে সমাজবদ্ধ এক ‘সংগঠন’ তৈরীর প্রয়াস চালায়। এই সমাজবদ্ধ প্রয়াসে কৃষি তথা ঊর্বরতা একটি মূখ্য বিষয়, সেখান থেকেই ‘সী গড’ এর হাত ধরে পর্যায়ক্রমে ‘গড’ ধারনার প্রবর্তন এবং এরই ধারাবাহিকতায় দর্শণ তথা জ্ঞ্যানের অন্বেষণে মানুষের এগিয়ে আসা।

কাগজ আবিষ্কারের বহু পূর্বেই অক্ষরের উৎপত্তি। শিলালিপিকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করেই এই সকল ইতিহাসের বয়ান আমরা পেয়ে থাকি অর্থাৎ ইতিহাস লিখিত অথবা অংকিত হয়েছে সে যেভাবেই হোক। শুধু তাইনা সেই ইতিহাস কোন না কোনভাবে সংরক্ষিতও হয়েছে যার সূত্র ধরে আমরা বর্তমান থেকে সূদুর অতীতে পৌঁছুতে পারি।

আমরা আজ একটি সুপ্রাচীন গ্রন্থাগার নিয়ে এবং সেটার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো।গ্রন্থাগারটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে গড়ে উঠেছিল। এই ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় আরব বেইজ মুসলিম শাসকদের, আসলে কি ঘটেছিল সেই বৃত্তান্ত একটু আলোচনা করতে চাই।

প্রথমে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী গঠনের ইতিহাসে একটু নজর দেই। আইজাক আজিমভের ‘মিশরের ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায় প্রথম টলেমী মিশরকে শাসন করতেন আলেকজান্দ্রিয়া থেকে [৩৩২ বিসিই তে আলেকজান্ডার মিশর দখল করেন এবং তার নামানুসারে নতুন রাজধানি গড়ে তোলেন যার নাম দেন 'আলেকজান্দ্রিয়া'] তখন সত্যিকারের মিশর বলতে যা বুঝায় তা আলেকিজান্দ্রিয়াই, বিশেষ করে বহিরাগতদের কাছে। প্রথম টলেমী এবং তার পূত্র দ্বিতীয় টলেমী আলেকিজান্দ্রিয়াকে শুধু বৃহৎ, জনবহুল এবং সম্পদশালী করাকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। উভয়ই চেষ্টা করেছিলেন একে একটি জ্ঞ্যানচর্চার কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে, এ ব্যাপারে তারা সাফল্যও লাভ করেছিলেন।

প্রথম টলেমী নিজেও একজন লেখক ছিলেন আর তিনি সোজাসাপ্টা গদ্যে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের জীবনী লিখেছিলেন। এটা দারুন আফসোসের ব্যাপার যে এই বিখ্যাত বইটির মূলকপি আমাদের হাতে আসেনি। তবে এর চারশো বছর পরে একজন গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ান আলেকজান্ডারের জীবিনী লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন সেটি মূলত প্রথম টলেমীর বইয়ের উপরে ভিত্তি করে লেখা।

টলেমী মহান দার্শনিক এরিস্টটলের লাইব্রেরী উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। আর তার সংগ্রহ বৃদ্ধি করার সব চেষ্টা  তিনি চালিয়েছিলেন । তিনি তার লাইব্রেরী সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত করার জন্য একজন এথেনীয় লাইব্রেরীয়ানকে আমদানি করেছিলেন। ফলে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট লাইব্রেরীতে পরিনত হয়।

লাইব্রেরী সংলগ্ন মিউজিয়ামে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয় যেখানে পন্ডিতেরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারতেন। এথেন্স, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বে গ্রীক বিদ্যা চর্চার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র, আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে তা ম্লান হয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পন্ডিতেরা সমবেত হতে থাকে সেখানে। এই কেন্দ্রের শীর্ষ সময়ে এখানে ১৪০০ ছাত্রের সমাগম ঘটেছিল, আধুনিক মাপকাঠিতেও বলা যায় এটি ছিল বিশাল এক বিশ্ববিদ্যালয়। এই আলেকজান্দ্রিয়াতেই ইউক্লিড তার জ্যামিতি আবিষ্কার করেন, ইরাতস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি নিরূপন করেন, হেরোফাইলাস ও ইরাসিস্ত্রেসাস শরীরতত্ত্বে অসাধারন অগ্রগতি সাধন করেন এবং তেসিবাস আবিষ্কার করেন জলঘড়ি।

এরকম এক বিশাল সংগ্রহ তথা লাইব্রেরী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় আস্তে আস্তে ধ্বংস হয়ে যায়, বিলীন হয়ে যায় কালের স্রোতে। তবে কারা ছিল সেই ধ্বংসের হোতা, কাদের থাবায় হারিয়ে যায় এক বিশাল ভান্ডার। এর ময়না তদন্তে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ১৮০০ বছর আগেকার রাজনীতি আর ক্ষমতার পালাবদলে, কনস্টান্টিপোলের খৃষ্টীয় শাসক থেকে প্যাগান পারস্য হয়ে আরব মুসলিম বিজেতাদের কাছে।

আলেকজান্দ্রিয়ার আগেও আমরা এরকম গ্রন্থাগারকে এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রমাণ পাই। জর্জ সার্টন তার ‘History of Science’ বইয়ে বলেন, "ভাববাদী গ্রীক দার্শনিক প্রোটোগোরাস তার একটি গ্রন্থে বলেছিলেন, খোদাগণ আছেন আমরা তা যেমন বলতে পারিনা, তেমনি তারা নেই এমনও বলতে পারিনা। এমন আরেক বিষয় রয়েছে যা আমাদের সামনে তা প্রমানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান যে বিষয় তা হলো খোদ এ বিষয়টির অস্পষ্টতা এবং মানুষের স্বল্পায়ু।"

সার্টন ঐ বইয়ে আরো বলেন, "এই কারনেই খৃষ্টপূর্ব ৪১১ সালে তার গ্রন্থসমূহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এনে অগ্নি সংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। ইতিহাসে গ্রন্থ ভষ্মীভূতকরণের প্রথম ঘটনা হিসেবে এটি বিধৃত হয়েছে।" এছাড়া আরো কিছু গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা আছে। যেমন: স্পেনের খৃষ্টানরা তদানীন্তন মুসলিমদের প্রায় আশি হাজার গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়, জর্জ জায়দান (খৃষ্টান ইতিহাসবিদ) বলেন, "ক্রুসেডের সময় খৃষ্টানেরা সিরিয়া-ফিলিস্থিনের কয়েকলক্ষ বই পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।"  আর তুর্কীরা মিশরে গ্রন্থাগার ধ্বংস করেন, সুলতান মাহমুদ গজনভী রেই শহরের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেন, মোঘলরা বাগদাদে ও খোরাসানে গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দেন।[উইল ডুরান্ট, হিস্টোরী অব সিভিলাইজেশন] জরথুস্ট্ররা সাসানী আমলে মাজদাকীদের গ্রন্থ সমূহ পুড়িয়ে দেন [ইমানদার দামানে সাসানিয়ান, ক্রিস্টেন সেন], রোমানরা প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ আরশমিদাদের গ্রন্থগুলো ভস্মীভূত করেন [আল ফেহেরেসত- ইবনুন নাদিম, মিশর]।

প্রথমেই কিছু পয়েন্টে আসি যেখানে বলা হয়েছে আলেকজান্দ্রিয়া ধ্বংসের জন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমরের আমলে মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনে আস দায়ী এবং সেইসাথে আমরা সেই ‘দায়ী’র জন্য আসলেই কারা দায়ী সেটাও ব্যাখ্যা করবো।

১ 

ইসলামের বিজয় সম্পর্কিত ইতিহাস সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় হিজরীতে রচিত হয়েছে এবং সেগুলো এখনও বিভিন্নভাবে এবং ভাষায় লিখিত হয়েছে। মুসলিম ইতিহাসবিদ ছাড়াও কয়েকজন খৃষ্টান ইতিহাসবিদও বিস্তারিত ভাবে মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সুবিশাল বর্ননা দিয়েছেন। প্রথম ক্রুসেড (১০৯৫ সালে) যুদ্ধের পূর্ববর্তী কোন মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদী ইতিহাস গ্রন্থেই আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগের বিবরণ পাওয়া যায় না।

প্রথম বারের মত ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ ও সপ্তম হিজরী শতাব্দীর শুরুতে ইরাকী খৃষ্টান ঐতিহাসিক আবদুল লতিফ বাগদাদী তার ‘আল ইফাদা ওয়াল ইতিবার ফিল উমুরিল মুশাহাদা ওয়াল হাওয়াদিসিল মায়াইনাহ বি আরদে মিশর’ নামক গ্রন্থ যা তার প্রত্যক্ষ দর্শন ও এক কথায় ভ্রমন কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত সেখানে ‘আমদুস সাওয়াদি’ স্তম্ভের আলোচনায় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের বিবরন দিয়ে বলেছেন, “এবং বলা হয়ে থাকে এই স্তম্ভ ঐ সকল স্তম্ভের একটি যার ঝুলন্ত বারান্দা ছিল এবং এরিস্টটল এই বারান্দায় বসে শিক্ষা দান করতেন ও এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এখানে একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার ছিল যা মদীনার খলীফার নির্দেশে আমর ইবনে আস ভস্মীভূত করেন।"

ইতিহাস বর্ননার নিয়ম হলো অবশ্যই তথ্যসূত্র অথবা সনদ উল্লেখ করতে হবে যেটা আমরা অন্যান্য ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে দেখে থাকি কিন্তু ইতিহাসবিদ লতিফ সাহেব এখানে লিখলেন ‘বলা হয়ে থাকে’ যেটা আসলে ইতিহাস চর্চার কোন নিয়মের মধ্যেই পড়ে না। এখানে ‘বলা হয়ে থাকে’ দ্বারা অনেক কল্পিত বয়ানেরও ইতিহাস তুলে ধরা যায় যেটা আসলে ইতিহাস না হয়ে মিথে রূপান্তরিত হয় এবং সেই ঘটনাটাই ঘটেছে আলেকজান্দ্রিয়ার ক্ষেত্রে।

এছাড়া আব্দুল লতিফের মত ইতিহাসবিদের নিশ্চই জানা থাকার কথা যে এরিস্টটল কোনদিনই মিশরে আসেননি। তিনি তার জীবদ্দশার পুরোটা সময়ই গ্রীসেই ছিলেন। সুতরাং তার ঐ ‘বারান্দায় বসে শিক্ষাদানের’ ব্যাপারটিও মোটেই ঘটেনি। আবার আলেকজান্দ্রিয়া শহর গড়ে ওঠে আলেকজান্ডারের মিশর আক্রমনের পর অর্থাৎ আলেকজান্ডার-এরিস্টটল সমসাময়িক হলেও আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি গড়ে ওঠে দ্বিতীয় টলেমীর আমলে [আইজাক আজিমভ] সুতরাং এই গ্রন্থাগারে এরিষ্টটল বসে শিক্ষাদান করেছেন কথাটি আসলে পুরোপুরি ভ্রান্ত একটি বয়ান।

আব্দুল লতিফ প্রথম হিজরী শতাব্দীর আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সমসাময়িক কোন ব্যক্তি নন। তিনি ষষ্ঠ হিজরীর শেষের দিক হতে সপ্তম হিজরীর শুরুর দিকের একজন ব্যক্তি অর্থাৎ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সময় হতে তার সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ছয়'শ বছরের মত। এই ছয়'শ বছরের মধ্যে কোন অমুসলিম কিংবা মুসলিম ইতিহাসবিদেরা এরূপ বর্ণনা দিলেননা কিন্তু তার বর্ণনায় হঠাৎ এই বিবরন উঠে আসার পেছনের কারন কি? সেই কারনের উত্তর একটাই সেটা হল আব্দুল লতিফ সাহেব যে গোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছেন সেই গোষ্ঠীই এই ধ্বংস যজ্ঞের হোতা এবং প্রারম্ভিক কুশিলব।

ঐতিহাসিক সাক্ষ্যমতে, মুসলমানদের হাতে আলেকজান্দ্রিয়া পতনের পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়া কয়েকবার বিভিন্ন শক্তির হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছিল। মুসলমানরা যখন আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে তখন সেখানে পূর্বের ন্যায় কোন গ্রন্থাগারই ছিল না। শুধু কিছু ব্যক্তির হাতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু গ্রন্থ ছিল এবং চতুর্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানেরা সেগুলো থেকে উপকৃত হত।

এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক উইল ডুরান্টের ‘হিস্টোরী অব সিভিলাইজেশন’ থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করি। আলেকিজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ৩৯২ খৃষ্টাব্দে আর্চ বিশপ তুফিনসের সময় মৌলবাদি খৃষ্টানরা পুড়িয়ে দেয় অর্থাৎ মুসলমানগন আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের ২৫০ বছর পূর্বেই এই গ্রন্থাগারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রন্থ ধ্বংস্প্রাপ্ত হয়।

ধারনাকৃত ঘটনাটির সাথে আব্দুল লতিফ রচিত গ্রন্থের পাঁচ শতাব্দীর অধিক সময়ের ব্যবধান ছিল এবং ইতিপূর্বে কোন ইতিহাসবিদই এই বিষয়টি উল্লেখ করেননি। অথচ ৯৩৩ খৃষ্টাব্দে (৩২২ হিজরী) আলেকজান্দ্রিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত খৃষ্টান আর্চ বিশপ ‘উতকিউস’ আরবদের হাতে এ শহর বিজিত হওয়ার ইতিহাস বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সেখানেও উল্লেখিত লতিফ সাহেবের বিবরন খুঁজে পাইনা। [তারিখে তামাদ্দুন- জর্জ যাইদান উইল ডুরান্ট উক্ত গ্রন্থে আলেকজান্দ্রিয়ার ধ্বংসের বিস্তারিত বিবরন দিয়েছেন যা ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম খন্ডে পাওয়া যাবে]

গুসতাভ লুবুন তার ‘ইসলাম ও আরব সভ্যতা’ গ্রন্থে বলেছেন, "আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি ধ্বংসের জন্য মুসলমানদের অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, কিভাবে এমন একটি বানোয়াট ও অসত্য বিষয় এতকাল ধরে প্রচারিত ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু বর্তমানে বিষয়টির অসত্যতা প্রমানিত হয়েছে; বরং এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ইসলামের পূর্বে খৃষ্টানরাই আলেকজান্দ্রিয়ার সকল উপাসনালয় ও মূর্তিসমূহ ধ্বংস করেছিল সেই সাথে এই মূল্যবান গ্রন্থাগারটিও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ইসলামী শাসনামলে আলেকজান্দ্রিয়া বিজিত হওয়ার সময় তেমন কিছুই সেখানে বিদ্যমান ছিলনা যা মুসলমানেরা পুড়িয়ে দিতে পারে।"

সম্রাট আলেকজান্ডারের প্রতিনিধিগনদের মিশরে ‘বাতালাসাহ’ বলা হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার এই গ্রন্থাগারটিতে মূলত এই বাতালাসাদের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল দার্শনিক ও পন্ডিত ব্যক্তিদের আনা হয়েছিল। তারা সেখানে শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু এ উন্নয়ন বেশীদিন থাকতে পারেনি। খৃষ্টপূর্ব ৪৮ সালে সিজারের নেতৃত্বে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে হামলা করা হয় ও এই জ্ঞ্যানকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অবশ্য রোমানদের রাজত্বে ও পরিচালনায় শহরটি পুনরায় উন্নত হয় ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় পৌছায়। কিন্তু তাও বেশিদিন টিকে থাকেনি। কারন সেখানের বাসিন্দাদের মধ্যে ধর্মীয় দাঙ্গা দেখা দেয় এবং রোম সম্রাটের পক্ষ হতে রক্তক্ষয়ী দমন অভিযান পরিচালনার পরেও সেটা অব্যহত ছিল। এমতাবস্থায় রোমে খৃষ্টবাদ রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। রোম সম্রাট থিওডর মূর্তিপুজকদের সকল খোদা, তাদের উপাসনালয়, গ্রন্থাগার সমুহ জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন।[ উইল ডুরান্ট]

আলেকজান্ডার ও তার পরবর্তীদের শাসনামলে মিশর গ্রীকদের রাজনৈতিক অধিকারে ছিল। কিন্তু গ্রীক সভ্যতা পতনের দিকে ধাবিত হলে রোম সম্রাজ্য-যার রাজধানী বর্তমানের ইতালীর রোম ছিল- যুদ্ধে গ্রীসকে পরাজিত করে তখন মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়াও রোমের রাজনৈতিক অধিকারে চলে যায়। রোম সম্রাজ্য চতুর্থ খৃষ্ট শতাব্দীতে দু’ভাগে বিভক্ত হয়। যথা: পূর্ব রোম- যার রাজধানী কনস্টানটিপোল (বর্তমান তুরষ্কের ইস্তাম্বুল) এবং পশ্চিম রোম–যার রাজধানী ছিল বর্তমান ইতালীর রোম। পূর্বরোম খৃষ্টবাদ গ্রহণ করে।

খৃষ্টবাদ গ্রীস ও রোম উভয় সভ্যতার উপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোমের বিভক্তির সময় হতেই ইউরোপের মধ্যযুগ (অন্ধকার যুগ) শুরু হয়। পূর্বরোম খৃষ্টবাদ গ্রহণ করার ফলে তৎকালীন খৃষ্টবাদী চিন্তার প্রভাবে-যারা বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চাকে মৌলনীতি বিরোধী মনে করত এবং দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের অধার্মিক ও বিচ্যুত বলে ফতোয়া দিত তারাই আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষা কেন্দ্রটির উপর খড়গহস্ত হলো। ৪৮ খৃষ্টাব্দে সিজারের আক্রমনের পর রোমের শাসকবর্গ দ্বিতীয় বারের মত এই শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগারটিতে অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংস প্রক্রিয়া চালায়। কনস্টানটাইন পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট যিনি খৃষ্টবাদ গ্রহন করেন। কনস্টান্টাইনের প্রতিনিধিগণের মধ্যে অন্যতম জাস্টিসিয়ান ষষ্ঠ খৃষ্ট শতাব্দীতে এথেন্সের জ্ঞ্যানকেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধ ঘোষনা করেন এবং ইতিপূর্বে চতুর্থ খৃষ্ট
শতাব্দীতে আলেকিজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রটিও বন্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এথেন্সের শিক্ষাকেন্দ্রটি ৫২৯ খৃষ্টাব্দে বন্ধ ঘোষিত হয় অর্থাৎ নবী মুহাম্মদের জন্মের ৪১ বছর, নবুয়্যত ঘোষনার ৮১ বছর, হিজরতের ৯৪ বছর, তার মৃত্যুর ১০৫ বছর এবং মুসলিমদের হাতে আলেকিজান্দ্রিয়া দখলের ১২০ বছর পূর্বে এই ঘটনা ঘটেছিল।

এখান থেকে স্পষ্ট বঝা যায় আলেকজান্দ্রিয়া তৈরী হয়েছিল গ্রীক প্যাগানদের দ্বারা এবং ধ্বংষ্প্রাপ্ত হয়েছিল খৃষ্টবাদের মৌলভীদের বদৌলতে।

এবারের আলোচনা আবুল ফারাজ ইবরীর বর্নিত মুসলিমদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিবরণ নিয়ে:

আবুল ফারাজ ইবরী একজন ইহুদী চিকিৎসক যিনি ৬২৩ হিজরীতে এশিয়া মাইনররের মালাতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টবাদ গ্রহন করেন। ফারাজ ইবরী নিজেও জীবনের প্রথমভাগে খৃষ্টবাদ অধ্যয়নে সময় ব্যয় করেন। তিনি আরবী ও সুরিয়ান ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি সুরিয়ান ভাষায় এক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন যার তথ্য সমুহ আরবী, সুরিয়ান, গ্রীক ভাষার গ্রন্থ সমূহ হতে নেয়া হয়েছে। ঐ গ্রন্থে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিবরনই নেই।

পরে গ্রন্থটি আরবী ভাষায় ‘মুকতাছারুদ দোয়াল’ নামে প্রকাশিত হয় যা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর পোকুক নামক এক অধ্যাপক কর্তৃক অনুদিত হয়েছে এবং সেখানে মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়া ধ্বংশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে আর এই বিবরনই মূলত ইউরোপে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।

‘মুকতাছারুদ দোয়াল’ গ্রন্থে অর্থাৎ ডক্টর পোকুকের অনুদিত গ্রন্থে আলেকজান্দ্রিয়া ধ্বংষের বিবরণ এভাবে এসেছে: ‘তৎকালীন সময়ে ইয়াহিয়া নাহভী যিনি ব্যাকরণবিদ উপাধিধারী ছিলেন তিনি আরবদের মাঝে বিশিষ্ট অবস্থান লাভ করেছিলেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী ছিলেন। প্রথমদিকে তিনি খৃষ্টান ধর্মের জ্যাকবি ধারার আভেরী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পর খৃষ্টধর্ম ত্যাগ করেন। ফলে মিশরের সকল খৃষ্টান ধর্মযাজকেরা তার নিকট এসে উপদেশ দানের মাধ্যমে তাকে তার পূর্বের ধর্মে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। ধর্মযাজকগণ তার একগুয়েমীর জন্য তাকে তার পদ থেকে অপসারন করেন। এরূপ অবিশ্বাসী অবস্থায়ই তিনি কিছুদিন অতিবাহিত করেন। এ সময়ই মুসলিম সেনপতি আমর ইবনে আস মিশরে আসেন।

একদিন ইয়াহিয়া আমর ইবনে আসের নিকট উপস্থিত হলে আমর তার জ্ঞ্যান সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখান। এই বিশিষ্ট জ্ঞ্যানী ব্যক্তি সেখানে প্রজ্ঞাজনোচিত এমন এক বক্তব্য দান করেন যা আরবরা কোনদিন শোনেনি। তার বক্তব্য আমরকে এমন প্রভাবিত করলো যে, তিনি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে গেলেন। যেহেতু আমর একজন চিন্তাশীল এবং বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি ছিলেন সেহেতু তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করলেন এবং সবসময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন।

একদিন ইয়াহিয়া আমরকে বললেন, আলেকজান্দ্রিয়ার সবকিছু আপনার অধিকারে আছে। তন্মধ্যে আপনার প্রয়োজনীয় বস্তু সমুহ আমরা চাই না কিন্তু যেগুলো আপনাদের কোন প্রয়োজন নেই তা আমাদের অধিকারে দিন যাতে আমরা তা থেকে অধিক উপকৃত হতে পারি। আমর প্রশ্ন করলেন, ঐ বস্তু কি? তিনি বললেন, দর্শন ও বুদ্ধি বৃত্তিক জ্ঞ্যান সম্পর্কিত গ্রন্থ সমূহ যা সরকারী গ্রন্থাগারে বিদ্যমান। আমর বললেন, আমি নিজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু করার অধিকার রাখি না। তাই মদীনায় খলীফার (উমর) নিকট হতে এ বিষয়ে অনুমতি চাইব। আমর খলীফার নিকট অনুমতি চেয়ে পত্র লিখলেন এবং খলীফা উত্তর দিলেন, যদি এই গ্রন্থ সমূহ কোরানের মতের অনুরূপ হয় সে ক্ষেত্রে এগুলো আমাদের প্রয়োজন নেই আর যদি কোরানের মতের পরিপন্থী হয় তাহলে এগুলো ধ্বংস করে দাও। এই উত্তর পাওয়ার পর আমর গ্রন্থাগার ধ্বংসের কাজে ব্রতী হলেন এবং আলেকিজান্দ্রিয়ার গোসলখানাগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে গ্রন্থ সমূহ বন্টনের নির্দেশ দিলেন। এভাবে ছয় মাসের মধ্যে সকল গ্রন্থ গোসলখানার পানি গরমের কাজে পুড়িয়ে ফেলা হল।[ আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার- শিবলী নোমানী]

উপরোক্ত বর্ণনা আবুল ফারাজ ইবনুল ইবরীই বর্ণনা করুক আর প্রফেসর পোকুক যেই করে থাকুক তাদের বর্ননায় শুরুতেই একটি গলদ রয়ে গেছে। সেটা হলো প্রসিদ্ধ দার্শনিক ইয়াহিয়া নাহভী। গবেষনায় দেখা গেছে, তিনি মুসলিমদের আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের একশ বছর পূর্বেই মৃত্যবরন করেছিলেন সূতরাং তার সাথে আমর ইবনে আসের সাক্ষাৎ ঘটার কোন সুযোগই নেই।[ তারিখে উলূমে আখলিদার ইসলাম- ডক্টর জাবিউল্লাহ সাফাউ]

দ্বিতীয় কাহিনীতে বলা হয়েছে, খলীফার নির্দেশ পৌছার পর আমর ইবনে আস গ্রন্থগুলোকে গনগোসলখানার কর্মচারীদের মধ্যে বন্টন করেন এবং ছ’মাস ধরে সেগুলো গোসলখানাতে ব্যবহৃত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া সেসময় মিশরের সবচেয়ে বড় শহর ছিল এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শহর বলে পরিগনিত হত। সয়ং আমর ইবনে আস এই শহরের বর্ণনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, ’এ শহরে চার হাজার গোসলখানা, চারহাজার ভবন ও ইমারত, চল্লিশ হাজার জিজিয়া দানকারী ইহুদী, চার’শটি সরকারী বিনোদন কেন্দ্র, বারো হাজার সবজী বিক্রেতা রয়েছে।' তাই আমাদের ধরে নিতে হবে ছয়মাস এই গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে এই চার হাজার গোসলখানার পানি উত্তপ্ত হত অর্থাৎ এত অধিক গ্রন্থ ছিল যে ঐ গ্রন্থ দিয়ে ( চার হাজারের সাথে ছয়মাস অর্থাৎ ১৮০ দিন গুন করলে দাঁড়ায় ৭২০০০ দিন বা দুই হাজার বছর) দুই হাজার বছর চলত। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো ওই গ্রন্থগুলো শুধু দর্শণ ও বুদ্ধি বৃত্তিক বই ছিল, অন্যকোন গ্রন্থ নয়। এখন চিন্তার বিষয় যে সভ্যতার জন্ম হতে ছাপাখানার সৃষ্টি পর্যন্ত যদি অনবরত দর্শণ ও বুদ্ধি বৃত্তিক বই বের করা হয় তাহলেও তা চার হাজার গোসলখানার ছয় মাসের পানি উত্তপ্ত করার জন্য যথেষ্ট হত কি? আরো চিন্তা করার দরকার এই পরিমান বইয়ের জন্য কি পরিমান স্থানের প্রয়োজন! গ্রন্থ সমূহ খড়ের গাদার মত স্তুপীকৃত অবস্থায় নিশ্চই থাকতো না কারন সেগুলো পড়া হতো সুতরাং তাক বা আলমারীতে সেগুলো সাজানোই থাকতো। চতুর্থ খৃষ্ট শতাব্দীতে রোম সম্রাটের পক্ষ হতে গ্রন্থাগার সমূহ ধ্বংসের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ধর্মজযাজক আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পর্কে এরূপ বিবরন দিয়েছেন, ’আমি ঐ গ্রন্থাগারের আলমারীতে কোন গ্রন্থই পাইনি।' [ আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার- শিবলী নোমানী]

শিবলী নোমানী এবং আরো কিছু পাশ্চাত্য গবেষক বলেছেন, তৎকালীন সময়ে গ্রন্থ সমূহ চামড়ায় লিখিত হত এবং কখনোই তা পোড়ানোর কাজে লাগানো সম্ভব না। তাই সেগুলো জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার অযৌক্তিক। শিবলী নোমানী মস্যিয়ে দ্যা পিয়ের নামক এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, ’আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পানি গরমের জন্য যখন অন্য জ্বালানী পর্যাপ্ত ছিল তখন গোসলখানার কর্মচারীরা চামড়া নির্মিত গ্রন্থ সমূহ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না।'

ইবনে খালদুন তার ইতিহাস গ্রন্থের ‘আল উলুমুল আকলিয়া ওয়া আছনাফুহা’য় বলেছেন, “বলা হয়ে থাকে আলেকজান্ডার ইরান আক্রমনের পর সম্রাট জারাকে হত্যা করেন এবং বৃহৎ এক রাষ্ট্রের ওপর তিনি প্রভূত্ব লাভে সক্ষম হন ও প্রচুর গ্রন্থ তার হস্তগত হয়। সে সময়েই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞ্যান ইরান হতে গ্রীসে স্থানান্তরিত হয়। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ইরান জয়ের পর খলীফা উমরকে পত্র লিখেন…(বাকী অংশ পূর্বেকার বিবরনের মত, তাই আর পুরোটা তুলে দিলাম না)”।

ইবনে খালদুনের মত ইতিহাসবিদ যদি লেখেন “বলা হয়ে থাকে” তাহলে বুঝতে হবে তিনি নিজেও এ-বিষয়ে সন্ধিহান আর সেকারনেই তার এই লিখাটিতে কোন রেফারেন্স বা কথকের নাম উল্লেখ করেননি। আবার তিনি বললেন, আলেকজান্ডার ইরান হতে গ্রীসে বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে গেছেন ও তার মাধ্যমে ইরান বিজিত হওয়ার ফলে গ্রীস নতুন এক জ্ঞ্যানভান্ডারের অধিকারী হয়েছিল। এ বিষয়ে অন্যকোন ঐতিহাসিকের বয়ান আমরা পাইনা। মজার বিষয় হল পুর দাউদ নামক এক ঐতিহাসিক খালদূনের এই পুস্তক যখন অনুবাদ করেন তখন তিনি ইবনে খালদুন উল্লেখিত “বলা হয়ে থাকে” শব্দটি আর লিখেন নাই।

৪ 

আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগার ধ্বংসের মূল হোতা খৃস্টান মৌলভীরা এবং তাদের গোড়াপন্থীরা। এই ঘটনার বিবরন পূর্বেও দিয়েছি এখন আবার আইজ্যাক আজিমভ লিখিত বহুল প্রচারিত বই “ মিশরের ইতিহাস” থেকে
কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি: “কনস্টান্টিয়াস চিরজীবী ছিলেন না তিনি ৩৬১ খৃষ্টাব্দে মৃত্যূবরণ করেন। তার মৃত্যূর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র জুলিয়ান ক্ষমতার উত্তরাধিকার লাভ করেন এবং অবিলম্বে তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। ৩৬৩ খৃষ্টাব্দে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি নিহত হন। … ৩৭৯ সালে প্রথম থিওডোসিয়াস সম্রাট হন, তিনি ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক। ৩৮১ সালে তিনি কনস্টানটিপোলে একটি খৃষ্টীয় ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে এরিয়ানবাদকে নিষিদ্ধ করা হয় আর এবার রাষ্ট্রশক্তি পূর্ণশক্তিতে ক্যাথলিকবাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এরিও এবং এসব বিধর্মী ধর্ম সম্প্রদায়ের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাদের গীর্জা অধিকার করে নেয়া হয়। ক্যাথলিক মতবাদের বাইরে অন্যসব খৃষ্টীয় মতবাদের আর ধর্ম চর্চার কোন অধিকার রইল না। প্রথম থিওডোসিয়াস যেমন পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে তেমন খৃষ্টান ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও খড়গহস্ত
ছিলেন। ৩৮২ খৃষ্টাব্দে সহ-সম্রাট গ্রেশিয়ান সিনেট থেকে পৌত্তলিক বেদী অপসারন করেন, ৩৯৪ সালে থিওডোসিয়াস অলিম্পিক ক্রীড়ার সমাপ্তি ঘোষনা করেন যা প্রায় বারো শতাব্দী ধরে পৌত্তলিক গ্রীকদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব ছিল, ৩৯৬ সালে এথেন্সের কাছে সেরিসের মন্দির ধ্বংস করে এতে করে গ্রীকদের চির শ্রদ্ধেয় ধর্ম-বিশ্বাস এলুসিয়ান রহস্যের চির অবসান ঘটে।

বহুযুগের মিশরীয় ধর্মও থিওডোসিয়াসের আমলে রেহাই পায়নি…… তারা ৩৯১ সালে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছয় শতাব্দী টিকে থাকার পর সম্রাটের আদেশে সেরাপিয়ান ধ্বংস করা হয়… আলেকজান্দ্রিয়ার ভাগ্যে এর চেয়েও বড় দুর্ভোগ ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার সবচেয়ে বড় প্যাগান দার্শনিক শিক্ষক ছিলেন হাইপেসিয়া। সিরিল তাকে বিপদজনক ভাবতো, সিরিল ৪১২ খৃষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ নিযুক্ত হন। ধারনা করা হয় সিরিলের উস্কানিতেই একদল খৃষ্টান সাধু ৪১৫ সালে হাইপেসিয়াকে হত্যা করে এবং তারা আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর অনেক কিছুই ধ্বংস করে দেয়...’[পৃষ্ঠা-১৭৩]

আইজাক আজিমভ তার বইয়ের ১৮৩ পৃষ্টায় মুসলিমদের সাথে আলেকজান্দ্রিয়ার বিষয়াদি নিয়েও লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, “প্রবাদ আছে যে, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী এই সময়ে (৬৪২ খৃষ্টাব্দে) চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করা হয়। লাইব্রেরীর গ্রন্থ সমুহ আমরের সামনে নিয়ে আসা হয়। কথিত আছে তিনি বলেছিলেন, “এই বইগুলি যদি পবিত্র কোরানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে এগুলি অপ্রয়োজনীয় আর যদি পবিত্র কোরানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে এগুলো ক্ষতিকর। অতএব উভয় ক্ষেত্রেই এগুলি ধ্বংস করা প্রয়োজন।" তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এটা নেহায়েত গল্প, সত্য নয়। কয়েক শতাব্দী ধরে মিশরের খৃস্টান শাসকদের পৌত্তলিক বিরোধী শক্ত অবস্থানের ফলে ধ্বংস করার মত খুব কম গ্রন্থই(মুসলিম বিজয়ের সময়) টিকে ছিল।“

পরিশেষে এটাই বলবো আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস মানবেতিহাসের এক কলংকজনক অধ্যায় এবং সেই ধ্বংস কার্যক্রম যারা করেছে তারা মানবতিহাসে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে শুধুমাত্র ধর্মকে এস্টাবলিস্ট করতে গিয়ে।

গ্রন্থ সহায়তা:
১। মিশরের ইতিহাস- আইজাক আজিমভ।
২। হিস্টোরী ওফ সাইন্স – জর্জ সার্টন।
৩। হিস্টোরী অফ সিভিলাইজেশন- উইল ডুরান্ট
৪। ইমানদার দামানে সাসানিয়ান- ক্রিস্টেন সেন।
৫। আল ফেহেরেসত- ইবনুল নাদিম।
৬। আল ইফাদা ওয়াল হাওয়া ফিল উমুরিল মুশাহাদা ওয়াল হাওয়াদিসিল মায়াইনাহ বি আরদে মিশর- আব্দুল
লতিফ বাগদাদী।
৭। তারিখে তামাদ্দুন- জর্জ জাইদান।
৮। ইসলাম ও আরব সভ্যতা- গুসতাভ লুবুন।
৯। মুকতাছারুদ দোয়াল- ডক্টর পোকুক।
১০। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার- শিবলী নোমানী।
১১। তারিখে ঊলুমে আখলিদার ইসলাম- ডক্টর জাবিউল্লাহ সাফাহ।
১২। ইসলাম ও ইরানের পারষ্পরিক অবদান- শহীদ আয়াতুল্লাহ মূর্তাজা মুতাহারী।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত