প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বেতার ভাষণ

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০১৯, ১২:৩২

সাহস ডেস্ক

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, শনিবার রাত ৯টায় BSF এর বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এক বেতার ভাষণ দেন। ভাষণটি পরদিন ১১ এপ্রিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়।

পাঠকের জন্য ভাষণের লিখিত রূপ হুবহু তুলে দেওয়া হলো।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা,
বাংলদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহূতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫শে মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলোলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরোধ করবার আহবান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেক দিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জী আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
আপনাদের অদম্য সাহস ও মনোবল যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্যে দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রাস্তীর্ণ ধবংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালী জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধুবাৎসল্যে, মায়া ও হাসি-কান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম যুদ্ধ ও রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ?
আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তিতুমীর-সূর্যসেনদের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রমশালী হোক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ত কিছুদিনের জন্য হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বোমারু বিমানের মোকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজেদের শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।
বাংলাদেশে আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারছেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তাঁরা বাইরে জগৎকে জানাচ্ছেন।
আজ প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বীর বাঙালী যোদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরোভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মোজাহিদ, আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগরপারের বাঙালী ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন।
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সংগে মোকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধসমূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্রলের ভাই-বোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ ও টাংগাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লার উপর। ময়মনসিংহ ও টাংগাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযোগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছোট ছোট শিবিরগুলোকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআর এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশোহর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশোহর ক্যান্টনম্যান্ট ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালীর।
উত্তরবংগে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নেয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরোধ করে বিব্রত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাকি অংশ এখন মুক্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারী। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এই সংগে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
আপাততঃ আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ- পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারী কাজ পরিচালনার জন্যে সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তাঁরা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যাঁরা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাঁদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
আমরা যদিও বিদেশের পাঠানো ত্রাণসামাগ্রীর জন্যে কৃতজ্ঞ; কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তাঁর ও তাঁর প্রিয় পরিজনের জান, মাল আর সম্ভ্রম।
বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারে আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালীর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেয়া হয়েছিল বিদেশী শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে-বাংলার নিষ্পাপ শিশুদেরকে ও নিরাপরাধ নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমস্ত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যাঁরা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তাঁরা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবেন না, এ বিশ্বাস আমরা রাখি।
বিদেশী বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে- একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতিক হিসেবে- হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্যে নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্রপরিবারগোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।
আমাদের বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্ত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করবার কাজে।
ইতিমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাঁদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাঁদেরকে আহবান জানাচ্ছি, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শীঘ্রই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতিমধ্যে প্রত্যেক আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্য নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সংগে যোগাযোগ করুন। যাঁদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাঁদেরও জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরো নানাভাবে আপনার উপস্থিতবুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদীপথে সমস্ত ফেরী, লঞ্চ ও প্লটুন অকেজো করতে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্যে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে সংগঠিত হতে হবে। এর জন্যে আপনার এলাকার সমর পরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে এবং তাঁর আদেশ ও নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে।
যুদ্ধে অংশ নেয়া ছাড়াই বাংলাদেশকে সব দিকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালী অফিসারদের মধ্যে যাঁরা এখনও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেননি, তাঁরা যে যেখানে থাকুন না কেন, আমরা তাঁদের মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহবান জানাচ্ছি। অনুরুপভাবে আমরা আহবান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সংবাদপত্রসেবী, বেতারশিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের-তাঁরা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ, তার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়োজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে আহবান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরচারিত রাজনৈতিক গন্ডীর ঊর্ধ্বে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি।
হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযোগিতা করা বা সংশ্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোন মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রুসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গোর থেকে গাত্রোথান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা যদি এই সুযোগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রোষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে।
আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয় সংকোচ করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরোধ তাঁরা যেন মজুতদারী ও কালোবাজারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন।
এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতিমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমরসজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নীচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালীর ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালীকে তারা বুটের নীচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখি আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাঁদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ- ঢাকার সাথে আজ তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশী দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বলানী সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়োজাহাজ আর বেশী দিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমূদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিছিন্ন দ্বীপের মত। বাংলাদেশের আকাশে শীঘ্রই ঝড়ের মাতম শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার, ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে প্রথিবীর সমস্ত মানুষের ভ্রূকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত, ওরা সন্ত্রস্ত মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরোয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মত ধ্বংস লীলায় মেতে উঠেছে।
পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ, যেখানে ওরা এ ধবংসের খেলায় মেতে উঠছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধবংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন তাঁরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর- আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তান্ডবলীলার চাক্ষুস প্রমাণ।
ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছে এবং সোভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহবান জানিয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানী বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানী সংগ্রহ করছিল তাদেরকে জ্বালানী সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রক্ষ্মদেশ।
যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন, তবু একথা এখন দিবালোকের মত সত্য হয়ে গেছে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষেকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ কর‍তে অনুরোধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।
আমাদের সে সমস্ত ভাইবোন শত্রুকবলিত শহরগুলোতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাঁদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। যাঁরা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাঁদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ যাঁদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাঁদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবোনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাআল্লাহ্, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থিরবিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধবংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধবংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র- জনতা তাঁদের সাহস, তাঁদের দেশপ্রেম, তাঁদের বিশ্বাস স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাঁদের নিমগ্নপ্রাণ, তাঁদের আত্মাহূতি, তাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হইয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ।
বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালী ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি।
যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলার মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানসের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হোক “জয় বাংলা”, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত