অমল সেন বেঁচে আছেন, থাকবেন-এ দেশের মাটিতে

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৯, ১১:২৬ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৯, ১১:৩৮

অনলাইন ডেস্ক

কমরেড অমল সেন ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় নেতা, যিনি যশোর-নড়াইল এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অমল সেনের দৃঢ় অবস্থান ছিল আজীবন। আজ তার ১০৬তম জন্মদিন।

অমল সেন ১৯১৩ সালের ১৯ জুলাই নড়াইলের আফরা গ্রামে এক জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৩ সালে খুলনার বিএল কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ী হতে হলে ব্যাপক কৃষক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান আমলের ১৯ বছরই তাকে রাজবন্দি হিসেবে জেলে কাটাতে হয়। শারীরিক নিপীড়নও বন্দি অবস্থায় সহ্য করতে হয়। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হলে তিনি দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন।

কমরেড অমল সেন তার বিপ্লবী জীবন শুরু করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই দিয়ে। সে সময়ের তরুণেরা অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে। অমল সেন কিশোর বয়সেই যোগ দেন যশোর-খুলনা কেন্দ্রীয় সামন্ত জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী গোষ্ঠীর সঙ্গে। বিপ্লবের মোহ চেতনা তার জীবনের শেষ পর্যন্ত বহাল ছিল। সেই চেতনা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে পরিশীলিত হয়ে তাকে এক নতুন মানুষে পরিণত করেছিল। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন সমাজের নিচুতলার মানুষগুলোর মধ্যে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশেও অমল সেন সেই সংগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অমল সেনের বিশ্বাস ছিল মানুষের প্রতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তার বিকাশ ঘটালে সে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তার এই বিশ্বাস কেবল শিক্ষণীয়ই নয়, নতুন প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদও বটে। তার রেখে যাওয়া ঐতিহ্যের পথ ধরে বর্তমান এই অন্ধকারময় সময় নতুন প্রজন্মের সামনের দিকে তাকানো সম্ভব।

বিপ্লবের প্রয়োজনে তার আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করা হয়ে ওঠেনি। কেমিস্ট্রিতে অনার্সের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় কেবল মার্ক্সীয় দর্শনই নয়, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান—সব ক্ষেত্রেই তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিভা তাকে আত্মগর্বী করেনি। এই বিনয়ী, নম্র মানুষটি সংগ্রামে ছিলেন দৃপ্তচিত্ত। সে রাজনৈতিক সংগ্রামে হোক, তাত্ত্বিক সংগ্রাম আর মাঠের সংগ্রামেই হোক।

কমরেড অমল সেনকে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা বিশেষ চেনেন না। তার মৃত্যুর খবরও সংবাদপত্রের পাতায় সেভাবে ফলাও করে প্রচার হয়নি, কিন্তু ঢাকা থেকে নড়াইল এবং তার সমাধিস্থল বাকড়ি পর্যন্ত তার শেষযাত্রায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বাকড়ি অঞ্চলে যেখানে ছিল তার সংগ্রামের কেন্দ্র, সেখানে সাড়ে চার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে তার শববাহী গাড়ির এক ঘণ্টার ওপর সময় লেগেছিল। বাকড়ির মানুষ তাদের নিজেদের এই লোককে বুকে টেনে নিয়েছেন। সেখানে তার স্মৃতিময় স্কুল প্রাঙ্গণেই তার সমাধি হয়েছে। তারা তাকে তাদের নিজের কাছে রাখতে চেয়েছেন, যেন সেখান থেকেই আগের মতো তিনি তাদের পরিচালনা করেন।

কমরেড অমল সেনরা চলে যান। কিন্তু তারা যে আদর্শ রেখে যান, তার মৃত্যু ঘটে না। অমল সেনের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়েও তার আদর্শের মৃত্যু ঘটেনি। অমল সেন বেঁচে আছেন, থাকবেন-এ দেশের মাটিতে, প্রকৃতিতে, মানুষের অন্তরে। তাদের আনন্দ, বেদনা ও সংগ্রামে।

(তথ্যসূত্র: কমরেড অমল সেন ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত ‘সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জনগণের বিকল্প শক্তি’ গ্রন্থ , বিমল সেন প্রণীত ‘অমল সেন সঞ্জীবনী’ এবং রাশেদ খান মেননের লেখা একাধিক প্রবন্ধ থেকে সংকলিত)

প্রথম প্রকাশ: বাঙালীয়ানা.কম, ১৯ জুলাই, ২০১৮ সাল।