ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: পক্ষে-বিপক্ষের ইতিহাস

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০১৯, ১২:৫৪ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৯, ১৩:০৮

সংগৃহীত

১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ হয়ে যায়। তৈরী হয় নতুন এক প্রেদেশ। নাম পূর্ববঙ্গ ও আসাম। ইতিহাসের পাতায় আমরা এই অধ্যায়টি পাই বঙ্গভঙ্গের আলোচনায়। পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনের দিকে এগিয়ে আনতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো তৎকালীন ইংরেজ সরকার। বলে রাখা ভালো, তখনও এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ 'ইসলাম' ধর্মের অনুসারী।

কিন্তু বঙ্গভঙ্গ খুব বেশী দিন কার্যকর ছিলো না। ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের চাপে ও প্রবল আন্দোলনের মুখে ইংরেজ সরকার শেষ পর্যন্ত 'বঙ্গভঙ্গ' রদ করতে বাধ্য হয়।

বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে আবার এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধে। যদিও পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়এ আসার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় অনেক আগে থেকেই এই ক্ষোভ মানুষের মনে ছিলোই। তখন এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে অন্তত যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করা যায় সেই লক্ষ্যে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা শুরু করে ইংরেজ সরকার।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে লিখেছেন, "বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্পেল্নডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।"

'কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়' তখন শুধু বঙ্গেই নয়, সারা ভারতবর্ষেরই একটি সুনাম অর্জন করেছিলো। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের মনে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিও একটা ক্ষোভ ছিলো বলে জানা যায়। 

লেখক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তার 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বই এ লিখেছেন "কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাঙালী মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল ১৯০৫- এ পূর্ব বাংলা এবং আসাম প্রদেশ গঠনের অনেক আগে থেকেই। ... ক্ষোভের কারণ শুধু হিন্দু প্রাধান্য নয়, শিক্ষাক্রমে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়"।

সে সময় বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে, ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন পূর্বে ভাইসরস এর সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)-এর অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি. আচির্বল্ড, ঢাকা মাদ্রাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক, এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশ্চন্দ্র আচার্য। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে 'দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০'। লর্ড রোনাল্ডসে ১৯১৭ হতে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর থাকা কালে নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা কে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য ঘোষণা করেন। সৈয়দ শামসুল হুদার সুপারিশে স্যার এ. এফ. রাহমান কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট মনোনীত করা হয়, তিনি ইতিপূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যরত ছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে রফিকুল ইসলামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নাথান কমিটি রমনা অঞ্চলে ৪৫০ একর জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এই জায়গায় তখন ছিল ঢাকা কলেজ, গভর্নমেন্ট হাউস, সেক্রেটারিয়েট ও গভর্নমেন্ট প্রেসসমূহ।

এরপরও বিভিন্ন জটিলতা থাকলেও ১৯২১ সালের ১ জুলাই 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কম বিরোধিতাও আসেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়।

১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল লর্ড হার্ডিঞ্জ এর সাথে দেখা করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।

সেই সময়কার ইতিহাস নিয়ে লেখা নথি গুলোতে পাওয়া যায় লর্ড হার্ডিঞ্জ এ নিয়ে বসেছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে। লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?

শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন।

কথা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তার 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ' নামক প্রবন্ধে লিখেছেন মূলত-বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন-

এক. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।

দুই. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০০০০ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে।

বিরোধীতায় উঠে আসা নামগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও এসেছে। তবে যারা দাবি করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিরোধীতা করেছেন তারা কখনই সরাসরি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। যদিও দেখা যায়, বিরোধিদের অনেকের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালো সম্পর্কই ছিলো।

সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা' বই এ লিখেছেন "শ্রেণীস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন,তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ।" তবে তিনি এর বিরোধিতা করেছেন এমন কোনো দলিল পাওয়া যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যে হয়েছিল নানা পক্ষ থেকে সেটা ইতিহাস ঘাটলে তথ্য পাওয়া যায়।

কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যারা তাদের কথা না বললেই নয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন।

অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয় এখনও চলছে তার আপন মহীমায়। দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠের সিলেবাস প্রথম প্রণয়ন করা হয়েছিলো তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে। সূচনালগ্নে বিভিন্ন প্রথিতযশা বৃত্তিধারী ও বিজ্ঞানীদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষাপটে এটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে স্বীকৃতি পায়।

এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মাত্র এই অঞ্চলের মানুষের জীবন মান উন্নীতকরণেই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে বললে ভুল হবে। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে উঠেছিলো 'জনগনের ক্যান্টনমেন্ট'।

তথ্যসূত্র:

উইকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা-সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ-কুলদা রায়, ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-মুনতাসীর মামুন।