যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:২২

ইন্দ্রনীল হালদার

মানুষ অষ্টপ্রহর শ্বাস নেয়। কিন্তু এই শ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়া আমরা অনুভব করতে পারি না। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে শ্বাস নেওয়া সম্পর্কে আমরা সচেতন হই। শ্বাসকষ্টের বিভিন্ন কারণ হতে পারে। সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসে যেমন শ্বাসকষ্ট হয় তেমনই হৃদরোগের কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। পেটের সমস্যা, গ্যাস, হজমের সমস্যা, অ্যালার্জি, হাঁপানি, রক্তাল্পতা, কিডনির সমস্যা এমনকি অতিরিক্ত মানচাপ চাপ, টেনশনেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। 

তবে বেশিরভাগ শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী ফুসফুসের সমস্যা। মূলত অবস্ট্রাকটিভ লাং ডিজিজের কারণেই শ্বাসকষ্ট হয়। এই ধরনের দু’টি বড় রোগ রয়েছে। একটা হল হাঁপানি বা অ্যাজমা আর অন্যটি হল ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ’ (সিওপিডি)। হাঁপানি বা অ্যাজমা মূলত একটা জেনেটিক রোগ। ভারতের ক্ষেত্রে হাঁপানি নিয়েই চিন্তার কারণ বেশি। কারণ, প্রায় ৫৫ মিলিয়ন হাঁপানি রোগী রয়েছে আমাদের দেশে। চিনের পরেই ভারতেই সব থেকে বেশি হাঁপানি রোগী রয়েছে। পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় এই মৃত্যুর হার ভারতে অনেক বেশি। অ্যাজমাকে দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে এই মৃত্যুহার অনেকটাই কমানো সম্ভব। অ্যাজমার ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ইনহেলেশন দেওয়া হয়। স্টেরয়েড শুনে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, স্টেরয়েড এমন অল্প মাত্রায় দেওয়া হয় যা শুধু ফুসফুসে পৌঁছোয়, ফলে তেমন কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। যখন হৃদ্‌যন্ত্রের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা কমে যায় তখন ফুসফুসে রক্ত জমে গিয়ে ফুসফুসকে অনমনীয় করে তোলে। তখন শ্বাস নেওয়ার জন্য বেশি শক্তি লাগে। আর হাঁপানি হলে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকা–বেরোনোর পাইপ (ব্রঙ্কিওল) সরু হয়ে যায় বলে শ্বাসকষ্ট হয়। আর সিওপিডি মূলত মধ্যবয়স্কদের ক্ষেত্রে হয়। ধূমপান হল মূলত এই রোগের কারণ। এ ছাড়াও বায়ু দূষণের সংস্পর্শেও এই রোগ হয়। এই রোগের বাড়াবাড়ি হলে রোগী মারাত্মক ধরনের শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন।

জ্বর বা রক্তশূন্যতা হলেও অনেক সময় শ্বাসকষ্ট হয়। কোনও কারণে রক্তে অম্লের পরিমাণ বেড়ে গেলে (মেটাবলিক অ্যাসিডোসিস) শ্বাসকষ্ট হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ডায়াবেটিস, কিডনির অকার্যকারিতা, ল্যাকটেট জমে যাওয়া বা শরীরে নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতির কারণে এমনটা হতে পারে। অত্যধিক ওজন বেড়ে যাওয়াও শ্বাসকষ্টের একটা অন্যতম কারণ। স্থূলতার কারণে অনেকের রাতে স্লিপ অ্যাপনিয়া হয় এবং যন্ত্র লাগিয়ে শ্বাস নিতে হয়।

প্যানিক ডিজঅর্ডার, অবসাদ বা অ্যাংজাইটি নিউরোসিস মনের রোগ। এর থেকেও দম বন্ধ লাগে। শ্বাসের সমস্যা হয়। এতে শারীরিক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি করে শ্বাস নেওয়ার জন্য রক্তের কার্বন ডাই-অক্সাইড শ্বাসের সঙ্গে অত্যধিক মাত্রায় বেরিয়ে যায় ও রক্তে ক্ষারের মাত্রা বেড়ে যায়। দেখা গিয়েছে, উৎকণ্ঠা আর ভয় পেলে প্রায় ২৫ থেকে ৮৩ শতাংশ ক্ষেত্রে একধরনের শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়, যার কোনও শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

সব শ্বাসকষ্টই হাঁপানি নয়। ফুসফুসের হাঁপানি হল একটি বিশেষ ধরনের শ্বাসকষ্ট। সাধারণত হঠাৎ করে তা শুরু হয় এবং এই শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার পর বুকের ভেতরে বাঁশির মতো শব্দ হয় এবং সঙ্গে কাশি ও বুকের ভেতর শ্বাস বন্ধ ভাব অনুভূত হয়। এত গেল ফুসফুসের হাঁপানির কথা। হৃদযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়লেও তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কার্ডিয়াক হাঁপানি বা এবং ফুসফুসের হাঁপানি ছাড়াও কিডনির বৈকল্যের জন্যও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যাকে অনেক চিকিৎসক রেনাল অ্যাজমা বলে থাকেন। 

নিউমোনিয়া নামটি বহুল প্রচলিত। এর একটি প্রধান উপসর্গ হলো শ্বাসকষ্ট। কতটা শ্বাসকষ্ট হবে তা নির্ভর করে ফুসফুসের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপকতার উপর অর্থাৎ ফুসফুসের যত বেশি অংশ আক্রান্ত হবে শ্বাসকষ্ট তত বেশি প্রকট হবে। ক্রনিক ব্রংকাইটিসের কথা অনেকেই জানেন। এই রোগের বিভিন্ন কারণের মধ্যে অতিরিক্ত ধূমপান, ধুলো এবং ধোঁয়ার দূষণ ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে বংশগত কারণ রয়েছে। বাহ্যিকভাবে ক্রনিক ব্রংকাইটিস রোগটির সঙ্গে ফুসফুসের হাঁপানির অনেক মিল রয়েছে, যদিও দুটি রোগ সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের এবং ভিন্ন প্রকৃতির। এই রোগে শ্বাসকষ্ট দিন দিন বাড়তেই থাকে। এবং অনেক রোগী আছেন যাঁরা নিজেকে হাঁপানি রোগী মনে করে থাকেন। তাঁরা জানেন না যে, তাঁদের শ্বাসকষ্টের কারণ আসলে হাঁপানি বা ফুসফুসজনিত সমস্যায় নয়।

 হঠাৎ করে শ্বাসনালিতে কোনও পদার্থ ঢুকে গেলেও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। এটি অবশ্য শিশুদের বেলায় বেশি হয়ে থাকে। অনেকে শিল্প-কারখানায় কাজ করতে করতে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। বিশেষ বিশেষ জিনিস উৎপাদনের সময় এত বেশি ক্ষতিকর ধোঁয়া বা উপাদান ছড়ায় যার থেকে শ্বাসকষ্ট হয়। যক্ষ্মা থেকেও রোগী শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন। যক্ষ্মার ওষুধ খাওয়ার পর সেরে গেলেও শ্বাসকষ্ট লেগেই থাকে। ফুসফুসের ক্যানসার বা যে কোনও ধরনের টিউমারে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। 

হৃদরোগজনিত শ্বাসকষ্ট বোঝার কতগুলি উপায় রয়েছে। যেমন, মধ্য বয়সের পর প্রথম শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া এবং শ্বাসকষ্টের সঙ্গে হাত-পা ফুলে যাওয়া বা শরীরে জল জমা। পরিশ্রমের সময় শ্বাসকষ্ট হওয়া এবং বিশ্রাম গ্রহণে শ্বাসকষ্ট কমে যাওয়া। রাতে বিছানায় শুতে গেলে শ্বাসকষ্ট ও কাশি হওয়া। মধ্যরাতে শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুম ভেঙে যাওয়া। ডায়াবেটিস রোগীদেরও শ্বাসকষ্ট হয়। হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট হয়। অনেক দিন থেকে উচ্চরক্তচাপে ভোগা রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। বাইপাস অপারেশনের পর অনেক সময় শ্বাসকষ্ট হওয়া। হার্ট ভাল্বে সমস্যা রয়েছে এমন রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। 

ইনহেলার ব্যবহার করে এবং অ্যাজমার চিকিৎসা গ্রহণের পরেও শ্বাসকষ্ট না-কমলে এবং বুক ধড়ফড়ের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে মনে করবেন হয়তো আপনার হৃদরোগ অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে এবং এর জন্য আপনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। যদি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং শ্বাসকষ্টের সঙ্গে বুকের ভিতর চাপ বা ব্যথা অনুভূত হয়, শরীর অত্যধিক ঘেমে যায়, তবে সেটি হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট স্ট্রোকের লক্ষণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে যেতে হবে, তা না হলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। শ্বাসকষ্ট হৃদরোগের একটি মারাত্মক লক্ষণ, কাজেই সব ধরনের শ্বাসকষ্টকে অ্যাজমা বা হাঁপানি মনে করে টোটকায় চিকিৎসা চালালে জটিলতা বাড়বে।

হিস্টিরিয়া রোগীর ভয়ানক শ্বাসকষ্ট হতে পারে। অনেক সময় দেখেছি ক্রিমিজনিত কারণেও শিশু শ্বাসকষ্টে ভুগছে। সেই শিশুকে মাসের পর মাস হাঁপানির ওষুধ খাওয়ানো হয় কিন্তু এক কোর্স ক্রিমির ওষুধ দেওয়াতেই শিশুর শ্বাসকষ্ট কমে গিয়েছে। পরিবেশ দূষণজনিত অ্যালার্জি থেকেও শ্বাসকষ্ট হয়।

লেখক: জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত