সুখে আছে বনবিড়ালের পরিবার

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:১৬

শীতের মাঝামাঝি, সোনাদিয়া ও আশেপাশের সমূদ্র উপকূলীয় চরগুলো মাতিয়ে রেখেছে হাজারো পরিযায়ী পাখি। দীর্ঘ পাঁচ দিনের পাখি গণনা ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র নিরূপণ শেষে আমরা ‘টিম ইসাবেলা’ রওনা করেছি চট্রগ্রামের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে বাঁশখালী উপজেলার উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য বাঁশখালী ইকো পার্কের প্রাণী বৈচিত্রতা পর্যবেক্ষণ। সোনাদিয়া থেকে রওনা করে, বেলাকারদিয়া, কালাদিয়া হয়ে হাঁসের চরের পাশ দিয়ে কহেলিয়া নদীতে আসতেই দুপুর হয়ে গেল। যারা আগে এই অঞ্চলে গিয়েছেন তারা জানবেন, এখানে পানি পথের যাত্রা কতটা রোমাঞ্চকর, সব কিছুই নির্ভর করে জোয়ার-ভাটার উপর। গত কয়েক দিনে আমাদের বোট কয়েকবার আটকে গিয়েছে চরে। এখানকার মাঝীদের রয়েছে জোয়ার-ভাটার সঠিক হিসাব ও নৌকা চালানোর অন্যান্য পারদর্শিতা, কোনটার হেরফের হলেই বিপদের আশংকা। একবার নৌকা চরে আটকে গেলেই আবার জোয়ারের জন্য অপেক্ষা। 

যাত্রা পথে চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে কুতুবদিয়া আসতেই বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল। জানুয়ারির মাঝামাঝি, সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো শীতল বাতাস বইছে, আমরা জড়োসড়ো হয়ে নৌকার ছাদে বসে অপেক্ষায় আছি ঘাটে পৌঁছানোর। আমাদের থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক রেস্টহাউজে। জায়গাটা বেশ বড় ও বেশ পুরনো কিছু অব্যবহৃত আধাপাকা ঘর রয়েছে। আমরা রাত ৮টা নাগাদ পৌঁছলাম। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি শেষ করে চলছে গল্প-আড্ডা। বাইরে খানিক সময় পর পর ডেকে উঠছে কয়েক প্রজাতির প্যাঁচা ও শিয়াল। আগ্রহ ধরে রাখতে না পেরে আমরা ৩ জন বেরিয়ে পড়লাম ক্যামেরা, বাইনো, হেডল্যাম্প হাতে।

ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই পাশের গাছে দেখা মিললো এশীয়-দাগিপ্যাঁচা (Asian Barred Owlet, Glaucidium cuculoides) এর সাথে, কাঁঠাল গাছের মাঝারী এক ডালে শিকারের অপেক্ষায় চুপ করে বসে আছে। আমাদের দেখে উড়ে গিয়ে বসল অন্য গাছে। আরো কিছু সময় পেরোতেই দেখা মিললো দুটি লক্ষ্মী-প্যাঁচার (Common Barn Owl, Tyto alba)। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখছে। প্রচণ্ড শীত হলেও কয়েকটা কুনো ব্যাঙের দেখা পাওয়া গেল। আমরা খুবই নিরবে এগিয়ে চলছি, একটি পুরনো ভবনের পাশ দিয়ে, তার পিছন দিকে যেতেই হঠাৎ দুটি কমলা রঙের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। আমি সবাইকে সংকেত দিয়ে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে গেলাম। বিল্ডিংয়ের পাটাতনের উপর একটি বিড়াল বসে আছে। সন্দেহ হতেই বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখতেই আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। একটা নয়, রয়েছে তিন-তিনটা বন বিড়াল। তাদের খাড়া খাড়া কান, গায়ের ধুসর বাদামি রং ও কপালের উপরে স্পষ্ট লম্বা দাগ দেখেই সহজে চেনা গেল। বিড়াল তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক হলেও, দুইটির আকার তুলনামূলক ছোট, ২ বছর হবে বলে ধারণা করলাম। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের দেখছে। নাগালের বাইরে থাকাতে মা বিড়ালটি বুঝতে পারল আমরা তাদের বিপদের কারণ নই। সে মাথা নিচু করে শুয়ে রইল। আমরা দীর্ঘ ১৫ মিনিট তাদের সাথে সময় কাটালাম। লাল আলো ফেলে তাদের আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করলাম। মাঝে মাঝে মা বিড়ালটি মাথা তুলে আমাদের দেখে নিচ্ছিল। তাদের বাবা হয়তো বেরিয়েছে খাবারের সন্ধানে।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম পুরনো সেই আধা-পাকা ঘর গুলোর কাছে, আশে-পাশের পরিবেশটা ঘুরে দেখলাম। রেস্ট হাউজের জায়গাটা বেশ বড়, অনেক ঝোপঝাড় ও গাছপালা রয়েছে। জায়গাটা চট্রগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, আশে-পাশের বসতি এলাকায় রয়েছে পর্যাপ্ত ঝোপঝাড়, গাছপালা এবং কিছু দূরেই চা বাগান। এছাড়াও জায়গাটা বাশখালি ইকো পার্ক থেকে ১.৫ কিমি. দূরে। সব মিলিয়ে তাদের খাবারেরও পর্যাপ্ততা রয়েছে বলে ধারণা করলাম। সচরাচর এই পরিত্যাক্ত জায়গায় কেউ আসেনা; প্রচণ্ড এই শীতে বন বিড়ালের পরিবার খুঁজে পেয়েছে একটি নিরাপদ আশ্রয়।

বাংলাদেশের সকল এলাকাতেই এই বন বিড়ালের দেখা মিললেও সংখ্যায় আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। সমতল এলাকার বিল ঝিলের ভিটা মাটির ঝোপে এদের সহজেই দেখা মিলতো এক সময়। মানুষের অসচেতনতা, আবাসস্থল ধ্বংস, পিটিয়ে হত্যা করা, গাড়ি চাপায় মারা যাওয়া, খাবারের জন্য হত্যা, চোরাচালানসহ অনেক কারণেই এরা আজ হুমকির মুখে। প্রাণীটি আদৌ হিংস্র নয়। গৃহপালিত মুরগি, মুরগির ছানা, কবুতর প্রভৃতি এরা ধরে নিয়ে যায় বলে এই বনবিড়ালের প্রতি মানুষ অনেকটাই শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু বনবিড়ালের খাবারের বড় অংশই হচ্ছে ঘাসফড়িং জাতীয় বড় পোকা, জমিতে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর, ছোট সাপ, বিষাক্ত পোকা। যেগুলো আমাদের ক্ষেতখামারে থাকে এবং ফসলের ক্ষতিসাধন করে। তাই বনবিড়াল গৃহপালিত মুরগি-কবুতর ধরে নিয়ে খেয়ে যতটুকু ক্ষতি করে তার থেকে অনেক বেশি উপকার সাধন করে থাকে পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি গুলোর।

বনবিড়ালকে স্থানীও ভাষায় ওয়াব বা গাড়া নামেও ডাকা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে বলা হয় জঙ্গল ক্যাট (Jungle cat, Felis chaus)। এরা গোধূলিকালীন ও নিশাচর প্রাণী। গাছে উপর উঠে রাতের আধারে এরা ছোট পাখি বা পাখির ডিম, ছানা প্রভৃতিও শিকার করে খায়। এক লাফে কয়েক ফুট পৌঁছে যেতে পারে। দিনের বেলায় এরা লতাপাতাঘেরা বড় গাছের কোটরে ঘুমায় বা তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে। প্রজনন মৌসুমে গাছের কোটরে, পতিত বাড়িতে দু’ থেকে চারটি ছানা প্রসব করে। বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে মার্চ এদের প্রজনন মৌসুম।

বাংলাদেশ থেকে নানাবিধ কারণেই আজ হারিয়ে যাচ্ছে অনেক বন্যপ্রাণী। এদের রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে সরকারি ও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি, বন্যপ্রাণী ও মানুষের সহবস্থান, বন্যপ্রাণী আইন শিক্ষা, ও গবেষণা নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করে যাচ্ছে ইসাবেলা ফাউন্ডেশন।

লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক, ইসাবেলা ফাউন্ডেশন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত