করোনাকালে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পবা'র ৫ সুপারিশ

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২০, ১৭:৩৮

সাহস ডেস্ক

কোভিড-১৯ এদেশে শুরু হওয়ার পর থেকে এই মুহূর্তে বিপুল সংখ্যক মানুষকে মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই এর মতো মেডিকেল জিনিসগুলো ব্যবহার করছে, ফলে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ফেলে দেয়া হচ্ছে তা আমাদের নজরে আসছে। এছাড়াও চিকিৎসা ব্যবস্থায়ও সেসব বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কি রকম হচ্ছে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? এইসব বর্জ্যগুলো স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত দুই ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এইসব বর্জ্যের সংস্পর্শে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের স্বাস্থ্যঝুকিতে ফেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি হতে পারে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেকক্ষেত্রেই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।

মানুষের অসুস্থতাজনিত এবং তার চিকিৎসা বা মেডিক্যাল ম্যানেজমেন্টের কারণে উৎপাদিত অপ্রয়োজনীয় বস্তু ও তরল পদার্থসমুহ যেগুলো ফেলে দেয়া হয় সাধারণভাবে সেগুলোই হলো মেডিক্যাল বর্জ্য। হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম,ডাক্তারের চেম্বারে  এই বর্জ্য সাধারণত উৎপন্ন হয়। বাড়িতে অবস্থানরত রোগির চিকিৎসাতেও মেডিক্যাল বর্জ্য তৈরি হয়। কোভিড১৯ -র মহামারীর কালে  মেডিক্যাল বর্জ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে কোভিডবর্জ্য। একজন মানুষ কোভিড১৯ আক্রান্ত হওয়া ও তার চিকিৎসার কারণে কোভিডবর্জ্য তৈরি হয়।

আজ ১১ জুলাই ২০২০, শনিবার সকাল ১১.০০ টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার উদ্যোগে অনলাইনে "করোনাকালে মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা" শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব সাবেক সভাপতি - ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপলস হেলথ এবং সাবেক সভাপতি- বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন। প্রফেসর ডা. শুভাগত চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রথিতযশা লেখক (চিকিৎসা বিজ্ঞান) ও চিন্তক। প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক, পবা। ডা.পংকজ কান্তি সূত্রধর, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতাল, ঢাকা। জনাব আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ, সুধীজন। সংবাদ সম্মেলনে ধারনা পত্র উপস্থাপন করেন ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক মেসবাহ সুমন।

 

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, মেডিক্যাল বর্জ্যের কারণে মানুষের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। সংক্রামক রোগব্যাধি ছড়ানোর একটি অন্যতম উৎস হচ্ছে  মেডিক্যাল বর্জ্য। এর ভাঙ্গা কাঁচ,ধাতব পদার্থ, সূঁই ইত্যাদি মানুষ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। ঔষধ ও বিভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রিত তরল-  মাটি,জল ও বায়ুর দূষণ ঘটায়। প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ও পলিথিন মাটির জন্য ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর। এই বর্জ্যের দ্রবণীয় ক্ষতিকর পদার্থ নানাভাবে মানুষের, স্থলচর ও জলচর প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। পুরো ব্যাপারটিই মানুষের অসুস্থতা এবং পরিবেশের দূষণের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণ মেডিক্যাল বর্জ্যের সাথে করোনাকালে যুক্ত হয়েছে কোভিড বর্জ্য। কোভিডবর্জ্য দুইধরণের। এক. কোভিড/সন্দেহভাজন কোভিড রোগির ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস,ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী, হাঁচি-কাশি, কফ ইত্যাদি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত কাপড়,টিস্যু পেপার,তোয়ালে/গামছা ইত্যাদি। দুই. কোভিড রোগির চিকিৎসায় সরাসরি কিছু বর্জ্য তৈরি হয় যেমন- নেজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন ক্যানুলা, ব্রিদিং ইনস্ট্রুমেন্ট, অক্সিজেন মাস্ক ইত্যাদি। বিগত চারমাসের করোনাকালে সারাদেশে কি পরিমাণ কোভিডবর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে তার সঠিক কোন হিসাব নেই। তবে অনুমাণ করা যায় এটির পরিমাণ বিশাল হবে। সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় না আনলে এগুলো করোনা ভাইরাস  ছড়ানোর উৎস হয়ে উঠবে। রাস্তার দুপাশে প্রতিদিন ফেলে রাখা শতশত মাস্ক গ্লাভস দেখা যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে আবর্জনার গাদায় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ফেলা হয়। বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা কোভিডবর্জ্য কিভাবে কোথায় ফেলতে হয় সেটা অধিকাংশ মানুষ জানেনা। তারা বেশিরভাগই রাস্তার পাশে এসব ফেলে আসে। যেসব মহল্লায় স্থানীয়

 

উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় সেখানে অন্যসব বর্জ্যের মতো কোভিডবর্জ্যকে ছেঁড়াফাটা ব্যাগে সংগ্রাহকের হাতে কোনমতে তুলে দেয়া হয়। । যেসব ল্যাবরেটরিতে নমুনা সংগ্রহ ও করোনা পরীক্ষা করা হয় তাদের অনেকেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ধার ধারছেনা। বিশেষকরে যেসব স্থানে করোনাপূর্ব কাল থেকেই মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিলোনা সেসব জায়গার অবস্থা ভয়াবহ। সবমিলিয়ে বলা যায় অনেক স্থানে কোভিডবর্জ্য করোনা সংক্রমণের উৎস হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গবেষণায় প্রমাণিত।

 
ডা. লেলিন চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে ধারনা পত্র উপস্থাপন করে জানান যে, রাজধানী ঢাকায় একধরনের মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, প্রিজম বাংলাদেশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ --এই তিনের সমন্বয়ে মোটামুটি নিরাপদ একটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আছে। অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রিজমের গাড়ি এসে বর্জ্য সংগ্রহ করে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থালে ডাম্পিং করে। ঢাকা মহানগরে এখনো বেশকিছু ছোট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল এই কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। সারাদেশে কোন সুসংগঠিত মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি।

 

মেডিক্যাল বর্জ্যের সাথে কোভিড বর্জ্য মিলে প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপুল ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। এটা বিবেচনা করেই   United Nations environment programme গত ১৯ জুন একটি waste management factsheets প্রকাশ করেছে। সেখানে বিশ্বের দেশসমূহের জন্য একটি প্রয়োগযোগ্য   গাইড লাইন প্রনয়ন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৩ এপ্রিল কোভিড১৯ এর কারণে উদ্ভুত অবস্থায় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, জনপরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে।  দুটো সংস্থাই তার নির্দেশিকায় মানুষের স্বাস্থ্য, সংক্রমণরোধ ও পরিবেশের দূষণরোধকে মূল ভিত্তি হিসাবে নির্ধারণ করেছে।

 

কোভিড বর্জ্য মূলতঃ 'সংক্রামক বর্জ্য'। মেডিক্যাল বর্জ্য ও কোভিড বর্জ্য - এ দুয়ের সমন্বয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের স্বাস্থ্য দুটোই বিপদগ্রস্ত। এই অবস্থা নিরসনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন ( পবা ) এর  সুপারিশ হলোঃ-


১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের নির্দেশনা অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে একটি " জাতীয় মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা" গাইডলাইন তৈরি করা। এই গাইডলাইন মেনে চলতে প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা এবং জনসাধারণকেও উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করা। 

২. মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে স্থানীয় সরকার,স্বাস্থ্য অফিস ও পরিবেশ অফিস অবশ্যই যুক্ত থাকবে। উপজেলা/জেলা পর্যায়ে 'আইনশৃংখলা রক্ষা কমিটি ' মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তত্ত্বাবধানে থাকবে।

৩. মেডিক্যাল বর্জ্য নদীনালা,খালবিল, পুকুর,ডোবা,ড্রেন,রাস্তার পাশে,খোলা জায়গা ইত্যাদি স্থানে ফেলা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। এটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

৪. উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মেডিক্যাল বর্জ্যের জন্য 'ডাম্পিং স্থান' এবং 'ইনসেনিটার বা বিজ্ঞানসম্মত চুল্লী' স্থাপন করা জরুরি।

৫. মেডিক্যাল বর্জ্য বিশেষ করে এই করোনাকালে সংক্রামক কোভিড বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে  হবে। এজন্য জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাঠ পর্যায়ের সকল সরকারি ও এনজিও কর্মিদের এই কাজে যুক্ত করতে হবে।
 

বলা হয় 'একটি জাতি কতোটা সভ্য সেটা বোঝা যায় ঐ দেশের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখে '। পবা বলে-' একটি দেশ কতোটা সুস্থ সেটা বোঝা যায় সেই দেশের মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দেখে'।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত